ফারহান ইশরাক

  ১৭ আগস্ট, ২০২২

ই-বুক কি পারবে বইয়ের বিকল্প হতে

বইকে বলা হয়ে থাকে মানুষের সবচেয়ে ভালো বন্ধু। বই যেমন জ্ঞানের পরিধিকে বাড়ায়, তেমনি সঙ্গ দেয় অবসর সময় কাটাতে। পৃথিবীতে বইয়ের ইতিহাস বেশ পুরোনো। নতুন কিছু জানার পর সেটিকে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের তাগিদেই বইয়ের জন্ম। প্রাচীনকালে গাছের ছাল, পশুর চামড়া, এমনকি গুহার গায়ে লিখে তথ্য সংরক্ষণ করত মানুষ। সংরক্ষিত সেই তথ্যকে পৌঁছে দিত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। এভাবে নিজের অজান্তেই মানুষ বইয়ের প্রচলন শুরু করে।

তথ্য সংরক্ষণ কিংবা অর্জিত জ্ঞানকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ছড়িয়ে দিতে বইয়ের জন্ম হলেও বইকে বর্তমান রূপ পেতে লম্বা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। শুরুর দিকে গাছের ছাল, পশুর চামড়া কিংবা গুহার দেয়ালে ছবি এঁকে বা লিখে তথ্য সংরক্ষণ করলেও তা হারিয়ে যেত খুব সহজেই। কিন্তু এ ছাড়া কোনো উপায়ও ছিল না মানুষের হাতে। আর প্রাচীনকালের মানুষ খাদ্য সংগ্রহ, প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে লড়াই নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত ছিল যে, তথ্য সংরক্ষণ বা জ্ঞানার্জনের জন্য তাদের হাতে তেমন কোনো সময় থাকত না। তবে এত কিছুর পরও মানুষ তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি থেকেই তথ্য সংরক্ষণ প্রক্রিয়া চালু রাখে। এভাবে দিনে দিনে প্রচুর তথ্য সংরক্ষিত হয়, আবার সেসব হারিয়েও যায় কালের গর্ভে। এরও কয়েক হাজার বছর পর কাগজের ব্যবহার শুরু হয়। বই প্রকাশের ক্ষেত্রে দারুণ গতি এনে দেয় কাগজ। আগের তুলনায় তথ্য সংরক্ষণ হয়ে যায় আরো সহজ। তবে তখনো সব বই ছিল হাতে লেখা। হাতে লেখা এসব বইয়ের মাধ্যমেই মানুষ জ্ঞানার্জনের পথকে প্রসারিত করার চেষ্টা করত। হাতে লেখা এই বইগুলো একবার নষ্ট হয়ে গেলে, সেটি উদ্ধারের কোনো সুযোগ থাকত না। শুধু অতি গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোরই একাধিক কপি থাকত। এর বাইরে কোনো একটি বই বলতে একটি কপিকেই বোঝানো হতো। এ ধরনের বইয়ের মাধ্যমে বিশাল পরিমাণ তথ্য সংরক্ষণ সম্ভব হলেও বই সংরক্ষণ করা না গেলে সেই তথ্য হারানোর ভয়ও থাকত বেশি।

পরবর্তী সময়ে মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার প্রকাশনা শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন করে। এর ফলে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানেই পৃথিবীতে বইয়ের সংখ্যা বেড়ে যায় বহুলাংশে। সহজলভ্যতার ফলে মুদ্রিত বই পাঠকের হাতেও পৌঁছে যায় সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে। আগে বই নষ্ট হওয়ার বা পুনরুদ্ধার করতে না পারার যে ভয় ছিল, সেটিও কেটে যায় নিমিষেই। বিগত দুই শতাব্দীতে, বিশেষ করে বিংশ শতাব্দী জুড়ে বইপাঠ-ই মানুষের অবসর কাটানোর প্রধানতম মাধ্যমে পরিণত হয়। জ্ঞান অর্জন, মানসিক প্রশান্তি, পাঠকের কল্পনাশক্তিকে বাড়িয়ে তোলাÑ বই পরিণত হয় এমন বাহারি সব সুবিধার সমাহারে। বইয়ের দ্বিতীয় কোনো বিকল্প যে সম্ভব, সে কথা মানুষ তখন ভাবতেও পারেনি। যেখানে থেমে যায় মানুষের স্বাভাবিক চিন্তাপ্রক্রিয়া, সেখান থেকেই শুরু হয় সভ্যতার নতুন পথে যাত্রা।

