শফিকুল ইসলাম খোকন
পতাকার অবমূল্যায়ন কেন
যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশকে ভালোবাসো? উত্তর আসবে ‘হ্যাঁ’। যদি প্রশ্ন করা হয়, জাতীয় পতাকাকে ভালোবাসো? উত্তর আসবে ‘হ্যাঁ’। তেমনি যদি প্রশ্ন করা হয়, জাতীয় পতাকার আকার বা ব্যবহারের নিয়ম জানো? উত্তরে...? একজন স্বাধীনচেতা মানুষ তথা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তার দায়িত্ব রয়েছে তা পালনের। দায়িত্ব রয়েছে ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানা।
৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার যে স্বাধীনতা সূর্য অস্ত গিয়েছিল, তা একাত্তরের মার্চে আবারও উদিত হয়। বাঙালি পরাধীনতার শৃঙ্খল চ‚র্ণবিচ‚র্ণ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য স্বাধীনতার লড়াইয়ে শরিক হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সেদিন সমগ্র জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। এ ধরনের ঐক্য আমাদের জাতির সুদীর্ঘ ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। বিশ্বের ইতিহাসে অনন্য। আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমাদের স্বাধীনতা এনে দেয় নতুন চেতনা এবং মূল্যবোধ। যে জাতি মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে নিজের মাতৃভ‚মিকে স্বাধীন করে, সে জাতি কোনোদিন পিছিয়ে থাকতে পারে না। নতুন প্রজন্মের জন্য অপেক্ষা করছে নতুন দিন, এক সুখী-সমৃদ্ধ-উন্নত বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে ‘আর আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি, প্রতি ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’—এ আহ্বান জানিয়েছেন। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এই ডাক জাতির অসহযোগ আন্দোলনকে সশস্ত্র আন্দোলনের দিকে নিয়ে যায়। জনগণের অন্তরাত্মার প্রস্তুতি অনুভব করেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করার নৈতিক শক্তি পেয়েছিল বাঙালি জাতি।
আমি একজন নতুন প্রজন্মের নাগরিক। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, মুক্তিযুদ্ধ করিনি। তবে মুক্তিযুদ্ধ আমাকে কাঁদায়-হাসায়। সব সময় আমাকে ভাবিয়ে তোলে। যে জাতি জীবনের বিনিময় দেশ স¦াধীন করেছে, সে জাতি কখনোই হেরে যাওয়ার নয়; হারতে শেখেনি, হারতে পারেও না। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আমি শুনি। যতবারই শুনি ততবারই একটা মুগ্ধতা বিবেক তাড়িত করে। প্রশ্ন করে, ‘তুমি মুক্তিযুদ্ধ দেখনি, মুক্তিযুদ্ধ করনি কিন্তু যা দিয়ে গেছি, তা কি তুমি সংক্ষণ করেছ? সম্মান দিচ্ছ? নাকি সব পেয়ে ভুলে গেছ!’ বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বাঙালি জাতির জীবনে সোনালি দিন হচ্ছে ১৯৭১ সালের মার্চের অগ্নিঝরা দিন। নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম আর আন্দোলনের ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে একাত্তরের গৌরবময় দিনগুলো আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু আমরা কি সেই স্বাধীনতা নামক শব্দটি ভুলে যেতে বসেছি? আমর কি সেই লাল-সবুজের পতাকাকে সংরক্ষণ করছি? ইতিহাস ও ঐতিহ্য কি বুকে আগলে রেখছি? আমি একজন নতুন প্রজন্মের নাগরিক হিসেবে মনে করি, না পারিনি, পারছিও না। প্রশ্ন হচ্ছে দায়িত্ব কার? কে সংরক্ষণ করবে? নতুন প্রজন্মকে জানান দেওয়ার দায়িত্বই বা কাদের? সেই দায়িত্ববোধ থেকে কতটুকুই দায়িত্ব পালন করছি, নতুন প্রজন্মের মধ্যে কতটুকু ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছি!
একটি জাতীয় পতাকা একটি জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয়, স্বাধীনতা সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বীকৃতি। জাতীয় পতাকা হলো জাতির আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা এবং শহীদদের সম্মানের প্রতীক। জাতীয় পতাকা মাথা উঁচু করে বিশ্বের কাছে দেশকে পরিচিত করে। আমরা কি দেখছি, সেই জাতীয় পতাকাকে আমরা মূল্যায়নের চেয়ে অবমূল্যায়নই বেশি করছি। তার কারণ হতে পারে দুই রকম। একটি হলো, পাতাকার নিয়ম-কানুন না জেনে বা জেনেও না জানার ভান করে এড়িয়ে যাওয়া। আইনে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে। জাতীয় পতাকা বিধিমালা-১৯৭২ (সংশোধিত ২০১০)-এ বলা আছে, জাতীয় পতাকা গাঢ় সবুজ রঙের হবে এবং ১০:৬ ফুট দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের আয়তাকার সবুজ রঙের মাঝখানে একটি লাল বৃত্ত থাকবে। লাল বৃত্তটি পতাকার দৈর্ঘ্যরে এক-পঞ্চমাংশ ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট হবে এবং লাল বৃত্তটি ঠিক কোন অংশে থাকবে, সেটিও উল্লেখ করা আছে। আইনে পতাকার রং, ছোট গাড়ি, মাঝারি বা বড় গাড়িতে এর আয়তন সবই লেখার পাশাপাশি পতাকা উত্তোলনের বিষয়েও বলা আছে। ইচ্ছে করলেই যে কেউ গাড়িতে পতাকা ব্যবহার করতে পারবে না। বিধিমালার ৪-এর (১)-এ নিম্নবর্ণিত দিবস এবং উপলক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র সরকারি ও বেসরকারি ভবনসমূহে এবং বিদেশে অবস্থিত ক‚টনৈতিক মিশনের অফিস ও কনস্যুলার পোস্টসমূহে নিম্নরূপ পদ্ধতিতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করিতে হইবে : (ক) মহানবীর জন্ম দিবস (ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী); (খ) ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস; (গ) ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস ও (ঘ) সরকার কর্তৃক প্রজ্ঞাপিত অন্য যেকোনো দিবস।
১ (২)-এ নিম্নবর্ণিত দিবসসমূহে পতাকা’ অর্ধনমিত থাকিবে—(ক) ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস; (খ) ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস; এবং (গ) সরকার কর্তৃক প্রজ্ঞাপিত অন্য যেকোনো দিবস। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, অনেকই জায়গায়ই অসচেতনতার কারণে অনেক ব্যতিক্রম ঘটে। তবে এটি সত্য যে, জাতীয় পতাকা ব্যবহার রয়েছে সর্বোচ্চ প্রশংসনীয় পর্যায়, কিন্তু এ ক্ষেত্রে মনিটরিং, নিয়ম-বিধি মানা হচ্ছে না, মানতে দেখা যাচ্ছে না।
আইনের ৫ ধারায় বলা হয়েছে, জাতীয় পতাকার প্রতি অবমাননা প্রদর্শন করা বা জাতীয় পতাকার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন না করলে এক হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। ২০১০ সালের জুলাই মাসে এই আইন সংশোধিত হয়। এই সংশোধনীতে সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত শাস্তি এবং ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়। না জেনে, না বুঝে আর অতি উচ্ছ্বাসে যারা পতাকা ব্যবহারবিধি লঙ্ঘন করেন, তাদের অপরাধের মাত্রা বিবেচনা করে এই শাস্তির বিধান যথাযথ হতে পারে। তবে কোনো প্রতিষ্ঠান যদি বাণিজ্যিক কোনো প্রচারণায়, বিজ্ঞাপনে জাতীয় পতাকার ব্যবহার বিধিবহিভর্‚তভাবে করে থাকে, তার জন্য ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে, যাকে অনেকেই অপ্রতুল মনে করছেন। আইনে এত বিধি-বিধান থাকলেও বাস্তবে এর রূপ দেখা যায় না। দেখা যায় না তেমন কোনো শাস্তি দিতে। আমরা মনে করি, জাতীয় পতাকা ব্যবহারের নিয়মের বিষয় জনগণকে সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য সভা-সেমিনার করা উচিত। আইনটি সবার জানা দরকার এবং পতাকা আইন অনুযায়ী ব্যবহার হচ্ছে কি না, সেটি মনিটরিংও গুরুত্বপূর্ণ। যদি আমরা আমাদের আগামী প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে চাই তাহলে এসব ছোট ছোট বিষয়াদির ওপর নজর রাখা জাতি ও রাষ্ট্রের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। জাতি ও রাষ্ট্র তা পালন করবে এটাই প্রত্যাশা।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট [email protected]
পিডিএসও/হেলাল