প্রতীক ইজাজ

  ২২ অক্টোবর, ২০১৭

জলবায়ু পরিবর্তনে বিরূপ প্রকৃতি

বর্ষা ঋতু বিদায় নিয়েছে দুই মাস আগেই। শরৎ শেষ। এখন হেমন্ত চলছে। অথচ ভারী বৃষ্টিপাত এই হেমন্তে ভরা বর্ষাকেও হার মানিয়েছে। গত দুদিনে (শুক্র ও শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত) রাজধানীতে ২৭৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এরমধ্যে শনিবার হয়েছে ২২৩ মিলিমিটার। এরআগে বর্ষার শুরুতে গত ১২-১৩ জুন ২৪ ঘণ্টায় ১৩৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় ঢাকায়। ১৩ জুলাই ১০৩ মিলিমিটারের রেকর্ড বৃষ্টি হয়। পরের মাস গত ৪ আগস্ট ঢাকায় তিন ঘণ্টায় ১২৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। ওই বৃষ্টি ছিল স্বল্প সময়ের বিবেচনায় গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।

এরআগে ২০০৬ সালের জুলাই মাসে ঢাকায় তিন ঘণ্টায় ৯৬ মিলিমিটার বৃষ্টির রেকর্ড ছিল। কেবল ভারী বৃষ্টিপাত নয়, এ বছর এপ্রিল ও মে মাসে মারুথা ও মোরা নামে দুটি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। এর বাইরে নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে বেশ কয়েকবার। তার মধ্যে দুই দফা নিম্নচাপে প্রবল বর্ষণে পাহাড়ে ভূমিধসে মৃত্যু হয় দেড় শতাধিক মানুষের। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আগাম বন্যায় বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে এবার। বর্ষা মৌসুমের শুরুতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমের মানুষকেও ভুগতে হয়েছে। বিশেষ করে গত জুলাই-আগস্টে হাওড় অঞ্চলে অকস্মাৎ বন্যা এবং ভারী বর্ষণে পানিতে তলিয়ে যায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম। সেইসঙ্গে বজ্রপাতে মৃত্যুর খবর গত বছর তিনেক ধরেই বেড়ে গেছে।

এমনকি অক্টোবরের শুরুতেই টানা চার-পাঁচ দিন রাজধানীসহ দেশের বেশিরভাগ এলাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪ থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠানামা করেছে। সাধারণত গ্রীষ্মে এ ধরনের গরম অনুভূত হলেও এবার সেপ্টেম্বরের শরতে একটি বড় সময় ধরে প্রায় গ্রীষ্মের গরম অনুভূত হয়েছে।

কেবল এ বছরই নয়, দেশে হঠাৎ করেই বদলে যাওয়া আবহাওয়ার এমন বৈরী আচরণ চলছে গত ৩০ বছর ধরেই। ভারী বৃষ্টিপাত ও মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রা তো বটেই, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস, অস্বাভাবিক মাত্রায় বজ্রপাত, অতি ভারী বর্ষণ, আকস্মিক বন্যা, ভূমিধসের মতো একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন পেয়ে বসেছে বাংলাদেশকে। এর ফলে দেশে খাদ্য উৎপাদন কমে যাচ্ছে, নতুন নতুন দুর্যোগ বাড়ছে, রোগবালাইয়ের প্রকোপ দেখা দিচ্ছে আর বিপুলসংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুতও হচ্ছে।

কিন্তু আবহাওয়ার কেন এমন বদলে যাওয়া এবং এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগই বা কেন—জানতে চাইলে গবেষকরা একে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হিসেবে দেখছেন। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মনুষ্যসৃষ্ট আচরণ ও পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খেয়ে চলতে না পারাকেও দায়ী করেছেন তারা।

এ ব্যাপারে নগর ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের জন্য অন্তত ৫০ বছরের তথ্য পর্যালোচনা করতে হবে। প্রকৃতির এই বৈরী আচরণকে হুট করেই ‘জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব’ বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে না। কিছু প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ঠিকই, কিন্তু সবক্ষেত্রে নয়। সে সময় বাংলাদেশে ঠিক আসেনি এখনো। দেশে যেসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে, এর বেশিরভাগই মনুষ্যসৃষ্ট। ভারী বৃষ্টিপাত হবে। কিন্তু তা থেকে যে জলাবদ্ধতা, সেটা হচ্ছে পানি ও বর্জ্য নিষ্কাশন না থাকায়। শহর ডুবে যাচ্ছে। নভেম্বর ও ডিসেম্বরের শেষের দিকেও নি¤œচাপ দেখা দিতে পারে। তা থেকে বৃষ্টিপাত হবে। কিন্তু সে পানি কেন সরবে না? জলাবদ্ধতা কেন হবে? কারণ মিরপুর থেকে কল্যাণপুর পর্যন্ত যে খাল, সেটা দখল হয়ে গেছে। আমরা পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারছি না। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে অপরিকল্পিত আবাসন গড়ছি। সড়ক নির্মাণ করছি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় জোর দিচ্ছি না। গ্রীষ্মে তাপমাত্রা থাকবে। কিন্তু উচ্চ তাপমাত্রা হচ্ছে গাছপালা কমে যাওয়ার কারণে। রাজধানীতে রমনা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং হাতিরঝিল ছাড়া কোথাও খোলা জায়গা নেই, সবুজ নেই। গাছ লাগাচ্ছি না। কেটে ফেলছি। ফলে বদলে যাচ্ছে আবহাওয়া। এসবই হচ্ছে মানুষের কারণে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পরিবেশ ও উৎস ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও ভূগোল বিভাগ পৃথক পৃথক গবেষণায় বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কিছু প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে শুরু করেছে বলে জানিয়েছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, গত ৩০ বছরে বাংলাদেশ ১৮৫ বার চরম বৈরী আবহাওয়ার কবলে পড়েছে, যা বিশ্বে তৃতীয় সর্বোচ্চ। দুই বছর আগেও বিশ্বে বিরূপ আবহাওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি আর্থিক ক্ষতির মুখে থাকা দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল চতুর্থ। আর বৈরী আবহাওয়ার কারণে মানুষের মৃত্যু হওয়ার দিক থেকে তৃতীয় দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ।

