মুহাজিরুল ইসলাম রাহাত, সিলেট

  ২০ মে, ২০১৮

সিলেটের পাসপোর্ট অফিসে দালালের দৌরাত্ম্য

সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে দালালদের দৌরাত্ম্য দিন দিন বাড়ছে। আর্জেন্ট (দ্রুত) পাসপোর্ট দেওয়ার নামে দালালরা গ্রাহকদের কাছ থেকে বাড়তি ১০-১২ হাজার টাকা করে হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কর্মকর্তাদের ঘুষের মাধ্যম হলো দালাল। আর দিন দিন বাড়ছে ঘুষের টাকার পরিমাণ। এতে ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ। সেবা নিতে এসে দালালদের দৌরাত্ম্যে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হলেও সেখানকার অসাধু কর্মকর্তাদের হয়েছে পোয়াবারো। জানা যায়, চ্যানেল ফির নামে প্রতি মাসে দালালদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টরা হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি টাকার ওপরে অর্থ। দালালদের হয়রানির ব্যাপারে অভিযোগ করতে গেলে উল্টো নাজেহাল হতে হয়।

সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের কার্যক্রম চলে দক্ষিণ সুরমায় নির্মাণাধীন নিজস্ব ভবনে। সরেজমিন সেখানে গিয়ে দেখা যায়, অফিসের নিচ-*তলায় শত শত নারী-পুরুষ পাসপোর্টের আবেদন জমা দেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। কয়েক মিনিট পর দেখা গেল, কালো রঙের টি-শার্ট পরিহিত এক যুবক লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছেন। তার সঙ্গে রয়েছেন মধ্যবয়সী আরো এক পুরুষ। কথা বলার এক ফাঁকে ৪-৫ জন ওই লাইন থেকে বেরিয়ে সবাইকে ডিঙিয়ে সোজা চলে গেলেন আবেদন জমাদানের কাউন্টারে। এ সময় প্রতিবেদকের কথা হয় এক যুবকের সঙ্গে, তিনি এসেছেন সিলেটের গোয়াইনঘাট থেকে। নাম ফরমান আলী। তিনি জানান, ওমান যাওয়ার জন্য এখানে পাসপোর্ট করতে এসেছেন। গত দুই দিন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে আবেদন জমা দিতে পারেননি। গতকাল ২০০ টাকার বিনিময়ে লাইন ছাড়াই আবেদন জমা দিয়েছেন। ফরমান আলীর মতো আরো অনেকেই এভাবে দিনের পর দিন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও জমা না দিতে পেরে দালালদের আশ্রয় নিচ্ছেন। আর দালালরা সেই সুযোগে প্রতি মাসে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। ভেতরে ঢুকে দেখা গেল কয়েকজন নারী-পুরুষ ছবি তোলার জন্য অপেক্ষা করছেন। এরই মধ্যে আরেকজন পুরুষ এসে হাজির। তিনিও ছবি তুলবেন। এসেই সালাম দিলেন সেখানকার দায়িত্বরত এক আনসার সদস্যকে। তার হাতে গুঁজে দিলেন ১০০ টাকার দুইটি নোট। ব্যস, অপেক্ষা ছাড়াই ছবি তোলার সুযোগ পেয়ে গেলেন তিনি। অনুসন্ধানে জানা যায়, নতুন পাসপোর্ট করতে আসা কেউ তথ্য চাইলে তাকে ইশারা-ইঙ্গিতে পাঠানো হয় দালাল চক্রের কাছে। সেখানে হিসাবের একটি নমুনা দেন দালালরা। খরচের হিসাব এরকমÑ আবেদনপত্র বাবদ ৫০-১০০, আবেদপত্র পূরণ বাবদ ২০০-৩০০, ছবি ও আবেদনপত্র সত্যায়িত করা ৫০০-৬০০, আবেদনপত্র জমার জন্য একই দিনে ছবি ও আঙুলের ছাপ দিতে চাইলে ৭০০-১০০০, থানা পুলিশ প্রতিবেদন বাবদ দেড় থেকে ২ হাজার টাকা। এছাড়া নির্ধারিত দিনে পাসপোর্ট পেতে হলে আবেদন জমা দেওয়ার সময় অতিরিক্ত ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা দিতে হয়। দালালদের কাছে রয়েছে বিভিন্ন এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান এবং প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের নকল সিল। এই অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত আনসার, পুলিশ, সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি এ অফিসের কার্যক্রম মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্তরাও কিছুই করতে পারেন না। জরুরি ও সাধারণ ক্যাটাগরিতে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করা হয়ে থাকে। তবে অফিসে আবেদনকারীর ক্যাটাগরি বিবেচিত হয় চ্যানেল না পাবলিক হিসেবে। যারা পাসপোর্টের জন্য সরাসরি আবেদন জমা দেন সেগুলো পাসপোর্ট অফিসে বলা হয় পাবলিক ফাইল। আর যারা দালালের মাধ্যমে আবেদন জমা দেন, সেগুলোকে বলা হয় চ্যানেল ফাইল। পাবলিক আবেদন মানেই ভোগান্তি।

সূত্র জানায়, প্রতিদিন পাসপোর্টের জন্য ৩০০ থেকে ৪০০ আবেদন জমা হয়। এর মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে ১০০ জন আবেদন জমা দেওয়ার সুযোগ পান। বাকিগুলো ক্রটিপূর্ণ বলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তবে দালাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রতিদিন অফিস সময়ের পরও প্রায় ২০০ আবেদন জমা নেওয়া হয়। এসব আবেদন থেকে প্রতিদিন অবৈধভাবে আয় হয় ২ থেকে ৩ লাখ টাকা। পাসপোর্ট অফিস সূত্র জানায়, এখানে প্রতিদিন ৩ শতাধিক নতুন পাসপোর্টের আবেদন জমা নেওয়া হয়। এর মধ্যে ২৪০ থেকে ২৫০টি আবেদন জমা নেওয়া হয় বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে। ট্রাভেল এজেন্সির দায়িত্বপ্রাপ্তদের প্রতিটি পাসপোর্টে ব্যাংক চালান ছাড়া ১ হাজার ২০০ টাকা করে অতিরিক্ত দিতে হয়, যা প্রতিদিন ৩ লাখ টাকা এবং মাসে ৬০ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়।

অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, জরুরি পাসপোর্ট করে দিতে ১১ থেকে ১২ হাজার এবং নরমাল পাসপোর্ট করে দিতে ৬ হাজার ৫০০ টাকা করে নেন দালালরা। যেখানে নরমাল পাসপোর্ট করতে লাগে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। এজেন্সির মাধ্যমে সংগ্রহ করা পাসপোর্টের আবেদনের একটি অংশে মার্কার পেন দিয়ে বিশেষ চিহ্ন দেওয়া হয়। ওই চিহ্নের মাধ্যমে কর্মকর্তারা ওই আবেদন ফরমগুলো সহজেই চিনতে পারেন। ট্রাভেল এজেন্টরা পরদিন ওই আবেদনের প্রার্থীদের পাসপোর্ট অফিসে পাঠান। আবেদনকারীরা পাসপোর্ট অফিসে এসে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ছবি তুলে চলে গেলে পর দিন ফাইল পাঠানো হয় ঢাকায়। সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক এ কে এম মাজহারুল ইসলাম জানান, পাসপোর্ট অফিসে কোনোভাবে অবৈধ আয়ের সুযোগ নেই। আর অফিসের কোনো স্টাফ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকলে, তা আমার জানা নেই।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist