জিয়াউদ্দিন রাজু

  ২১ অক্টোবর, ২০১৯

উত্থান-পতন

অবশেষে পতন হলো যুবলীগে একক আধিপত্য বিস্তারকারী চেয়াম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর। নানা অভিযোগ মাথায় নিয়ে শেখ হাসিনার নির্দেশে বহিষ্কার হয়েছেন তিনি। সংগঠনে লাগামহীন নিয়ন্ত্রণ, ক্যাসিনোকে প্রশ্রয়, টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মই তার পতনের মূল কারণ। বিভিন্ন অভিযোগে যেকোনো সময়ে তিনি গ্রেফতারও হতে পারেন বলে জানা গেছে। গতকাল রোববার গণভবনে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যুবলীগের নেতারা বৈঠক করেন। যুবলীগের আসন্ন ৭তম সম্মেলনের বিষয়ে সভানেত্রী কাছ থেকে চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা নিতে ওই বৈঠকে বসেন সংগঠনের শীর্ষ নেতারা। বৈঠকে নেতাকর্মীরা চেয়ারম্যান ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করেন দলের হাইকমান্ড শেখ হাসিনার কাছে। তাদের এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে যুবলীগের চেয়ারম্যান পদ থেকে ওমর ফারুক চৌধুরীকে সরিয়ে দেন শেখ হাসিনা।

বিড়ি শ্রমিক লীগ, জাতীয় পার্টি যুব সংগঠন, আওয়ামী লীগ করেও ওমর ফারুক দীর্ঘ সময় ছিলেন রাজনীতির পেছনের কাতারে। তবে যুবলীগের সভাপতি হওয়ার পর শোধ করেছেন পুরোনো ব্যর্থতার দেনা। রূপকথার মতো উত্থান ঘটে তার। তামাক দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও একসময় করেন তৈরি পোশাকের ব্যবসা। কিন্তু ব্যবসায় সাফল্য পাননি তিনি। হয়েছেন ঋণ খেলাপি। তবে যুবলীগের সভাপতি হয়েই ভাগ্য বদলে যায় তার। মালিক হন বিপুল অর্থবিত্তের। যদিও তার দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা বা আয়ের উৎস নেই।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্যতম সহযোগী সংগঠন যুবলীগ। সংগঠন আওয়ামী লীগের হলেও দীর্ঘ ৭ বছর এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছেন ওমর ফারুক চৌধুরী। তার কথাই শেষ কথা ছিল যুবলীগে। তার ইচ্ছায় চলত সংগঠনটির কার্যক্রম। এ নিয়ে নেতাকর্মীদের ক্ষোভ থাকলেও প্রকাশ হয়নি কখনো। সম্প্রতি সরকারের ক্যাসিনো অভিযানের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে যুবলীগর ওপর। যুবলীগের শীর্ষ একাধিক নেতা গ্রেফতার হওয়ার পর আঙুল উঠে সংগঠনের চেয়ারম্যানের দিকে।

কেন্দ্র থেকে তৃণমূল, সব জায়গায় গঠনতন্ত্রের তোয়াক্কা না করে স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে প্রায় ৭ বছর ধরে যুবলীগের কর্মকা- চালিয়ে আসছিলেন ওমর ফারুক। কার্যনির্বাহী বা প্রেসিডিয়াম বৈঠকও হতো তার খেয়ালখুশি মতো। এমনকি ৩ বছরের কেন্দ্রীয় কমিটি যেমন অর্ধযুগ পার করেছে, তেমনি মাত্র ৩ মাসের চট্টগ্রামের আহ্বায়ক কমিটি দায়িত্ব পালন করছে প্রায় ছয় বছর ধরে।