আন্তর্জাতিক ও দেশের বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে অসময়ের বৃষ্টির কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। একই কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গড় তাপমাত্রা বাড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে এই শতকের মধ্যে তাপমাত্রা গড়ে দেড় থেকে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। এর ফলে বছরে বোরো ও আমন ধানের উৎপাদন ১০ শতাংশ কমে যেতে পারে। প্রায় ৪০ লাখ টন খাদ্য উৎপাদন কমতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই শতকের মধ্যে দেশের ১৯টি জেলার প্রায় ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে। এর ফলে প্রায় দুই কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে। লবণাক্ত এলাকা দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে। লবণাক্ততা আরো বাড়ছে। নতুন করে বজ্রপাতে মৃত্যু বাড়ছে। এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত মারা গেছে ১৭০ জন। গত সাত বছরে মৃত্যু হয়েছে ১ হাজার ৭৬০ জনের। এ বছর ব্রহ্মপুত্র নদের উজানে ১০০ বছরের মধ্যে বড় বন্যার রেকর্ড বৃষ্টি হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে বেশি বেশি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হচ্ছে। আর তা সবচেয়ে বেশি আঘাত হানছে বাংলাদেশে। ১৯৭১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতি চার থেকে পাঁচ বছর পরপর বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানত। ২০০৭ সালের পর প্রতি দুই বছর পরপর দেশে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানছে।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক আখতার হোসেন খান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী। কিন্তু ঢাকায় আবহাওয়ার বৈরী আচরণের জন্য দায়ী অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও যানবাহন। তা ছাড়া শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র (এসি) ব্যবহার বেড়ে গেছে। এসি ব্যবহারের ফলে কক্ষের ভেতর ঠান্ডা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বাইরে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এটি কমাতে হবে। গাছপালা কমে যাচ্ছে। একটি আদর্শ নগরীতে ২৫ শতাংশ এলাকাজুড়ে গাছপালা, পার্ক, আদর্শ ছায়াযুক্ত স্থান থাকতে হবে। কিন্তু ঢাকায় পাঁচ শতাংশও ছায়াশীতল স্থান নেই। একই অবস্থা গোটা দেশে। আমরাই পরিবেশকে নষ্ট করছি। পরিবর্তিত জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবের দিকে দেশকে ঠেলে দিচ্ছি। জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবিলা করতে হলে আমাদের আইনের শাসনের সঙ্গে বিজ্ঞান ও মানুষের হাজার বছরের অভিজ্ঞতাকে সঙ্গী করে পরিকল্পনা করতে হবে।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ব্রাজিল, ভারত, রাশিয়া তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কার্বন নিঃসরণ কমাচ্ছে না, বরং বাড়াচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। তারা আরো বলছেন, প্রতিনিয়তই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে। এর প্রভাবে আগে যেসব জায়গায় জোয়ারের পানি উঠত না, সেসব অঞ্চল এখন প্লাবিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নাম সবার শীর্ষে।

পরিবর্তিত জলবায়ু থেকে সৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশ কতটুকু প্রস্তুত এবং কেনই বা এমন দুর্যোগের মুখে বারবার পড়ছে বাংলাদেশ-জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ রিয়াজ আহম্মেদ বলেন, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। আমরা অনেক দেশের কাছেই এখন মডেল। তবে দুর্যোগ মোকাবেলায় আরো গবেষণা দরকার। কেন জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু কতটা, সেটার গবেষণা লাগবে। কারণ এবার হাওরে যে অকস্মাৎ বন্যা, সেটা গত ৫০-৬০ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম এত আগে হলো। একই কারণে পাহাড় ধসছে। প্রাকৃতিক সবুজ কমে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের যেসব বহির্প্রকাশ, সেগুলো জানতে গবেষণা দরকার। তবে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ বাড়ছে। এমনিতেই বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ দেশ। দুর্যোগের স্বরূপ জানতে হবে। দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতি রাখতে হবে ব্যক্তি পর্যায় পর্যন্ত। তবেই দুর্যোগ থেকে রক্ষা সম্ভব।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আক্তার মাহমুদের মতে, প্রাকৃতিকভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুতি বাংলাদেশের নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ ছোট দেশ। মানুষ বেশি। প্রত্যেক দুর্যোগ মোকাবিলায় আলাদা কাঠামো দরকার। নদী, পাহাড়, বনভূমিসহ যেসব প্রাকৃতিক অঞ্চল রয়েছে, সেগুলোর প্রাকৃতিক অবস্থা ধরে রাখতে হবে। জাতীয় ভৌত পরিকল্পনা ও কাঠামো দরকার। সে অনুযায়ী প্রাকৃতিকে সংরক্ষণ করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জলবায়ু পরিবর্তন,পরিবেশ,দুর্যোগ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist