প্রতীক ইজাজ
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশের জোর কূটনৈতিক তৎপরতা
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় কূটনীতির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক তৎপরতাও চালিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আগের অবস্থান থেকে সরে এসে বাংলাদেশও কূটনৈতিক তৎপরতায় পরিবর্তন এনেছে। এত দিন বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান চাইলেও এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও সমস্যা সমাধানে পাশে চাইছে। বিশেষ করে মিয়ানমারকে সমর্থনকারী তিন প্রভাবশালী রাষ্ট্র-চীন, রাশিয়া ও ভারতকে পক্ষে আনার জন্য বিশেষ কূটনৈতিক উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এসব কূটনৈতিক তৎপরতার অংশ হিসেবে এ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে বর্তমানে তুরস্ক সফরে রয়েছেন সরকারের এক প্রতিমন্ত্রী। তিনি সেখান থেকে চীন ও রাশিয়া যাবেন। এ ছাড়া রাশিয়ায় চলমান ইন্টার-পার্লামেন্টারিয়ান ইউনিয়ন (আইপিইউ) সম্মেলনে অংশ নিয়ে ৪২ সদস্য রাষ্ট্রের সঙ্গে ও আলাদাভাবে রুশ নেতাদের সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছেন বাংলাদেশ প্রতিনিধিরা। একই সঙ্গে আলাদাভাবে বেইজিং ও মস্কোর সমর্থন আদায়ে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতাও অব্যাহত রেখেছে সরকার।
এসব তথ্য দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চীন ও রাশিয়া বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে দেশ দুটির জোরালো সমর্থন নেই। সে কারণে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বেইজিং ও মস্কোকে পাশে চাইছে ঢাকা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১২ অক্টোবর রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ও পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হকের সঙ্গে একটি বৈঠক করেছেন। প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পুরোপুরি অবহিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এ সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন দিকনির্দেশনাও দিয়েছেন। এ সময় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমকে প্রধানমন্ত্রী তার বিশেষ দূত হিসেবে বেইজিং ও মস্কো সফরে গিয়ে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে এই দুই দেশের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করার নির্দেশ দেন।
এর আগে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্ট তাকেদা আলেমুর পরামর্শ অনুযায়ী সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনিসহ আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল বেইজিং সফরে যান। সে সময় প্রতিনিধিরা চীনের নেতাদের সঙ্গে চলমান সংকটের অবসানের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করছেন। পাশাপাশি রোহিঙ্গা ইস্যুতে দিল্লির সঙ্গে ঢাকার ঘনিষ্ঠ আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছে কূটনৈতিক সূত্রগুলো। সেখানে দিল্লির ‘নিরপেক্ষ’ এবং ‘কার্যকর’ অবস্থানই আশা করছে বন্ধু বাংলাদেশ।
সূত্র জানায়, রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে শুরু হওয়া ইন্টার-পার্লামেন্টারিয়ান ইউনিয়ন (আইপিইউ) এই সম্মেলনে অংশ নিয়ে এরই মধ্যে বাংলাদেশের সংসদীয় প্রতিনিধিরা ৪২ সদস্যের এশিয়ান পার্লামেন্টারি অ্যাসেম্বলিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন রোহিঙ্গা ইস্যুতে। ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়ার নেতৃত্বে জাতীয় সংসদের ১২ সদস্যের প্রতিনিধিদলটির আলাদাভাবে রুশ নেতাদের সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট ইস্যু নিয়ে আলোচনা করার কথা রয়েছে। অন্যদিকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম রাশিয়া যাচ্ছেন। তিনি সেখানে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সফরকালে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনকে লেখা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি চিঠি দেবেন বলেও জানা গেছে। একইভাবে চীন সফরকালে দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনুরূপ আরেকটি চিঠি দেওয়ার কথাও রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা এখনো সঠিক পথেই রয়েছে বলে মনে করছেন, দেশের ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহল। তাদের মতে, এখনো মিয়ানমারের পক্ষে ভারত, রাশিয়া ও চীনের অবস্থান। অন্যদিকে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, সুইডেন, মিসর, কাজাখস্তান ও সেনেগালসহ জাতিসংঘের অধিকাংশ সদস্যরাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে সংকট সমাধানে মিয়ানমারকে বাধ্য করার পক্ষে। সম্প্রতি এ তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র যুক্ত হয়েছে। এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আরো বাড়াতে হবে। চীন ও রাশিয়াকে পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করে আস্থায় আনতে হবে। ভারত বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু। ভারতের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে তাদের সহযোগিতা নিতে হবে। মিয়ানমার যেন রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে কালক্ষেপণ করতে না পারে, সেদিকে সতর্ক থেকেই দ্বিপাক্ষিকভাবে দেশটির সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। বিশেষ করে চীন, রাশিয়া ও ভারতকে দিয়ে মিয়ানমারকে সংকট সমাধানে বাধ্য করার চেষ্টা চালিয়ে যেতেই হবে।