সরকারের শুদ্ধি অভিযানে ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি, টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের কবলে পড়ে চরম ইমেজ সংকটের মুখে পড়েছে যুবলীগ। তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত-যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে অভিযোগের যেন শেষ নেই। নেতাদের অভিযোগ, সংগঠন পরিচালনায় যেমন তিনি স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দিয়েছেন, তেমনি প্রশ্রয় দিয়েছেন অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্তদেরও। গত এক মাস ধরে চলা দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে ওমর ফারুকের অনুসারী হিসেবে পরিচিত ইসমাইল হোসেন সম্রাট, খালেদ ভূইয়া, জি কে শামীম, কাজী আনিসুল হকের নাম উঠে আসায় চরম ইমেজ সংকটে পড়েছে যুবলীগ। শুধু রাজধানী ঢাকা নয়। বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ সারা দেশের যুবলীগে ছিল ওমর ফারুকের অনুসারীদের লাগামহীন নিয়ন্ত্রণ। বিশেষ করে টেন্ডার বাণিজ্য এবং চাঁদাবাজির জন্য যুবলীগের এ অংশটিকে দায়ী করছে নেতৃত্বের বাকি অংশ। সংগঠনের গঠণতন্ত্র মানার ক্ষেত্রেও ওমর ফারুকের ছিল চরম অনীহা। বিশেষ করে কার্যনির্বাহী কিংবা প্রেসিডিয়াম সদস্যদের বৈঠক ছিল অনিয়মিত। ওমর ফারুকের ইচ্ছা অনুযায়ী এসব বৈঠক অনুষ্ঠিত কিংবা সিদ্ধান্ত নেয়া হতো বলেও অভিযোগ উঠেছে।

সব মিলিয়ে যুবলীগের ৭ম জাতীয় সম্মেলন আয়োজনের জন্য আগামী ২৩ নভেম্বর তারিখ নির্ধারিত রয়েছে। গতকাল সম্মেলনের বিষয়ে চূড়ান্ত-দিকনির্দেশনা নিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এই বৈঠকে বসেন কেন্দ্রীয় যুবলীগ। তবে বিভিন্ন কর্মকা-ে যেসব যুবলীগ নেতা বিতর্কিত হয়েছেন, তাদের বাদ দিয়ে বৈঠকে বসার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল আগেই। এমনকি পদ বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগের কারণে খোদ যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকেও বৈঠকে ডাকা হয়নি।

তিনি ২০০৩ সালে যুবলীগের সভাপতিম-লীর সদস্য হন। এর আগের কমিটিতে ছিলেন কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। ২০০৯ সালে হন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। এরপর ২০১২ সালে হন চেয়ারম্যান। এরপর থেকে যুবলীগে তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। ক্ষমতাসীন দলের যুব সংগঠনের শীর্ষ পদ পাওয়ার পর সম্পদ নিলামে ওঠার পরিস্থিতি সামলে নিয়েছেন এবং ধনাঢ্য জীবন যাপন করছেন। যদিও তার দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা নেই। যুবলীগ চেয়ারম্যানের বর্তমান বয়স ৭১ বছর। তিনি সাত বছর ধরে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন। যদিও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর পরপর কমিটি করার কথা।

এ নিয়ে সংগঠনের নেতাকর্মীদের সমালোচনাও আছে। যুবলীগের সূত্রে জানা গেছে, চেয়ারম্যানের সঙ্গে তাদের সরাসরি আলাপ করার সুযোগও কম। যুবলীগের দফতর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমানের মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। পিয়ন থেকে দফতর সম্পাদক হওয়া কাজী আনিসও ‘কমিটি বাণিজ্য’ করে অনেক বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন আনিস।

১৯৪৮ সালে জন্ম নেয়া ওমর ফারুক চৌধুরী সত্তরের দশকে চট্টগ্রাম জেলা বিড়ি শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বিড়ি শ্রমিক লীগের নেতা হয়ে মিয়ানমার থেকে তামাকের বিকল্প টেন্ডু পাতা আমদানি শুরু করেন তিনি। এরপর এরশাদ ক্ষমতায় আশার পর ওমর ফারুক চৌধুরী শ্রমিক লীগের রাজনীতি ছেড়ে যোগ দেন জাতীয় পার্টির যুব সংহতিতে। এরশাদ সরকারের পতনের পর কিছুদিন নীরব ছিলেন ওমর ফারুক। ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হলে তিনি সদস্য হন। ১৯৯৭ সালে তিনি উত্তর জেলা কমিটির কোষাধ্যক্ষ হন। ওই কমিটির মেয়াদ ছিল ২০০৪ সাল পর্যন্ত।

