হাসান শান্তনু

  ১৮ অক্টোবর, ২০১৭

লোভনীয় পদ ছেড়ে ফিরছেন না মূল পেশায় । শাস্তির তালিকায় থেকেও পদোন্নতি

শিক্ষকতা ছেড়ে শিক্ষা কর্মকর্তা

সরকারি কলেজের একশ্রেণির শিক্ষকের মূল লক্ষ্য শিক্ষা কর্মকর্তা হওয়া। মাত্র তিন বছরের জন্য প্রেষণে শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে আর ফিরে আসতে চাইছেন না শিক্ষকতা পেশায়। অনেকে যুগের পর যুগ ধরে আঁকড়ে আছেন কর্মকর্তা হিসেবে। ‘লোভনীয়’ পদ ছাড়তে চাইছেন না। কর্মকর্তা হয়ে নিচ্ছেন বাড়তি সুবিধা। নৈতিক ও অনৈতিক সুবিধাসহ সাধারণ শিক্ষকদের জিম্মি করার ক্ষমতা ভোগ করছেন। অনেকে কোটিপতি ও গাড়ি-বাড়ির মালিক হওয়ার সুযোগকেও কাজে লাগাচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হয়ে নিজেরাই ভঙ্গ করেন সরকারি নীতিমালা। তদ্বিরের মাধ্যমে শতাধিক শিক্ষক এভাবে শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে যুক্ত আছেন। দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনে শিকড় গেড়ে বসা এসব কর্মকর্তা নানা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। অনেকের বিষয়ে অভিযোগ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও। এ ছাড়া শিক্ষক সংকটে সরকারি কলেজে পাঠদান ব্যাহত হলেও এসব কর্মকর্তাকে মূল কর্মস্থল শিক্ষকতায় ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো উদ্যোগই কার্যকর হচ্ছে না।

শিক্ষক থেকে কর্মকর্তা হয়ে একের পর পদোন্নতিও তারা পাচ্ছেন সহজে। অনিয়ম, দুর্নীতি ও দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতার অভিযোগ থাকলেও কারো শাস্তি হয় না। এমনকি তদন্তও হয় না। বিশেষ পরিস্থিতিতে পুরোনো কর্মস্থল সরকারি কলেজে ‘শাস্তিমূলক বদলি’ করা হলেও তারা নানা কৌশল খাটিয়ে আবার ঢাকায় চলে আসছেন কর্মকর্তা হয়ে। যুক্ত হচ্ছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি), ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষাসহ বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি), পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরসহ (ডিআইএ) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। তদ্বিরের মাধ্যমে গত ১০ বছরে অন্তত ৬০ জন শিক্ষকতা ছেড়ে এভাবে কর্মকর্তা হয়েছেন। ফলে সরকারি কলেজে শিক্ষক সংকট তীব্রতর হচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন পদে সাধারণত প্রেষণে আসেন সরকারি কলেজের শিক্ষকরা। সরকারি চাকরির বিধিমালা অনুযায়ী তারা তিন বছরের জন্য আসেন। তিন বছর পর তাদের অন্যত্র বদলি হওয়ার বিধান আছে। বিদ্যমান নীতিমালা অমান্য করে তারা শিক্ষা কর্মকর্তা হওয়ার পর থেকে শ্রেণিকক্ষে পাঠ দেওয়া কার্যক্রমের বাইরে থাকেন। তাদের শিক্ষকতার সঙ্গে আর যুক্ত করতে পারছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বদলি করে কলেজে পাঠানো হলেও তদ্বিরের জোরে দু-এক মাসের মধ্যেই আবার কলেজ ছাড়েন। অথচ শিক্ষক হিসেবেই তারা নিয়োগ পেয়েছিলেন।

জানতে চাইলে মাউশির মহাপরিচালক এসএম ওয়াহিদুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘শিক্ষক হিসেবে কেউ নিয়োগ পেলে তার শিক্ষকতায় যুক্ত থাকা উচিত। কর্মকর্তা হয়ে শিক্ষকতায় আর ফিরে না যাওয়ার বিষয়টিতে সমর্থন করা যায় না। তা ছাড়া শিক্ষকদের দীর্ঘদিন শিক্ষকতার বাইরে থাকা ঠিক নয়। শিক্ষকতার বাইরে অনেক দিন ধরে থাকলে পাঠদানের চর্চাও কমে যেতে পারে।’

জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘কলেজে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের অবশ্যই সংকট আছে। অনেকে শিক্ষকতা ছেড়ে কর্মকর্তা হওয়ায় সংকট আরো বাড়ছে। বিষয়টাতে সরকারের নজর দেওয়া দরকার। কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তা তদন্ত করে প্রমাণ হলে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। দক্ষ প্রশাসক যেমন দরকার, তেমনই দরকার দক্ষ শিক্ষক। শিক্ষা ক্যাডারের বাইরেও যারা প্রশাসনিকভাবে দক্ষ, তাদেরকেও শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নিতে পারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তখন শিক্ষকদের কর্মকর্তা হওয়ার প্রবণতা কমে আসবে।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শামসুল আলম প্রমাণিকের একান্ত সচিব ছিলেন এসএম কামাল উদ্দিন হায়দার। তখন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এখন তিনি মাউশির মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন শাখার উপপরিচালক। সরকারি একটি কলেজ থেকে ২০০৪ সালে ঢাকা বোর্ডে (মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বোর্ড) পদায়ন হয় তার। ২০১৩ সালে তিনি মাউশির সহকারী পরিচালক হন। আর ফিরে যাননি শিক্ষকতায়। মাউশির পরিকল্পনা শাখার উপপরিচালক এসএম বশির উল্লাহ এনসিটিবিতে ছিলেন ২০০২ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত। এরপর তিনি মাউশিতে আসেন। এ শিক্ষক চাকরি জীবনের ১৮ থেকে ২০ বছর ধরে শিক্ষকতার বাইরে আছেন। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত একটি সরকারি কলেজের কৃষিবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মদ আবুল কাশেম ২০০৫ সাল থেকে মাউশিতে আছেন আইন কর্মকর্তা হিসেবে। তিনি শিক্ষকতার বাইরে আছেন প্রায় সাড়ে আট বছর।

সূত্র জানায়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যবইয়ে ভুলের জের ও বিভিন্ন অনিয়মের কারণে গত ৬ এপ্রিল এনসিটিবি থেকে প্রতিষ্ঠানটির প্রাথমিক শিক্ষাক্রম বিভাগের সদস্য অধ্যাপক আবদুল মান্নানকে ঝিনাইদহের সরকারি কে সি কলেজে ‘শাস্তিমূলক বদলি’ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই দিন তিনিসহ ছয়জন শিক্ষা ক্যাডারকে এনসিটিবি থেকে বদলি করে মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী তখন বলেন, ‘দায়ীদের কারো কারো বিরুদ্ধে নোটিস দিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থাও (বিভাগীয় মামলা) নেওয়া হবে।’ তবে এখনো পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা না নিলেও উল্টো পদোন্নতি পাচ্ছেন আলোচিত কর্মকর্তা আবদুল মান্নান। তিনি মাউশির মাধ্যমিক শাখার পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। গত ২৪ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে এ তথ্য জানানো হয়। ছয় মাসেরও কম সময় শিক্ষকতায় যুক্ত থাকেন তিনি। শাস্তির তালিকায় থাকা এ শিক্ষক তদ্বিরের জোরেই আবার মাউশিতে এসেছেন বলে জানায় সূত্র।

তথ্যমতে, হবিগঞ্জের বৃন্দাবন সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ড. আবদুল মালেককে মাউশির প্রশিক্ষণ শাখার পরিচালকের দায়িত্ব দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আদেশ দেয় গত ২৪ সেপ্টেম্বর। এর আগে কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয় মাউশির প্রশিক্ষণ শাখার সহকারী পরিচালক মান্নান চৌধুরীকে। তিনি এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পরিচালক অধ্যাপক শফিকুল ইসলামের সঙ্গে অশালীন আচরণ করেন। এরপর স্বেচ্ছায় পরিচালকের পদ ছেড়ে মানিকগঞ্জের একটি কলেজের অধ্যক্ষ পদে বদলি হয়ে যান শফিকুল। দুই মাস যাবৎ প্রশিক্ষণ শাখার পরিচালক পদটি ফাঁকা থাকলে ড. আবদুল মান্নানকে এখানে পদায়ন করা হয়। তবে এখনো নোটিসের জবাব দেননি মান্নান চৌধুরী। শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে অশালীন আচরণের জন্য তার কিছু হয়নি। দুর্নীতি ও অনিয়ম করেও বহাল তবিয়তে আছেন ‘সাবেক’ এ শিক্ষক। সারা দেশের সরকারি কলেজে গণিতের শিক্ষকের হাহাকার হলেও গণিতে সহকারী অধ্যাপক মান্নান প্রশিক্ষণ শাখার সহকারী পরিচালক পদে রয়েছেন ২০১৩ সাল থেকে।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
শিক্ষকতা,বদলি,তদবির,শিক্ষা কর্মকর্তা,শিক্ষা মন্ত্রণালয়
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist