আরাফাত শাহীন
ছোট গল্প
ঈশিতার ঈদ-আনন্দ
রাত পোহালেই ঈদ আর ঈশিতার আব্বু এখনো বাড়ি আসতে পারেননি। এটা নিয়ে তার মনে অনেক দুঃখ। আম্মু অনেক বুঝিয়ে বলেছেন তবুও কাজ হয়নি। ঈশিতার একই কথা, ‘সবার আব্বু যদি ঈদের দু-তিন দিন আগেই বাড়িতে ফিরে আসতে পারেন, তাহলে আমার আব্বু কেন পারবেন না!’
এই প্রশ্নের জবাব আম্মু দিতে পারেননি। কারণ, তার কাছে এই প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। সন্ধ্যা থেকেই ঈশিতার মুখখানা ভারী। অমন সুন্দর মুখটাতে দুঃখ এসে ভর করলে আম্মুর বড় কষ্ট হয়। কিন্তু তিনি কিছু বলতে পারেন না। ঈশিতা গুঁটি গুঁটি পায়ে এগিয়ে এসে আম্মুকে প্রশ্ন করল, ‘আব্বু কখন আসবে? আমার যে আর সহ্য হচ্ছে না!’
ঈশিতার চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো। তার দু’চোখে অশ্রু এসে জমা হলো।
আম্মু তাড়াতাড়ি সান্ত¡না দিয়ে বললেন, ‘চিন্তা কর না মা। তিনি আজ রাতের মধ্যেই বাড়ি চলে আসবেন।’
‘মুনিয়া, ময়না, শাকিল এদের সবার আব্বুই তো একদিন আগে বাড়িতে এসেছেন। আব্বু পারেন না কেন?’
‘তোমার আব্বুর অফিস থেকে ঈদের আগের দিন ছুটি হয়। তাই তার আসতে দেরি হয়।’
‘যে অফিসে আগে আগে ছুটি হয় আব্বু সেখানে চাকরি নিতে পারেন না?’ ঈশিতার চোখে আবার অশ্রু টলমটল করে উঠল।
ঈশিতার আব্বু ইয়াসিন শেখ ঢাকা শহরের একটা গার্মেন্টসে কাজ করেন। গার্মেন্টসের মালিক সারাবছর শ্রমিকদের দিয়ে কঠোর পরিশ্রম করান। আবার ঈদের সময়ও তাদের পরিশ্রমের অন্ত নেই। ঈদের আগের দিন ছুটি হয়। যাদের বাড়ি ঢাকা শহর থেকে দূরে তাদের কেউ কেউ বাড়িতে পৌঁছে ঈদের নামাজ ধরতে পারে না। ঈদের পরদিনই সবাইকে আবার কর্মস্থলে ফিরতে হয়। তাই কেউ কেউ বাড়িতে না গিয়ে ঢাকাতেই থেকে যায়।
তবে ঈশিতার আব্বুর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। তিনি বাড়িতে না এসে পারেন না। বাড়িতে তার ফুলের মত ফুটফুটে একটা মেয়ে রয়েছে। ঈদের দিন একমাত্র মেয়েকে ছেড়ে তিনি কিভাবে থাকতে পারেন! তাই শত কষ্ট হলেও তিনি বাড়িতে চলে আসেন।
ঢাকা শহরে কয়েক কোটি মানুষের বসবাস। ফলে শহরের মাঝে যেমন যানজট তেমনি শহরের বাইরে ঘরমুখো ছোটা মানুষের দীর্ঘ লাইন। রাস্তায় শুধু গাড়ি আর গাড়ি। ইয়াসিন শেখের শহর ছেড়ে বেরোতে বেরোতেই সন্ধ্যা পার হয়ে যায়। তার মনে আশঙ্কা জেগে ওঠে তিনি রাতের মধ্যে বাড়িতে পৌঁছাতে পারবেন তো! বাড়িতে যে তার ফুটফুটে মেয়েটা বাবার পথ চেয়ে বসে আছে তা তিনি ভালোমতই জানেন। মেয়ের মনে কষ্ট দিতে তার একদম ইচ্ছা হয় না।
ইয়াসিন শেখ চেষ্টা করেছিলেন তার কর্মক্ষেত্র পরিবর্তনের কিন্তু পারেননি। তার মতো একজন অশিক্ষিত মানুষকে চাকরি দেবে কে! যে গার্মেন্টসে তিনি কাজ করেন তার মালিক তাদের দিয়ে ধারণাতীত পরিশ্রম করান। তবুও তাদের যাওয়ার জায়গা নেই। ঈদের সময়ে অন্তত একটু ছাড় দিতে পারতেন হতচ্ছাড়া মালিক। তাহলে অগণিত মানুষের মুখে হাসি ফুটে উঠতো।
ইয়াসিন শেখের কপালে দুশ্চিন্তার ভাজ। গাড়ি মাত্রই দৌলতদিয়া ঘাটে এসে পৌঁছেছে। এখনই ঘড়ির কাটা ১০টা পার হয়ে গেছে। কখন যে তিনি বাড়িতে গিয়ে পৌঁছাবেন! গাড়িতে ওঠার আগে স্ত্রীর কাছে একবার মাত্র ফোন দিতে পেরেছিলেন। তারপর থেকে হতচ্ছাড়া ফোনটাও বন্ধ হয়ে আছে। নিশ্চয় মা-মেয়ে তার পথ চেয়ে বসে রয়েছে!
