শাহাদাত হোসাইন, ফেনী

  ২৮ এপ্রিল, ২০১৯

দখলে হারিয়ে যাচ্ছে ফেনীর মহুরী নদী

দখল-দূষণ আর নাব্য সংকটে অস্তিত্ব সংকটে ফেনীর মহুরী নদী। জেলার সোনাগাজী ও চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার একটি অংশ দিয়ে বয়ে চলা মুহুরী নদীর তীর দখলে নেমেছে দুই উপজেলার দুটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট।

স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রভাবশালী চক্র বিভিন্ন কৌশলে নদী দখল করছে। তারা ইতিমধ্যে মুহুরী সেচ প্রকল্প এলাকার উজানে বড় ফেনী নদীর বিশাল অংশে মাছের খামার দিয়ে দখল করেছে।

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে উৎপত্তি হয়ে মুহুরী নদী বাংলাদেশের খাগড়াছড়ির রামগড় থেকে ফেনীর ছাগলনাইয়া ও সোনাগাজী হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। বাংলাদেশ নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, ৬৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য, ৭০ মিটার প্রস্থ মূহুরী নদীর গভীরতা ৭ মিটার। ১০১১ বর্গকিমি এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে আছে নদীর অববাহিকা।

এলাকাবাসী ও পাউবো কর্তৃপক্ষ থেকে জানা যায়, সোনাগাজীর উপকূলীয় এলাকা নদীভাঙন থেকে রক্ষা করতে ১৯৮৬ সালে সাড়ে তিন কিলোমিটার বাঁধে মুহুরী সেচ প্রকল্প নির্মাণ করা হয়। ফলে উজানে প্রায় ১২ কিলোমিটার চর জেগে ওঠে। ১৯৮৭ সালের শেষের দিকে চরের কিছু অংশ প্রভাবশালীরা ফেনী পাউবো থেকে লিজ নিয়ে সিংহভাগ দখল করে মাছ চাষ প্রকল্প গড়ে তোলে। তবে এ চর দখল নিয়ে সোনাগাজী ও মিরসরাই উপজেলার মানুষের মধ্যে বহুবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

সরেজমিন পরিদর্শনের জানা যায়, মুহুরী নদীর সোনাপুর-সোনাগাজী-জোরারগঞ্জ সড়কের মুহুরী সেচ প্রকল্প এলাকার উজানের সংযোগস্থলের উভয়পাশে বড় ফেনী নদীর তীরে বাঁধ দিয়ে অন্তত ৫০০ একর নদী দখল করে পুকুর কেটে মৎস্য চাষ করছে। দখলের কারণে বড় ফেনী নদী সংকুচিত হয়ে উজান থেকে পানির প্রবাহ বিঘিœত হচ্ছে। ফলে পানির চাপ বেড়ে মুহুরী বাঁধটি ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

জানতে চাইলে স্থানীয় কয়েকজন বলেন, এভাবে দখল হলে বড় ফেনী নদী এক সময় মরা খালে পরিণত হবে। নদীর চর দখল করে ইটভাটা নির্মাণ করায় তা পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। তবে দখলদারদের দাবী, ফেনী পাউবো থেকে লিজ নিয়ে তারা এসব কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন।

মুহুরী বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্পের উপ-সহকারী প্রকৌশলী নুরুল আফছার বলেন, নদী দখল রোধ করতে কয়েক বছর আগে অভিযান চালালে হামলায় পুলিশসহ ১০ জন আহত হন। তাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দিয়েও অপতৎপরতা বন্ধ করা যাচ্ছে না। এরা অনেক প্রভাবশালী।

ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী নুর নবী অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, কিছু ভূমি সরকারি নিয়মনীতি মেনে লিজ দেওয়া হলেও সিংহভাগ ভূমি প্রভাবশালীচক্র দখল করে মৎস্য খামারসহ বিভিন্ন অবকাঠামো গড়ে তুলেছে। আমরা পুলিশ নিয়ে অনেক বার অভিযান চালাতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছি।

এদিকে মুহুরী নদী কখনো ড্রেজিং করা হয়েছে কি না কেউ বলতে পারেন নি এলাকার প্রবীণরাও। প্রায় ৫০ বছর ধরে কোন ড্রেজিং না করায় এ নদী বর্তমানে নাব্য হারিয়ে অনেকটা মাছ চাষের পুকুরে পরিণত হয়েছে।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিআইডব্লিউটিএ, নদ-নদী সংরক্ষণ বিষয়ক টাস্কফোর্সের সূত্রমতে, ভাটির দেশ হওয়ায় দেশের নদীগুলোতে প্রতি বছর ১ দশমিক ২ বিলিয়ন (১২০ কোটি) ঘনমিটার পলি প্রবাহিত হয়। এর বড় অংশই নদীর তলদেশে জমে নাব্য সংকট সৃষ্টি করছে। ৪৭ বছরে নদীগুলোতে পলি জমেছে প্রায় ১৭৮ কোটি টন।

সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, নদীতে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন, চর দখল করে ফল, ফসল, মাছ চাষ, দোকানপাট, বাড়িঘর নির্মাণ ও তৈরি করায় নদী তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। আবার বালু উত্তোলনের কারণে নদী কোথাও সরু আবার কোথাও প্রশস্ত হয়ে গেছে। এতে নাব্য হারাতে বসেছে মুহুরী ও কহুয়া নদী। মুহুরী নদী রক্ষায় বিভিন্ন সময় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করেছেন নদী ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্থরা।

ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন (অতি.দায়িত্ব) জানান, মূহুরী-কহুয়া নদী খনন, ড্রেজিং ও বাঁধ সংস্কারের জন্য প্রক্রিয়াধীন। প্রকল্পটি অনুমোদন হলে মুহুরী-কহুয়া নদী খনন বা ড্রেজিং ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ বেড়িবাঁধ সংস্কার করা হবে।

ফেনী-১ আসনের সংসদ সদস্য ও জাসদ সম্পাদক শিরীন আখতার বলেন, মুহুরী নদী রক্ষায় জনগন সচেতন হতে হবে। বর্জ্য পদার্থ, পলিথিনসহ সহ নদী দূষিত হয় এমন কিছু নদীতে ফেলা বন্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে। আর দখলকৃত স্থানসমূহ চিহ্নিত করে দখলমুক্ত ও পরিকল্পিতভাবে নদী খনন করা হবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণে মুহুরী-কহুয়ার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ স্থায়ীভাবে মেরামত করা হবে। দেশীয় মাছের প্রধান উৎপাদনস্থল হল নদী-নালা, খাল বিল। প্রশাসন ও মৎস্য বিভাগ মাছের প্রাকৃতিক বিচরণক্ষেত্র রক্ষার্থে বদ্ধপরিকর।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close