আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

  ১১ আগস্ট, ২০২২

ইসলামের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা

বঙ্গবন্ধু

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসে যে নামটি সূর্যের মতো জ¦লজ¦ল করছে, যে নাম আজও পদ্মা-মেঘনার মতো কোটি কোটি হৃদয়ে বহমান, সে নামটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিব একটি নাম, একটি ইতিহাস। যে ইতিহাস বাঙালিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখিয়েছে। সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে শিখিয়েছে। দিয়েছে স্বাধীনতার স্বাদ। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বলেই আল্লাহর রহমতে বাংলার সর্বস্তরের জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন। পাকিস্তানিদের হাত থেকে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। তার অভাবনীয় রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও নেতৃত্বগুণেই আমরা এ স্বাধীন ভূখ- পেয়েছি। পেয়েছি একটি লাল সবুজের পতাকা।

বঙ্গবন্ধু শুধু রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও নেতৃত্বের গুণেই বলিয়ান ছিলেন না, ছিলেন একজন আদর্শ ইসলামি নেতাও। ইসলামপ্রীতি ছিল তার শিরায় শিরায়। তার ইসলামপ্রীতির অসংখ্য কীর্তিই এ কথা প্রমাণ করে যে, তিনি ছিলেন একজন আপাদমস্তুক খাঁটি মুসলিম। তিনি বাংলাদেশে ইসলামের প্রচার-প্রসার ও ইসলামি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা এবং বিশে^র বিভিন্ন মুসলিম দেশ ও নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক বিনির্মাণে যে অসামান্য অবদান রেখেছেন, তার তুলনা হয় না। তিনি ইসলামি গবেষণা সংস্থা হিসেবে ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। পুনর্গঠিত করেন বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড।

বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে পবিত্র কোরআনের তিলাওয়াত এবং বাংলা তরজমা প্রচারের উদ্যোগও করা হয় তারই নির্দেশনায়। শুধু কি তাই? হজযাত্রীদের জন্য ‘ভ্রমণকর’ রহিত করা, তাবলিগ-জামাতের কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় কাকরাইল মসজিদের জন্য অতিরিক্ত জমি বরাদ্দ দেওয়া, বিশ^ ইজতেমা সুন্দর ও সফলভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ার জন্য টঙ্গীতে আলাদা স্থানও নির্ধারণ করে দিয়েছেন ইসলামপ্রিয় এই মহান মানুষটি।

এত এত ভালো কাজের পরও কিছু মানুষ তার শত্রুতে পরিণত হয়। আর হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর কি শত্রু কম ছিল? ভালো কাজে শয়তান চুপ করে থাকে না। বঙ্গবন্ধুর বেলাতেও তারা চুপ করে থাকতে পারেনি। তার দেশপ্রেম এবং কল্যাণকর কাজগুলোই যেন ওদের গাত্রদাহের কারণ হয়ে উঠেছিল। সদ্য স্বাধীন যুদ্ববিধ্বস্ত দেশে বঙ্গবন্ধু যখন বাঙালিদের নিয়ে সোনার বাংলাদেশ গড়ার কাজে নিয়োজিত হলেন, তখন স্বাধীনতাবিরোধী এই শয়তানরা বঙ্গবন্ধুর পেছনে লাগে। কীভাবে বঙ্গবন্ধুকে মানুষের মন থেকে মুছে ফেলা যায়, দিন-রাত শুধু সে পরিকল্পনায় মেতে থাকে। সর্বশেষ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

দেশকে ভালোবাসার কারণে, দেশের মানুষের মঙ্গল চাওয়ায় যে মানুষটিকে অসংখ্যবার কারাবরণ করতে হয়েছিল, কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসেও যে মানুষটি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতেন। হৃদয়ে আঁকতেন প্রিয় মাতৃভূমির ছবি। সেই মাতৃভূমিরই কিছু কুলাঙ্গার সন্তান তাকে সপরিবারে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দিল। ওরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, বঙ্গবন্ধুর নামটি ইতিহাস থেকে মুছে ফেলারও চেষ্টা করেছিল। এমনকি বঙ্গবন্ধুর লাশকেও তাদের অমানবিক আচরণ থেকে রেহায় দেয়নি। এদেরই কারণে একজন মহামান্য রাষ্ট্রপতির শেষ গোসল করাতে হয়েছে ৫৭০ সাবান আর দাফন করতে হয়েছে রেড ক্রিসেন্টের রিলিফের কাপড় দিয়ে। টুঙ্গিপাড়ার আকাশে সেদিন যে শোকের ছায়া নেমেছিল, সে শোকের চাপা কান্না প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে আছড়ে পড়লেও তাদের কিছুই করার ছিল না। সেনাবাহিনীর রক্তচুক্ষুকে উপেক্ষা করে তারা সেদিন বঙ্গবন্ধুর জানাজাতেও অংশগ্রহণ করতে পারেননি। ঘাতকরা সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে অসৌজন্যতা দেখিয়ে হয় তো ভেবেছিল, তারা সফল হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ যাকে সম্মানিত করেন, তাকে অপমানিত করবে সাধ্য কার? পবিত্র কোরআনে তো বলাই আছে, আল্লাহ ‘যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করেন, আর যাকে ইচ্ছা অপমান করেন।’ (সুরা আল ইমরান, আয়াত : ২৬)