মাত্র কয়েক দশক আগেও বই বলতে শুধু হার্ডকপিকেই বোঝানো হতো। কিন্তু এখন বই হয়ে গেছে দুই ভাগে বিভক্ত। হার্ডকপি আর সফটকপি। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি মানুষের জীবনের সবক্ষেত্রেই পরিবর্তনের ছোঁয়া এনেছে। পরিবর্তনের এই ঢেউ বদলে দিয়েছে বইকেও। ছাপার হরফ থেকে বই চলে এসেছে কম্পিউটারের পর্দায়, স্মার্টফোনের স্ক্রিনে। আধুনিক পৃথিবীর অন্যতম বিস্ময়কর এক আবিষ্কারই ‘ই-বুক’। একসময় যেখানে অল্প কয়েকটি বই হাতে বহন করতেই মানুষকে হিমশিম খেতে হতো, সেখানে এখন মানুষ পুরো একটি লাইব্রেরি পকেটে নিয়ে ঘুরতে পারে। শুধু তাই নয়, ইন্টারনেটের বিশ্বব্যাপী বিস্তারের ফলে যে বই একজন পাঠকের কাছে নেই, সেটিও মুহূর্তের মধ্যেই সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে। পৃথিবীতে ই-বুকের চলন শুরু হয় গত শতকের ৮০-এর দশকে। তবে তখনো এর ব্যবহার ছিল সীমিত। ই-বুকের ব্যবহার ও প্রসার বাড়তে থাকে চলতি শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে। অল্প সময়ের ব্যবধানেই ই-বুক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে।

ই-বুকের উত্থান একদিকে মানুষের জ্ঞানপিপাসা নিবারণ করেছে, জ্ঞানকে পৌঁছে দিয়েছে মানুষের দ্বারে দ্বারে। অন্যদিকে বইয়ের বিকল্প হিসেবেও ই-বুক শক্তিশালী অবস্থানে চলে এসেছে এবং এই পরিস্থিতি-ই বই ও ই-বুককে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে। অনেকেই ই-বুককে বইয়ের প্রধানতম বিকল্প মনে করেন। ই-বুকের আবিষ্কারের ফলে ছাপানো বইয়ের চাহিদা অনেকাংশেই কমে এসেছে। আধুনিক প্রযুক্তির এই পৃথিবীতে বই কিনে পড়ার চেয়ে ইন্টারনেট থেকে বই ডাউনলোড করে পড়াকেই সুবিধাজনক মনে করছেন পাঠকরা। ই-বুকের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি সহজে বহনযোগ্য। যেকোনো সময়, যেকোনো অবস্থায় পড়া যায়। পাঠক তার পছন্দমতো বই ডাউনলোড করে পড়ে নিতে পারেন সুবিধাজনক সময়ে। আবার চাইলে বইয়ের পৃষ্ঠা মার্ক করেও রাখা যায়। বই হারিয়ে যাওয়ার বা নষ্ট হওয়ার ভয়ও নেই। এতসব দিক বিবেচনা করে ই-বুকের দিকে বেশি ঝুঁকছেন সবাই। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মাঝে ই-বুকের প্রচলন বেশি। ইন্টারনেটে বই পড়ার জন্য তেমন কোনো খরচ করতে হয় না বললেই চলে। কিশোর, তরুণদের জন্য বই পড়াকে সহজ করে দিয়েছে ই-বুক। একস্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে হলে সব সময়ই জ্যামের মুখোমুখি হতে হয় রাজধানীবাসীকে, এ যেন নিত্যদিনের সাথি। ই-বুক সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় এ সময়টাকে কাজে লাগানোর জন্য অনেকেই ই-বুক ব্যবহার করে থাকেন। সময় কাটানো ও জ্ঞানার্জনÑ দুটোই যেন সমানতালে চলে এর মাধ্যমে। তবে ই-বুকের সবচেয়ে বড় অবদান বোধ করি বইপ্রাপ্তির সহজলভ্যতা তৈরিতে। সারা পৃথিবীই ই-বুক পাঠক বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। ছাপানো বই পছন্দ করলেও অনেক সময় সব বই হাতের কাছে পাওয়া যায় না। তখন ই-বুকের ওপরেই ভরসা করতে হয়।

