প্রতীক ইজাজ

  ২৭ জুলাই, ২০১৭

চট্টগ্রাম

২২ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান

ভূ-প্রকৃতিগত অবস্থানের কারণে বন্দরনগর চট্টগ্রামে বর্ষায় প্রতিদিন গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১২০ মিলিমিটার (মিমি)। এর মধ্যে গত রোববার বৃষ্টিপাত হয়েছে ১১৩ মিলিমিটার, সোমবার ২৩২, মঙ্গলবার ২৯ মিলিমিটার। অর্থাৎ এই তিনদিনে মোট বৃষ্টিপাত হয়েছে ৩৭৪ মিলিমিটার। এর সঙ্গে সোমবার অমাবস্যার প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫ ফুটের জোয়ার আর কাপ্তাই হ্রদ থেকে প্রতি সেকেন্ডে ৩৬ হাজার কিউসেক পানি ঢুকেছে নগরে। অথচ বৃষ্টিপ্রবণ এই নগরের ড্রেনগুলোর ধারণক্ষমতা মাত্র ১০ মিলিমিটার।

এর ফলে সোমবার বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যায় চট্টগ্রাম। পানি বেরোনোর পথ না থাকায় দেখা দেয় স্মরণকালের জলাবদ্ধতা।

গতকাল পর্যন্ত থইথই পানিতে ভাসছিল নগর। জনদুর্ভোগ রেকর্ড ছাড়িয়েছে। শুধু এবারই নয়, গত দুই মাসে ছয়বার জলাবদ্ধতা দেখা দেয় নগরে। এর মধ্যে প্রথমবার ডোবে গত ৩১ মে। টানা দুই দিন ছিল সেই জলাবদ্ধতা। এরপর গত ১২ জুন ফের জলাবদ্ধতায় পড়ে নগর। ১৮ জুন আবার তলিয়ে যায় চট্টগ্রাম। ৩ জুলাইয়ের বৃষ্টিপাতেও ডোবে নগরের বিভিন্ন স্থান। ২০ জুলাই কেবল নিম্নাঞ্চল জলাবদ্ধ হয়। আর গত রোববার থেকে সোমবার পর্যন্ত বৃষ্টিপাতে স্মরণকালের জলাবদ্ধতা দেখা দেয় এখানে। ফলে চট্টগ্রাম এখন জলাবদ্ধতার নগরে রূপ নিয়েছে বলা যায়।

আবহাওয়াবিদরা চট্টগ্রামের এই বৃষ্টিকে বর্ষার স্বাভাবিক বৃষ্টি হিসেবেই দেখছেন। ফলে প্রশ্ন উঠেছে সেই স্বাভাবিক বৃষ্টিতেই তাহলে তলিয়ে যাচ্ছে কেন নগর? কেন দেখা দিচ্ছে এমন জলাবদ্ধতা? প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা চাক্তাই ও খাতুনগঞ্জে কেন পানি এত বেড়ে গেল? কিছু এলাকা ছাড়া কেনইবা জলমগ্ন হয়ে গেল প্রায় পুরো নগর? আর কেনইবা বারবার জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে এখানে?

এ নিয়ে উদ্বিগ্ন দেশের নগর ও পরিকল্পনাবিদরা। এসব বিশেষজ্ঞ নগরজুড়ে এই জলাবদ্ধতার জন্য বৃষ্টিপাত বা জোয়ারের পানিকে কোনোভাবেই দায়ী করতে রাজি নন। তাদের মতে, শ্রাবণের শুরুতে বৃষ্টি হবেÑএটাই স্বাভাবিক। মূল সমস্যা দুটিÑড্রেনগুলোর পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে ও নগরে জমা হওয়া পানি (বৃষ্টি ও জোয়ারের) বের হতে পারছে না। পানি নেমে যাওয়ার জন্য যে নালা ও খালের দরকার, তা না থাকার কারণে অর্থাৎ ড্রেনেজ সিস্টেম ফল্টের কারণেই পানি জমছে। বৃষ্টিপাত এর জন্য কোনো ফ্যাক্টর নয়। অর্থাৎ বৃষ্টিপাত ও জোয়ারের পানি ঠেকানোর মতো কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি শাহীনুল ইসলাম খান বলেন, মানুষ তাদের সলিড আবর্জনাগুলো ড্রেনের মধ্যে ফেলে ড্রেনের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। এজন্য মাঝে মাঝে দশ মিনিটের বৃষ্টি হলেও ড্রেনগুলো উপচে পড়ে। আর নগর পরিকল্পনাবিদরা বলেন, জোয়ার-ভাটার সময় পানি ওপরে ওঠে আসে। সেই পানি বাধা দেওয়ার জন্য যে স্লুইস গেটের দরকার, সেটা নেই। অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থাও জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ।

চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার কারণ ও তা দূরীকরণে বিভিন্ন দিক নিয়ে গতকাল প্রতিদিনের সংবাদ দেশের তিন নগর ও পরিকল্পনাবিদদের সঙ্গে কথা বলে। তারা জলাবদ্ধতা দূর করতে নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে নেওয়া ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছেন। জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পৃথক পৃথক প্রকল্প না নিয়ে একটি সমন্বিত উদ্যোগের কথাও বলেছেন তারা। এমনকি নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের বছরের পর বছর এক ধরনের নিস্পৃহতায় ভীষণ হতাশা ব্যক্ত করেছেন।