বঙ্গবন্ধুর আজকের আকাশচুম্বী সম্মান যেন পবিত্র এই আয়াতেরই বহিঃপ্রকাশ। সেদিন যারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে ভেবেছিল, বাংলাদেশের মানুষের মন থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলেছে, তাদের সেই ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে আল্লাহতায়ালা বঙ্গবন্ধুকে আজ পুরো বিশে^ সূর্যের মতো আলোকিত করে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু আজ পুরো পৃথিবীতে স্বীকৃত, সমাদৃত। সেদিন যারা বাংলার মানুষকে বঙ্গবন্ধুর জানাজায় অংশগ্রহণ করতে দেয়নি, আজ তারা এবং তাদের উত্তরসূরিরা বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারত করছে, দোয়া মাহফিলে হাত তুলে মোনাজাত করছে। অন্তর থেকে না চাইলেও কোনো না কোনো কারণে বাধ্য হয়ে করছে। আসলে এই বাধ্য হওয়াটাই আল্লাহর ফয়সালা।

আল্লাহর এই ফয়সালায় বঙ্গবন্ধুর খুনিরা অসন্তোষ হওয়াটা স্বাভাবিক, কিন্তু আমরা যারা আলেম, সত্যের ধারক ও বাহক, তারা কী করে অসন্তেুাষ হই? দুঃখজনক হলেও সত্য, এখনো অনেক আলেম-ওলামা আছেন, যারা বঙ্গবন্ধুকে নেতা হিসেবে মেনে নিচ্ছেন না। আমি অনেক ইমাম ও খতিবদের দেখেছি, যারা বঙ্গবন্ধুর নাম শুনলে মুখ কালো করে ফেলেন। কেন এমন করেন? বঙ্গবন্ধু কী তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা বন্ধ করেননি? নিষিদ্ধ করেননি প্রকাশ্যে মদ-জুয়ার মতো সব রকমের পাপাচার? আন্তর্জাতিক ইসলামি সংস্থা ‘ওআইসি’তে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভ হয় কার অবদানে? নিশ্চয় বঙ্গবন্ধুর। তারই ইচ্ছায় ধর্ম মন্ত্রণালয় গঠিত হয়।

আসলে তিনি তো বাংলাদেশকে ইসলামের নীতি ও আদর্শেই সাজাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঘাতকরা সে সুযোগটি দিল না। আহা! তিনি যদি আজ বেঁচে থাকতেন, তাহলে বাংলাদেশ সত্যিই সোনার দেশে পরিণত হতো। এ দেশের বাতাসে আর লাশের গন্ধ ভাসত না। ফিরে আসত খোলাফায়ে রাশেদার দিন। বঙ্গবন্ধু প্রায়ই বলতেন, ‘এ মাটিতে ধর্মহীনতা নেই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে।’ এটাই তো ইসলামের আদর্শ। বঙ্গবন্ধু এ আদর্শই বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন। কারণ তিনি ছিলেন ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। ন্যায়পরায়ণ শাসক। আমাদের কী উচিত নয়, এমন একজন ন্যায়পরায়ণ শাসককে মন থেকে সম্মান করা? হাদিসে তো এ কথাই বলা হয়েছে, ‘কোরআনের ধারক-বাহক ও ন্যায়পরায়ণ শাসকের প্রতি সম্মান দেখানো মহান আল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অন্তর্ভুক্ত।’ (আবু দাউদ শরিফ, হাদিস : ৪৮৪৩)

যেসব আলেম এখনো বঙ্গবন্ধুর নাম শুনলে নাক সিটকান, তারা সম্ভব তো পূর্বসূরি আলেমদের সোহবত বা জীবন থেকে গাফেল। তারা যদি একটিবার বঙ্গবন্ধুর ধর্মময় জীবনের দিকে তাকান, তাহলে স্পষ্ট দেখতে পাবেন, বঙ্গবন্ধুকে স্নেহের ছায়ায় আগলে রেখেছেন, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ)-এর মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম ওলামারা।

বঙ্গবন্ধুর গায়ের কালো কোটের ইতিহাস কে না জানে? আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ) নিজ গা থেকে কোটটি খুলে বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে বলেছিলেন, ‘গায়ে দাও তো নাতি, দেখি তোমাকে কেমন লাগে?’ কোট পরার পর তিনি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘দারুণ লাগছে তো নেতাকে। এখন তোমাকে সত্যিকারের জাতীয় নেতা মনে হচ্ছে।’

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল, বড় হয়ে তিনি মাওলানা তর্কবাগীশ হবেন। আদর্শ নেতা হিসেবে তর্কবাগীশের ছবি যে তার হৃদয়পটে আঁকা হয়েছিল। এই যে এত এত আলেমে দ্বীন বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসেছেন, স্নেহের ছায়ায় আগলে রেখেছেন, তারা নিশ্চয় আমাদের চেয়ে ভালো বুঝতেন। দীনের জন্য, দেশের জন্য তাদের দরদ আমাদের চেয়ে কোনো অংশেই কম ছিল না। তারা যদি বঙ্গবন্ধুকে এতটা ভালোবাসতে পারেন, তাহলে আমরা কেন নয়?

জাতির ভাবনায় বঙ্গবন্ধু একজন খাঁটি মুসলিম নেতা। ন্যায়পরায়ণ শাসক। ইসলামসহ তিনি অন্য সব ধর্মের প্রতি যে শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন, তা আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.)-এর নির্দেশেরই অনুসরণ। এই ন্যায়পরায়ণ শাসককে যারা হত্যা করে বাংলাদেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসারকে ব্যহত করেছে, নিঃসন্দেহে তারা খোদার দুশমন। তাই আসুন! এই দুশমনদের প্রতিহত করি এবং বঙ্গবন্ধুকে একজন খাঁটি মুসলিম নেতা ও ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে সম্মান করি। তাহলে আল্লাহও আমাদের সম্মানকে বাড়িয়ে দেবেন।

লেখক : খতিব, কসবা জামে মসজিদ রেলস্টেশন রোড, কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা,ইসলাম
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close