তবে এ কথা সত্য যে, ই-বুক জনপ্রিয় হলেও মুদ্রিত বইয়ের পাঠকসংখ্যা-ই এখনো বেশি। ই-বুকের শত সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এখনো অনেকেই মুদ্রিত বইকেই অধিক প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। বিশেষ করে সত্তর বা আশির দশকে যারা বেড়ে উঠেছেন, তাদের কাছে মুদ্রিত বই-ই বেশি পছন্দের। ই-বুক সহজে বহনযোগ্য, এটি যেমন সত্য; সেই সঙ্গে বইপাঠ যে নান্দনিকতার অংশ, সেটিও সমানভাবে সত্য। নতুন বইয়ের ঘ্রাণের একটা আলাদা আকর্ষণ থাকে সব পাঠকের কাছেই। পাতার পর পাতাজুড়ে যে বস্তুটি নির্জন সময়ে মানুষকে সঙ্গ দেয়, সেটি তার কাছে যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। বই পড়ে মানুষের মনে, মস্তিষ্কে যে আলোড়ন তৈরি হয়, তার সঙ্গে ই-বুকের তুলনা করার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।

আমেরিকান রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ছাপানো বই আর ই-বুক পাঠকদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। গবেষণায় ধারণা করা হচ্ছে, ছাপানো বই মানুষের কল্পনাশক্তিকে প্রবলভাবে আলোড়িত করতে পারে। এ ধরনের বই পড়ার সময় পাঠকের মনোসংযোগ বেশি থাকে। কিন্তু ই-বুক পড়ার সময় মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। একজন পাঠক যখন কোনো একটি বই পড়ে, সে সময় আশপাশে মোবাইল ফোন থাকলে ফেসবুক বা মেইলের আপডেট জানতে মনের অজান্তেই সে মোবাইল ফোনটি হাতে নেয় এবং একবার মোবাইল ফোন হাতে নিলে আগের কাজে মনোযোগ ফেরানো কঠিন হয়ে যায়। আর ই-বুক পাঠকদের জন্য এ সমস্যাটি বেশি হয় কারণ তারা বই পড়েই মোবাইল বা ডিজিটাল ডিভাইসের পর্দায়। আবার, ব্যক্তির পেশা বা ব্যক্তিত্বেও ই-বুক ও ছাপানো বইয়ের পাঠক সমাজে পার্থক্য সৃষ্টি করে। সাধারণত যারা দিনের বেশির ভাগ সময় ব্যস্ত থাকেন, তারা কাজের ফাঁকে বই পড়ার জন্য ই-বুককে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। অন্যদিকে, যারা অবসর বেশি পান, তাদের ক্ষেত্রে মুদ্রিত বই-ই থাকে পছন্দের শীর্ষে।

শত শত বছর ধরে বই মানুষের জ্ঞানের ক্ষুধা নিবারণ করেছে। মানুষের বন্ধু হিসেবে পাশে থেকেছে বই। অনেক শৌখিন মানুষের কাছেই বই সংগ্রহ করা প্রধানতম একটি শখ। ছাপানো বই আর ই-বুক নিয়ে সারা পৃথিবীর পাঠকদের মধ্যেই বিতর্ক রয়েছে। নিজস্ব রুচি, পেশা, বয়স অনুসারে এর ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। গত দশকে ই-বুক যখন ব্যাপকহারে জনপ্রিয় হতে শুরু করে, তখন প্রযুক্তিবিদরা ভেবেছিলেন একটা সময় হয়তো বইয়ের প্রধানতম বিকল্প হবে ই-বুক, পৃথিবীতে ছাপানো বই আর থাকবে না। হয়তো ই-বুকেই রূপান্তরিত হয়ে যাবে পৃথিবীর সব বই। সেটি কবে হবে তা সময়ই বলে দেবে, তবে তা যে খুব দ্রুত হতে যাচ্ছে না, ছাপানো বইয়ের পাঠকসংখ্যা দেখে তা সহজেই অনুমান করা যায়। এখনো পৃথিবীর বিশাল এক জনগোষ্ঠীর কাছে বই মানেই মুদ্রিত বই। বর্ষার ঘন কালো মেঘ আর বৃষ্টি দেখতে দেখতে কিংবা চায়ের কাপ হাতে একাকী বিকালে বই পড়ে যে প্রশান্তি পাওয়া যায়, ই-বুকের সঙ্গে তার তুলনা চলে কি?

লেখক : সাধারণ সম্পাদক

হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল সাহিত্য সংসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বইয়ের বিকল্প,ই-বুক,বই,দৃষ্টিপাত
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close