প্রতীক ইজাজ

  ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭

যাবজ্জীবন সাজা মানে ৩০ বছর, নাকি আমৃত্যু কারাবাস

প্রধান বিচারপতির দিকে তাকিয়ে সবাই

যাবজ্জীবন সাজার মেয়াদ নিয়ে আইনের অস্পষ্টতা কাটছে না। একদিকে প্রশ্ন উঠেছে যাবজ্জীবন মানে ৩০ বছর, নাকি আমৃত্যু কারাবাস; তেমনি এমন দ্বিধাও দেখা দিয়েছে ‘যাবজ্জীবন’ ও ‘আমৃত্যু কারাদ-’ একই বিষয়, নাকি দুই রকম। এমনকি যাবজ্জীবন সাজার মেয়াদ সব ধরনের আসামির ক্ষেত্রে সমান প্রযোজ্য কি না তা নিয়েও মতানৈক্য দেখা দিয়েছে। ফলে এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। একমত হতে পারছেন না আইনজ্ঞরাও।

এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক চলছে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ যাবজ্জীবন অর্থ আমৃত্যু কারাবাস বললে বিষয়টি আবার নতুন করে আলোচনায় আসে। সেদিন একটি হত্যা মামলার পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ জানান, যাবজ্জীবন সাজা মানে আমৃত্যু কারাবাস। ২০০১ সালে সাভারে জামান নামের এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ২০০৩ সালে বিচারিক আদালত তিনজনের ফাঁসির রায় দেন। তারা হলেনÑ আতাউর, আনোয়ার ও কামরুল। আসামিদের মধ্যে কামরুল পলাতক। পরে আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের

শুনানি শেষে হাইকোর্টও তাদের মৃত্যুদন্ড বহাল রাখেন। ওই মামলায় আপিল বিভাগ তিনজন মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামির সাজা পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন এবং বলেন, যাবজ্জীবন মানে ৩০ বছর নয়, আমৃত্যু কারাবাস। আসামিদের স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কারাভোগ করতে হবে। এই রায়ের পর নতুন করে বিতর্ক দেখা দেয়।

এর আগে গত বছরের ২৬ জুন বিষয়টি নিয়ে ‘বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে’ জানিয়ে পরিষ্কার করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। সেদিন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার পরিরদর্শনের সময় এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, যাবজ্জীবন কারাদ-ের অর্থ হচ্ছে দন্ডিত ব্যক্তিকে মৃত্যু পর্যন্ত কারাগারে থাকতে হবে। যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত আসামি বলতে আপনারা মনে করেন ৩০ বছর। ধরে নেয়, সব জায়গায়। প্রকৃতপক্ষে এটার অপব্যাখ্যা হচ্ছে। যাবজ্জীবন অর্থ হলো একেবারে যাবজ্জীবন, রেস্ট অফ দ্য লাইফ (জীবনের বাকি সময় পর্যন্ত)। তবে যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত আসামি জেলখাটার সময় রেয়াত পেলেও সেটা কোনোমতেই ৩০ বছরের কম হয় না। ব্রিটিশ আমলে কারাগারগুলোতে যাবজ্জীবনের প্রশ্ন ছিল না। তখন একেবারে দ্বীপান্তর করা হতো। আমাদের জেল কোড অনেক পুরাতন। এটা নিয়ে ব্রিটিশ আমলে অনেক জগাখিচুড়ি হয়েছে।

প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের যাবজ্জীবন কারাদন্ড নিয়ে এমন তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে আইনজ্ঞদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্ত মত এসেছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ প্রধান বিচারপতির পক্ষে মত দিয়েছেন। কেউ বলছেন ভিন্ন কথা। তবে সবাই এ ব্যাপারে আইনের অস্পষ্টতার কথা বলেছেন এবং আইন সংশোধনের পক্ষে মত দিয়েছেন। একই সঙ্গে জামাল হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার অপেক্ষায়ও রয়েছেন তারা।

প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের সঙ্গে একমত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, পেনাল কোড (দ-বিধি) ও জেল কোড (কারাবিধি) একসঙ্গে মিলিয়ে পড়লে দেখা যায়, যাবজ্জীবন কারাদন্ড আসলে ৩০ বছর নয়, স্বাভাবিক মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কারাদন্ড। তবে তিনি এ কথাও বলেন, যাবজ্জীবন কারাদন্ডের মেয়াদ কত দিন হবে তার সুরাহা হওয়া দরকার। আশা করছি প্রধান বিচারপতি জামাল হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ে এটা সিদ্ধান্ত দেবেন। যুক্তি দিয়ে, আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে উনি এটা নিষ্পত্তি করবেন। প্রয়োজন হলে যদি আইন সংশোধন করতে হয়, তবুও করা উচিত।

কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনি বলেন, দন্ডবিধির ৫৭ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, ‘দ-ের মেয়াদসমূহের ভগ্নাংশসমূহের হিসাব করার ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাদন্ডকে ৩০ বছর কারাদ-ের সমান বলা হবে’। সুতরাং, যাবজ্জীবন কারাদ- গণনা করা হবে ৩০ বছর। এর বিকল্প কিছু করতে গেলে আইনের পরিবর্তন করতে হবে। স্বাধীনতার আগে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের মেয়াদ ধরা হতো ১৪ বছর। স্বাধীনতার পর যাবজ্জীবন কারাদ- করা হয় ২০ বছর। ১৯৮৫ সালে এরশাদ সরকারের আমলে আইন পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদন্ড করা হয় ৩০ বছর। তাই আইন পরিবর্তন না করে যাবজ্জীবন কারাদন্ডকে আমৃত্যু কারাদন্ড হিসেবে কার্যকর করা সম্ভব নয়।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, ইংরেজিতে যেটা বলা হয় ইমপ্রিজনমেন্ট ফর লাইফ, বাংলায় তাকে বলে যাবজ্জীবন কারাদন্ড। আক্ষরিক অর্থ ধরা হলে আজীবনের জন্য কারাগারে থাকতে হবে। আর দ-বিধি অনুসারে যাবজ্জীবন কারাদন্ড মানে ৩০ বছর, এটা প্র্যাকটিস। এখন যদি এটা নিয়ে কোনো বিতর্ক ওঠে কিংবা ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়, তাহলে সেই ব্যাখ্যা দেওয়ার একমাত্র ক্ষমতা সর্বোচ্চ আদালতের। যদি এই প্রশ্ন আপিল বিভাগের সামনে যায়, আদালতই ঠিক করে দেবেন আসলে কোনটা সঠিক। বর্তমানে যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ৩০ বছর মেয়াদেই সাজা খাটছেন। এর প্রথম ব্যত্যয় দেখা দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলোর রায় দেওয়া শুরু হলে। একাধিক রায়ে দেখা গেছে, বিচারকরা ‘আমৃত্যু কারাদ-’ ভোগের সাজা দিয়েছেন।

আবার আইনমন্ত্রী ও ফৌজদারি আইনজ্ঞ অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলছেন, লাইফ ইমপ্রিজনমেন্ট মানে আমৃত্যু কারাবাস। ৩০ বছর শুধু সময় গণনার জন্য দেওয়া হয়। লাইফ ইমপ্রিজনমেন্ট মানে কিন্তু আসলেই আমৃত্যু। ৩০ বছর সাজা খাটার পর একজন যদি তার কন্ডাক্ট (আচরণ) এ ছাড়া পাওয়ার যোগ্য হয়, তখন তাকে এই ৩০ বছর যেহেতু খাটা হয়েছে, তখন তাকে সেই বিবেচনায় ছেড়ে দেওয়া হয়।

এর আগে ২০১৪ সালে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিলের রায়ের সময়ও একই বিতর্ক উঠেছিল। এ ব্যাপারে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, সাঈদীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আপিলের রায়ে যেন যাবজ্জীবন কারাদন্ড নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি তৈরি না হয়, সে জন্য আদালত সুনির্দিষ্টভাবে আমৃত্যু কারাদন্ডের কথা উল্লেখ করে দিয়েছেন। ওই রায়ে আপিল বিভাগ যাবজ্জীবন কারাদন্ড নিয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইন সংশোধন করে যাবজ্জীবন কারাদন্ডকে স্বাভাবিক মৃত্যু পর্যন্ত কারাদন্ড হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে দন্ডবিধি ও কারাবিধি এখনো সংশোধন করা হয়নি। তবে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনে দন্ডবিধি প্রযোজ্য নয়। এ জন্য যুদ্ধাপরাধের মামলার রায়ে আলাদাভাবে আমৃত্যু কারাদন্ডাদেশ উল্লেখ করে দিয়েছেন। কিন্তু ওই আইন সাধারণভাবে প্রযোজ্য হতে পারে না।

এ বিতর্ক নিরসনে সমাধান কি জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ফৌজদারি আইনজ্ঞ শ ম রেজাউল করিম বলেন, প্রধান বিচারপতি আনুষ্ঠানিকভাবে রায় প্রদান করলে এর সমাধান হবে। উনি কি রায় দেবেন, সেটার ওপর নির্ভর করবে যাবজ্জীবন কারাদ- আসলে কি হবে। এর আগে মত দেওয়া যথার্থ হবে না।

‘তবে পেনাল কোডের দন্ডবিধির ৫৭ ধারা অনুযায়ী এখনো যাবজ্জীবন কারাদন্ড ৩০ বছর। এর বাইরে অন্যকিছুর আইনগতভিত্তি আছে বলে মনে হয় না’- উল্লেখ করেন এই আইনজ্ঞ। শ ম রেজাউল করিম বলেন, সুতরাং, ওনার (প্রধান বিচারপতি) রায়ের ওপর সব নির্ভর করছে। সেটার ওপরই নির্ভর করছে আইন সংশোধন করতে হবে কি না।

পিডিএসও/মুস্তাফিজ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist