ড. মতিউর রহমান

  ১৩ মার্চ, ২০২৩

যৌন নিপীড়ন নির্মূলে জনসচেতনতা জরুরি

ছবি : সংগৃহীত

নারী ও শিশুদের প্রতি যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর ৪ মার্চ বিশ্বব্যাপী যৌন নিপীড়নবিরোধী দিবস পালন করা হয়। প্রতিদিন অসংখ্য নারী, কন্যাশিশু এবং কিশোর-কিশোরী আন্তর্জাতিক অপরাধী নেটওয়ার্কের ফাঁদে পড়ে। এসব অপরাধী তাদের ওপর যৌন নিপীড়ন করে, তাদের পাচার করে এবং দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে।

যৌন নিপীড়ন নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মতে, নারী, কন্যাশিশু বা কিশোর-কিশোরীদের শরীরের স্পর্শকাতর অংশে অযাচিত স্পর্শ এবং সেই সঙ্গে অননুমোদিত যৌন কার্যকলাপের চেষ্টাকে যৌন নিপীড়ন বলা হয়। সহজভাবে বলতে গেলে, কাউকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক যৌন কার্যকলাপ বা যৌন আকাক্সক্ষা চরিতার্থের ইচ্ছাকেই বলা হয় যৌন নিপীড়ন।

নারী, কন্যাশিশু ও কিশোর-কিশোরীরা দেশ ও বিদেশে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। এটি একটি সামাজিক ব্যাধি। শিশু থেকে বৃদ্ধ, কেউই রেহাই পাচ্ছে না এ রোগ থেকে। অনেক দেশে নারীরা অবাধে চলাচল করতে পারলেও তারা বিভিন্ন স্থানে যেমন বাড়ি, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, রাস্তা, যানবাহন, ফুটপাত বা পাবলিক প্লেসে যৌন নিপীড়ন বা হয়রানির শিকার হয়।

জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউএন উইমেন উল্লেখ করেছে, প্রতিদিন প্রতি সেকেন্ডে গড়ে আটজন মানুষ যৌন নিপীড়ন, পাচার ও দাসত্বের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধমূলক নেটওয়ার্কের ফাঁদে পড়ে। যৌন নিপীড়ন হলো একজন মানুষের সঙ্গে সবচেয়ে খারাপ আচরণের একটি। কারণ এটি তার মৌলিক মানবাধিকার-স্বাধীনতা, মর্যাদা এবং এমনকি নিজের শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার হরণ করে।

এ সমস্যা সর্বব্যাপী; তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দেশগুলোতে যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটে থাকে বেশি। এসব দেশ থেকে পাচার করা নারী, কন্যাশিশু ও কিশোর-কিশোরীদের উন্নত দেশে নিয়ে যাওয়া হয় পতিতাবৃত্তির জন্য। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যৌন নির্যাতিতরা যৌন নির্যাতনের বিষয়টি গোপন রাখে। কারণ তারা মনে করে, তাদের সাহায্যের জন্য কেউ নেই। এমনকি যখন তারা এ বিষয়ে বলে, তখন তাদের কথা প্রায়ই বিশ্বাস করা হয় না এবং তারা মানসিক, সামাজিক ও শারীরিক সমস্যার বেশি ঝুঁকিতে পড়ে। তাই তারা নীরব থাকার পন্থা বেছে নেয়, যা সমস্যাটিকে আরো স্থায়ী করে।

যৌন নিপীড়ন আসলে কী, সে বিষয়ে অনেকেরই সম্যক ধারণা নেই বলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বেশির ভাগ মানুষই এ সম্পর্কে অবগত নয়। ফলে অনেকেই এমন আচরণ করেন, যা যৌন নিপীড়নের পর্যায়ে পড়ে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর এ সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় এড়িয়ে যান। ফলে যৌন নিপীড়ন সমাজ থেকে নির্মূল করা দুরূহ হয়ে পড়ে। যৌন নিপীড়ন অনেক ধরনের হতে পারে।

যৌন নিপীড়ন বলতে শারীরিক নির্যাতন করাকে বোঝায়। মৌখিকভাবেও কাউকে কাউকে যৌন নিপীড়ন করা হয়। আবার ভিজ্যুয়াল বা দৃশ্যমান বস্তু দ্বারাও নিপীড়ন করা হতে পারে। যেমন : কেউ যদি কাউকে পোস্টার, কার্টুন, ড্রয়িং, ছবি, অ্যানিমেশন ইত্যাদির আকারে অযাচিত যৌন গ্রাফিক বা পর্নোগ্রাফিক সামগ্রী প্রদর্শন করে বা পাঠায়, তাহলে তা যৌন নিপীড়নের পর্যায়ে পড়ে।

ইন্টারন্যাশনাল লেবার অরগানাইজেশনের (আইএলও) গবেষণা অনুসারে, প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষকে যৌন নিপীড়নের উদ্দেশ্যে পাচার করা হয় এবং এর ৯৮ শতাংশই হলো অল্পবয়সি কন্যাশিশু ও কিশোর-কিশোরী। এসব যৌন অপরাধের হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। ইউনিসেফের তথ্য অনুসারে, প্রতি বছর প্রায় এক মিলিয়ন বা ১০ লাখ মানুষ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। তাদের মধ্যে শুধু নারী ও কন্যাশিশুই নয়, অল্পবয়সি ছেলে ও যুবকও রয়েছে। বিশ্বব্যাপী ৩০ লাখেরও বেশি শিশু পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত হতে বাধ্য হয়।