ইয়াসিন শেখের দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে গেল যখন তিনি দেখলেন তার একমাত্র মেয়ে ঈশিতার জন্য এবার কিছুই কেনা হয়নি। এমন তো এর আগে কোনোদিনও হয়নি! এত বড় ভুল তিনি কীভাবে করলেন! পথ থেকেও কিছু কিনে নেওয়ার উপায় নেই। নিজেদের জন্য তো কখনো কিছু কেনা হয়না, এবার মেয়েটির জন্যও কেনা হলো না। মেয়েটাকে এবার পুরনো কাপড় দিয়েই ঈদ করতে হবে। অফিস শেষ করেই গাড়িতে উঠতে হয়েছে বলে ব্যাপারটা তার মাথাতেই আসেনি! মেয়েটা যে কী মনে করবে! ‘তুমি আব্বুর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করনি?’ কাঁদতে কাঁদতে ঈশিতা তার আম্মুকে বলল। ‘হ্যাঁ, যোগাযোগ করেছিলাম তো! তোমার আব্বু বললেন, আমি গাড়িতে উঠেছি। এরপর আর যোগাযোগ করতে পারিনি। যতবার কল দিয়েছি মোবাইল বন্ধ পেয়েছি।’ ‘আরেকবার চেষ্টা করে দেখো না আম্মু!’ আম্মু আবার ফোন দিলেন। এবারও একই ঘটনা। ফোন বন্ধ। ঈশিতা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল।
‘আব্বুর আবার কিছু হয়নি তো!’ ‘আরে না! তুমি কী যে বলো! হয়ত মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে গেছে। তুমি একদম চিন্তা কর না।’ তবুও ঈশিতার চিন্তা দূর হলো না। আজকাল রাস্তায় চলতে কত রকমের যে বিপদ! আব্বু ভালোয় ভালোয় বাড়িতে ফিরে এলেই হয়! আব্বুর কথা ভাবতে ভাবতেই ঈশিতা একসময় ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু আম্মুর চোখে ঘুম নেই। তিনি জানেন, মাঝরাতেই ঈশিতার আব্বু আসবেন। প্রতিবছর এমনটাই হচ্ছে। আম্মু মনে মনে ভাবেন, মানুষটা যদি ভালো একটা চাকরি পেত! এখানে তাকে দিনরাত গাধার মত খাটতে হয়। অথচ জীবনে শান্তির পরিমাণ সামান্যই।
‘এই ঈশিতা ওঠ আম্মু। দেখ কে এসেছে!’ আম্মু ঈশিতার কাঁধে হালকা ধাক্কা দিলেন। ঈশিতা ধড়মড় করে উঠে বসলো বিছানার ওপর। প্রথমে ভালোমতো কিছুই বুঝতে পারল না। ঈশিতা একটা মধুর স্বপ্ন দেখছিল। তার বাবা বাড়ি এসেছেন। তার জন্য লাল টকটকে একটা জামা কিনে এনেছেন। এমন সময় এসে আম্মু তাকে ঘুম থেকে জাগালেন। ঈশিতা চোখ কচলে তাকিয়ে দেখল আব্বু সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ঈশিতার মুখটা খুশির আভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। কিন্তু আব্বুর মুখখানা অমন মলিন কেন! ঈশিতার চিন্তা যেন আরো বেড়ে গেল।
‘আব্বু, কী হয়েছে তোমার?’ ঈশিতার আবার কান্না পেয়ে গেল। আব্বু ঈশিতার পাশে এসে বসলেন। তারপর তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ‘এবার তোমার জন্য কিছুই আনতে পারিনি আম্মু।’ ঈশিতা খানিকক্ষণ বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে আব্বুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আব্বুর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, ‘তুমি বাড়িতে এসেছ আমার জন্য এরচেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে! আমার কিছুই লাগবে না আব্বু।’ মেয়ের কথায় আব্বু আশ্বস্ত হলেন। তারপর মনে মনে ভাবলেন, তার মেয়ে যেন একটা হীরার টুকরা হয়েছে। এমন মেয়ের বাবা হতে পেরে গর্বে তার বুকটা ফুলে উঠল।
পিডিএসও/তাজ