সূত্র জানায়, এরশাদের আমলে যুব সংহতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর ওমর ফারুকের আয় বাড়তে থাকে। মালিক হন পোশাক কারখানার। তবে এই ব্যবসা করতে গিয়ে সম্পদ নিলামে ওঠার পরিস্থিতি তৈরি হয় ওমর ফারুকের। ব্যাংক ঋণের দায়ে নগরের একটি বাড়ি এবং রাউজানের সুলতানপুর গ্রামের জমি ও ঘর নিলামে ওঠার চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে। নিলামে তোলার দিনক্ষণও ধার্য করেছিলেন চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালত। উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ এনে নিলাম ঠেকান তিনি।

সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৭ সালে সোনালী ব্যাংকের চট্টগ্রামের কে সি দে রোডের শাখা থেকে ওমর ফারুক চৌধুরী ও তার স্ত্রী শেখ সুলতানার নামে থাকা প্রতিষ্ঠান মেসার্স রাওনিট অ্যাপারেলস ও মেসার্স রাও গার্মেন্টের নামে ১১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ঋণ নেওয়া হয়, যা পরে সুদ-আসলে সাড়ে ৪৪ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। টাকা আদায় না করতে পেরে অর্থঋণ আদালতে যায় ব্যাংক।

সম্পদ নিলামে ওঠার দুই মাস আগেই যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন ওমর ফারুক চৌধুরী। আওয়ামী লীগও ওই বছরের শুরুতে ক্ষমতায় আসে। পরিস্থিতি বদলাতে থাকে তার। ব্যাংকঋণের একটি অংশ পরিশোধ করেছেন তিনি। কিন্তু এখন আর ওমর ফারুক চৌধুরীর দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা নেই।

তথ্য মতে, ১৯৪৮ সালে জন্ম নেওয়া ওমর ফারুক চৌধুরী সত্তরের দশকে চট্টগ্রাম জেলা বিড়ি শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তখন আওয়ামী লীগের প্রয়াত কেন্দ্রীয় নেতা এস এম ইউসুফ ছিলেন তার রাজনৈতিক মুরব্বি। বিড়ি শ্রমিক লীগের নেতা হয়ে মিয়ানমার থেকে টেন্ডু পাতা আমদানি শুরু করেন ওমর ফারুক। তামাকের বিকল্প এ টেন্ডু পাতা বিড়ির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

এইচ এম এরশাদ ক্ষমতায় আসার সময় ওমর ফারুক শ্রমিক লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জাতীয় পার্টির প্রয়াত নেতা নাজিউর রহমান (মঞ্জু) এরশাদের মন্ত্রিসভার সদস্য হলে ওমর ফারুক দল বদল করেন। জাতীয় পার্টির অঙ্গ সংগঠন যুব সংহতির চট্টগ্রাম উত্তর জেলার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ওমর ফারুক চৌধুরী জাতীয় পার্টির প্রয়াত নেতা নাজিউর রহামন মঞ্জুর ভায়রা ভাই এবং আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ভগ্নিপতি।

চলমান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর দিনই তার বক্তব্য ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে যুবলীগের সম্পৃক্ততা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যে নিজেই পড়ে যান বেকায়দায়। এর মধ্যে চলমান শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে এবার যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর ব্যাংক হিসাব তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট।

এদিকে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর থেকেই সমালোচিত হচ্ছেন যুবলীগ চেয়ারম্যান। ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির ঘটনায় কয়েকজন যুবলীগ নেতা ও ব্যবসায়ীর ব্যাংক হিসাব তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অনেকের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধও করা হয়েছে। ফ্রিজ করা হিসাব থেকে টাকা উত্তোলন এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এবার সেই তালিকায় উঠল যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর নাম।

অনেকে বলেন, এমনই ভাগ্য ওমর ফারুকের। ৬৪ বছর বয়সে হয়েছেন যুবলীগের চেয়ারম্যান। অথচ যুবলীগের ইতিহাসে এর আগে ৫০ বছরের বেশি বয়সি কেউ চেয়ারম্যান হননি। ১৯৭২ সালের ?নভেম্বরে শেখ ফজুলল হক মণি যখন যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন তখন তার বয়স ছিল ৩২ বছর।

উল্লেখ্য, গত ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে হঠাৎ করে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর আওতায় ঢাকায় সন্ধান মেলে একাধিক ক্যাসিনো এবং জুয়ার আসরের। এমনকি অভিযানে আটক ব্যক্তিদের বাসা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে কোটি কোটি টাকাও উদ্ধার করা হয়। আর পুরো অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close