এ ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী বলেন, রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর থেকে বাংলাদেশের তরফ থেকে নানা কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে যাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়। পরিবর্তিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ কৌশল নিয়েই এগোচ্ছে বাংলাদেশ। দ্বিপাক্ষিক কূটনীতির পাশাপাশি আমরা আন্তর্জাতিক কূটনীতিও অব্যাহত রেখেছি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনগুলো রোহিঙ্গা ইস্যুতে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বাংলাদেশের পক্ষে থেকে সব ধরনের কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ভারত আমাদের সঙ্গে রয়েছে। রাশিয়া ও চীনকে বাংলাদেশের পাশে চাইছি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ১৯৭৭ বা ১৯৯২ সালের কূটনৈতিক তৎপরতায় কিছু পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ। ২০১২ সালে রোহিঙ্গা সমস্যার সঙ্গে ‘সন্ত্রাসবাদ ইস্যু’ যুক্ত হওয়ার পর থেকেই মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগ বাড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা করে। ১৯৭৭ সালে প্রথম বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটে। সে সময় দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো হয়। ১৯৯২ সালে অনুপ্রবেশের পর জাতিসংঘের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের ফেরত পাঠানো হয়েছিল। এ দুবারই বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল মূলত দ্বিপক্ষীয়। ২০১২ সালে রোহিঙ্গা প্রবেশের পর বাংলাদেশ দুটি প্রস্তাব করে। এর একটি ছিল-নিরাপত্তা সহযোগিতা চুক্তি, অন্যটি বর্ডার লিয়াজোঁ অফিস প্রতিষ্ঠা। কিন্তু এ দুটি প্রস্তাবের একটিতেও সাড়া দেয়নি মিয়ানমার।
সর্বশেষ গত ২৫ আগস্ট শুরু হওয়া মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বরতায় প্রাণভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে থাকে রোহিঙ্গারা। গত বুধবার পর্যন্ত পাঁচ লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। একইভাবে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে আসার পথে গত দুই মাসে ২৬টি নৌকাডুবির ঘটনায় ১৮২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সংকট সমাধানে এবারও মিয়ানমার মন্ত্রী বাংলাদেশে এসে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠন এবং বাংলাদেশের দেওয়া নতুন চুক্তির ব্যাপারেও সম্মত হয়েছেন। কিন্তু এখনো মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন ও বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢল অব্যাহত থাকায় মিয়ানমারের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না বাংলাদেশ। এমনকি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও চাপ অব্যাহত রেখেছে। সর্বশেষ গত সোমবার রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের কারণে মিয়ানমারের সেনাপ্রধানসহ শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের সব ধরনের আমন্ত্রণ স্থগিত করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। দুই দফা বৈঠক করেছে নিরাপত্তা পরিষদ। যদিও চীন ও রাশিয়ার কারণে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাব পাস হয়নি; কিন্তু সংকট সমাধানে সম্মত হয়েছে সংস্থার সদস্য রাষ্ট্রগুলো।
এমন পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের কোন পথে এগোনো উচিত-জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, কূটনৈতিক তৎপরতা ছাড়া বিকল্প কিছু ভাবা যাবে না। ধৈর্য ধরতে হবে। পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। কূটনৈতিক কৌশলেও পরিবর্তন আনতে হবে। আন্তর্জাতিক কূটনীতির পাশাপাশি মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় কূটনীতিও গুরুত্বপূর্ণ। সতর্কভাবে সে কূটনীতি চালিয়ে যেতে হবে।
মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর (অব.) ইমদাদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশকে জোর দিতে হবে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত আনান কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের ওপর। আনান কমিশনের দাবি বাস্তবায়ন ছাড়া অন্য কূটনৈতিক উদ্যোগ নিলে রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হবে। কারণ আনান কমিশনেই সমস্যাটি সমাধানের পথরেখা আছে। মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ভিত্তিতে সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নিলেও সফলতার সম্ভাবনা নেই।
এই সাবেক কূটনীতিক আরো বলেন, বাংলাদেশকে কূটনীতির মাধ্যমে ভারত, রাশিয়া ও চীনকে বোঝাতে হবে যে, রোহিঙ্গা সংকটের কারণে আমরা সরাসরি আক্রান্ত। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমাদের কোনো ধরনের নিজস্ব স্বার্থ নেই। আমাদের ওপর এই চাপ সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার। মিয়ানমারের সঙ্গে এই তিন দেশের যে সম্পর্ক, বাংলাদেশ তাতে কখনো হস্তক্ষেপ করবে না। রাশিয়া অস্ত্র বিক্রি করছে মিয়ানমারের কাছে, বাংলাদেশ তাতে না করছে না। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুকে দেখছে মানবিক হিসেবে।
"