মানব পাচার এখন অনেক লাভজনক বহু বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছর আড়াই লাখেরও বেশি মানুষ সেক্স ট্যুরিজমের জন্য বিদেশ ভ্রমণ করে। আর এ অর্থ উপার্জনের ব্যবসা সারা বিশ্বে শিশু পতিতাবৃত্তি বৃদ্ধিতে ইন্ধন জোগাচ্ছে।

নারী, শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা এখন অনলাইনেও যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। গত বছর প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৬৪ শতাংশ নারী এবং ৫৬ শতাংশ কিশোর-কিশোরী অনলাইনে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। শহুরে শিশুদের মধ্যে অনলাইনে যৌন নিপীড়নের ঘটনা গ্রামীণ অঞ্চলের কিশোর-কিশোরীদের তুলনায় দেড় গুণ বেশি।

যেসব কিশোর-কিশোরী ইলেকট্রনিক ডিভাইস এবং ফেসবুক, টিকটক, হোয়াটসঅ্যাপ ও চ্যাটরুমের মতো সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে, তাদের অনলাইন যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার আশঙ্কা বেশি। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ৫০ শতাংশের বেশি কিশোর-কিশোরী সংশ্লিষ্ট আইন সম্পর্কে জানে না।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, ৭৬ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কোনো না কোনোভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হন। এর মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮৭ শতাংশ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৬ শতাংশ এবং মেডিকেল কলেজে ৫৪ শতাংশ। এ ছাড়া বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত নারীদের মধ্যে ১৯ শতাংশ যৌন নিপীড়নের শিকার হন।

লিঙ্গসমতা একটি মৌলিক মানবাধিকার এবং একটি শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ ও টেকসই ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় ভিত্তি, যার অর্থ এমন একটি বিশ্ব যেখানে নারী ও পুরুষ, মেয়ে ও ছেলে সবাই সমান অধিকার, সম্পদ, সুযোগ ও সুরক্ষা ভোগ করে। তবুও লিঙ্গ পক্ষপাত এটিকে অসম্ভব করে তোলে। অনেক নারী তাদের কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্যের সম্মুখীন হন এবং কিছু নারী গার্হস্থ্য সহিংসতা ও নির্যাতনের সম্মুখীন হন।

নারী বা পুরুষ যে কেউই যৌন নিপীড়নের শিকার হতে পারেন। তবে নারী, কন্যাশিশু এবং কিশোর-কিশোরীরা এর শিকার হয় বেশি। যৌন নিপীড়নের শিকার নারী ও কন্যাশিশুরা সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিধান ও অনেক সমাজ কাঠামোয় পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাধান্যের কারণে এ বিষয়ে মুখ খুলতে সাহস করে না। অনেক ক্ষেত্রে তারা প্রতিবাদও করতে পারে না। কারণ, প্রতিবাদ করলে উল্টো তাদেরই দোষারোপ করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা আরো মনে করেন, দেশে যৌন হয়রানি রোধে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট উদ্যোগ নেই। যদিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে স্কুল-কলেজে যৌন নিপীড়নের অনেক ঘটনা ঘটে, তবে তা প্রকাশ করা হয় না। স্কুল-কলেজ পরিচালনাকারী কমিটি সেই ঘটনাগুলোকে ধামাচাপা দেয়। কেউ অভিযোগ করলে উল্টো তাকেই হয়রানির শিকার হতে হয়। ঢাকাসহ দেশের কোনো স্থানে স্কুল-কলেজে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে কোনো কমিটি নেই। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এ বিষয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও আশানুরূপ ফল আসছে না।

যৌন নিপীড়ন নির্মূলে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতামূলক কর্মসূচি বৃদ্ধি করা, সমাজের কাঠামোগত সংস্কার ও নারীদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনও জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কাঠামোগত সংস্কারের মধ্যে রয়েছে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনা, দারিদ্য দূরীকরণ, শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকরি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অসমতা কমিয়ে নারী-পুরুষের সমান প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা ইত্যাদি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সমাজ থেকে যৌন নিপীড়ন নির্মূল করার জন্য সচেতনতা অপরিহার্য। এ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জনসচেতনতা জরুরি। পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যত বেশি সচেতনতা তৈরি করা যাবে, যৌন হয়রানির মতো ঘটনা ততই দূর হবে। এজন্য সবাইকে তাদের নিজ নিজ অঙ্গন থেকে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে।

সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে যৌন নিপীড়ন বন্ধে ভিকটিমসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে তাদের ব্যবস্থাপনায় সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। যৌন নিপীড়ন দূর করতে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে কাজ করতে হবে। কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটলে চুপ না থেকে প্রতিবাদ করতে হবে। প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাতে হবে। যৌন নিপীড়নের সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হলে সমাজ থেকে এ অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব হবে।

বিশ্ব যৌন নিপীড়নবিরোধী দিবসের মূল উদ্দেশ্য হলো বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান যৌন নিপীড়ন সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া। বস্তুত সচেতনতা বাড়াতেই প্রতি বছর দিবসটি পালন করা হয়। যৌন নিপীড়ন একটি গুরুতর বিষয়, যা অবশ্যই প্রকাশ্যে আনতে হবে। এ সম্পর্কে খোলাখুলি কথা বলতে হবে। কারণ, এখনো পর্যন্ত এ বিষয়ে প্রায়ই কথা বলা হয় না এবং যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। বিষয়টিকে সামনে আনতে হবে তা হলো এর বিরুদ্ধে কথা বলা এবং যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারকে উৎসাহিত করা।

লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
যৌন নিপীড়ন,নির্মূলে জনসচেতনতা জরুরি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close