কী ছিল সেই ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানেÑজানতে চাইলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) সংশ্লিষ্টরা বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল খনন থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়ার সুস্পষ্ট সুপারিশ ছিল। ১৯৯৫ সালের মহাপরিকল্পনায় নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে একাধিক খাল খননের কথা বলা হয়েছিল। সেসব খাল কে কোনটা খনন করবে, তার খরচ কত পড়বেÑসবই লেখা ছিল পরিকল্পনায়। কিন্তু সিটি করপোরেশন সেই সময় তা বাস্তবায়ন করেনি। অথচ জলাবদ্ধতার পেছনে গত ২২ বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা আরো জানান, পাঁচ পর্বে বাস্তবায়নের এই প্রকল্পের একটি পর্ব কোনোরকমভাবে শেষ হয়েছে। বাকি চার ধাপের বাস্তবায়নের কোনো রোডম্যাপ নেই।

অবশ্য অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং চউক, চসিক ও ওয়াসাÑএই তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার সমন্বয়হীনকেও জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে দেখছেন নগরবিদরা। তারা জানান, জলাবদ্ধতা নিরসনে বিশেষ কোনো গবেষণা ছাড়াই চসিক খাল সংস্কারকাজে পানিতে টাকা ঢালছে। আর চউক প্রতিদিনই অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘরের নকশা অনুমোদন দিচ্ছে। ড্রেনেজ নিয়ে নেই কোনো ভাবনা। দুই যুগ ধরে দফায় দফায় পরিকল্পনাতেই সব সীমাবদ্ধ।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক অলক পাল বলেন, প্রাকৃতিক কারণ তো আছেই। তবে বেশি দায়ী মানবসৃষ্ট কারণ। গত ১০-১২ বছর পরিকল্পনা ছাড়াই নগরে বিভিন্ন বড় বড় স্থাপনা গড়ে উঠেছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থাও অপরিকল্পিত। এ ছাড়া জলাবদ্ধতার জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ওয়াসা ও সিটি করপোরেশন অনেকাংশ দায়ী। উন্নয়নের কাজে তাদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। আর খালগুলো দিন দিন ভরাট ও অবৈধ দখলের ফলে চট্টগ্রাম নগরের জলজট দিন দিন বাড়ছে। জলাবদ্ধতা দূর করতে হলে নগরের উন্নয়নের কাজে তিন সংস্থাকে সমন্বয় করতে হবে। খালগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করতে হবে। এ ছাড়া নগরের মানুষের সচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ মানুষ পরিবেশ বিষয়ে খুব অসচেতন।

একইভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান ও মৎসবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ও নগরবিদ অধ্যাপক সাইদুর রহমান বলেন, ড্রেনেজ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় পানি নিষ্কাশন যথাসময়ে হচ্ছে না। জোয়ারের সময় যে পরিমাণ পানি নিষ্কাশন হওয়ার কথা, সে পরিমাণ পানি বেরোতে পারছে না। নিয়ম না মেনে স্থাপনা নির্মাণ ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়াও জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ। তা ছাড়া হালিশহর এলাকা ছিল চর। একটি চরকে জনপদে রূপ দিতে হলে কমপক্ষে ৫০ বছর সেখানে বড় ধরনের কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা উচিত নয়। কিন্তু সেটি মানা হয়নি। বড় বড় আবাসিক ভবন গড়ে উঠেছে। এর ফলে এলাকাটি দেবে যাচ্ছে। সেখান থেকে পানি বেরোতে না পেরে জলবাদ্ধতা স্থায়ী রূপ নিচ্ছে। অবশ্য তিন সংস্থার সমন্বয় না থাকাকেও জলাবদ্ধতার জন্য দুষছেন তিনি। সমাধান কীÑজানতে চাইলে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে এবং ড্রেনগুলোকে উন্মুক্ত করতে হবে। নগরে পর্যাপ্ত খোলা জায়গা রাখতে হবে। যাতে বৃষ্টি হলে মাটি পানি শোষণ করতে পারে। নগরের তিন সংস্থাকে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। এ ছাড়া স্লুইসগেট সময়মতো বন্ধ এবং খুলতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আক্তার মাহমুদ বলেন, নগর কর্তৃপক্ষ এত বছর কী করলেন? ৯৫ সালে মাস্টারপ্ল্যান নেওয়া হলো। ২২ বছরে সে প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে ৩৫০ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ও হলো। কিন্তু ড্রেনগুলো খুলল না। একটি সিদ্ধান্তও বাস্তবায়ন হলো না। ১২টি স্লুইসগেট ও পাম্প স্টেশন নির্মাণ করার কথা ছিল, হয়নি। এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল ওয়াসার ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন হিসেবে নগর প্রশাসন সে প্ল্যান মেনে নিতে পারেনি। ফলে বাস্তবায়ন হয়নি। আমার মনে হয়, ওই মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন হলেই জলাবদ্ধতা দূর হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist