প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ১৪ মে, ২০১৯

শ্রমিক ধর্মঘটে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলে উৎপাদন বন্ধ

মজুরি কমিশন ও বকেয়া বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন দাবিতে অষ্টম দিনের মতো অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট অব্যাহত রেখেছেন রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের শ্রমিকরা। এতে বন্ধ হয়ে গেছে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর উৎপাদন। দীর্ঘদিন ধরে মজুরি না পেয়ে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটানো শ্রমিকরা বলছেন, তাদের পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে গেছে। তাই মিল বন্ধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। তারা বিজেএমসির চেয়ারম্যানের পদত্যাগসহ বিজেএমসি বিলুপ্ত করার দাবি জানান। গতকাল সোমবার থেকে পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেন শ্রমিকরা।

পাটখাতে প্রয়োজনীয় অর্থবরাদ্দ, বকেয়া মজুরি-বেতন পরিশোধ, মজুরি কমিশন কার্যকর ও প্রতি সপ্তাহের মজুরি প্রতি সপ্তাহে প্রদানসহ ৯ দফা দাবিতে এই আন্দোলন করছেন তারা। খুলনা-যশোর অঞ্চলের পাটকল শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক মো. মুরাদ হোসেন বলেন, শ্রমিকরা প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে রাখবেন। নরসিংদীর ঘোড়াশালের বাংলাদেশ জুটমিলে শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ইউসুফ আলী জানান, ৫২০ তাঁতের জুটমিলে প্রায় তিন হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কর্মরত। এক সময় বাংলাদেশ জুটমিল দেশের অন্যতম লাভজনক মিল ছিল। কিন্তু বিজেএমসি কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা ও উদাসীনতার কারণে মিলটি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বিজেএমসি টাকা না দেওয়ায় মিল কর্তৃপক্ষ ১১ সপ্তাহ ধরে শ্রমিকদের মজুরি ও তিন মাস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে পারছে না।

এই জুটমিলের সিবিএ সাধারণ সম্পাদক আখতারুজ্জামান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মজুরি না পেয়ে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাতে গিয়ে আমাদের পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে গেছে। তাই মিল বন্ধ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। আমরা বিজেএমসির চেয়ারম্যানের পদত্যাগসহ বিজেএমসি বিলুপ্ত করার দাবি জানাচ্ছি।

খুলনা ব্যুরো জানায়, বকেয়া মজুরিসহ ৯ দফা দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে খুলনা-যশোরের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকরা গতকাল অষ্টম দিনের মতো কর্মবিরতি কর্মসূচি পালন করেছেন। শ্রমিক নেতারা বলেছেন, আর প্রতিশ্রুতি নয়, শ্রমিকরা বকেয়া মজুরি পাওয়ার পরই কাজে যোগদান করবেন।

গতকাল সকাল ৭টায় খালিশপুর, প্লাটিনাম ও ক্রিসেন্ট জুটমিলের শ্রমিকরা বিআইডিসি রোডে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে। এ সময় বিক্ষুদ্ধ শ্রমিকরা রাস্তার দুই পাশের যান চলাচল বন্ধ কওে দেন। ক্রিসেন্ট, প্লাটিনাম, খালিশপুর, দৌলতপুর, স্টার, আলীম, ইস্টর্র্ন, কার্পেটিং ও জেজেআই জুটমিলের শ্রমিকরা থালা হাতে নিয়ে নিজ নিজ মিল গেটে সমবেত হয়ে ৪টায় বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে নতুন রাস্তা মোড়, আটরা ও রাজঘাটের খুলনা-যশোর মহাসড়ক অবস্থান নেন।

শ্রমিকনেতা দ্বীন ইসলাম বলেন, পাটকলের বিষয় নিয়ে শ্রমিকরা সবচেয়ে অসহায়। পাটখাতকে দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর হাতে জাতীয়করণ করা এ খাতকে আমরা কোনোভাবেই দুর্বল করতে দেব না।

শ্রমিক নেতা মুরাদ হোসেন জানান, প্রধনমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাটখাতকে সব চক্রান্তের হাত থেকে রক্ষা করে এসেছেন। আগামী দিনেও রক্ষা করবেন। শ্রমিকরা বকেয়া না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখবে।

জানা গেছে, খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকলে শ্রমিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বকেয়া মজুরি এবং বেতন ৭৫ কোটি ১৪ লাখ ৭০০ টাকা। আর এসব পাটকলে প্রায় ৩২৫ কোটি টাকা মূল্যের পাটজাত পণ্য মজুদ রয়েছে। বিদেশে বাজার মন্দা হওয়ার কারণে এসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে না। এদিকে শ্রমিকদের অব্যাহত কর্মবিরতি আর অবরোধের কারণে ৮ দিনে খুলনা-যশোর অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকলে পণ্য উৎপাদন বন্ধ থাকায় ৮ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে।

মিল সূত্রে জানা গেছে, ৯টি জুটমিলের প্রতিদিনের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২৭২ টন। সেখানে প্রতিদিন উৎপাদন হচ্ছে ১০০ দশমিক ২৯ টন। এ পরিমাণ পাটজাত পণ্যের বাজার মূল্য ৮০ থেকে ৮৫ লাখ টাকা। সেই হিসেবে ৮ দিনে প্রায় ৮ কোটি টাকার পাটপণ্য উৎপাদন বঞ্চিত হয়েছে। বর্তমানে পাটকলগুলোয় মাত্র ৪৭ হাজার ৭৪৭ কুইন্টাল কাঁচাপাট মজুদ রয়েছে, যা দিয়ে মাত্র ১৫ দিন পাটকলগুলোর উৎপাদন চলতে পারে। এছাড়া মিলগুলোতে ৩২ হাজার ৬৬০ টন হেসিয়ান, সেকিং, সিবিসি ও ইয়ার্ন পাটজাতপণ্য মজুদ আছে।

বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন খুলনা অঞ্চলের সমন্বয়কারী (লিয়াজোঁ কর্মকর্তা) সাজ্জাদ হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের মজুরি-বেতন বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এ কারণে তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। তবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের বকেয়া পাওনা পরিশোধ করার চেষ্টা করছে। আশা করি, খুব দ্রুতই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

প্রসঙ্গত, বর্তমানে খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকলে ১৪ হাজার ৫২৫ স্থায়ী, ১৮ হাজার অস্থায়ী এবং ৫২২ বদলি শ্রমিকসহ ৩৩ হাজার ৪৭ শ্রমিক এবং ১ হাজার ১৮৭ কর্মচারী কর্মরত আছেন।

পলাশ (নরসিংদী) প্রতিনিধি জানান, মজুরিসহ ৯ দফা দাবিতে অর্নিদিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ জুটমিলের উৎপাদন। গতকাল ভোরে বাংলাদেশ জুটমিলের সিবিএ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষরিত নোটিস টানিয়ে মিলের উৎপাদন বন্ধ করা হয়।

এদিকে ১১ সপ্তাহ ধরে বন্ধ রয়েছে শ্রমিকদের মজুরি এবং তিন মাস ধরে বন্ধ রয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন। এতে মিলের প্রায় সাড়ে তিন হাজার শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তারা মজুরি না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

শ্রমিকরা সকালে ধর্মঘট শুরু করে বিক্ষোভ মিছিল করেছে মিলের তিন হাজার শ্রমিক। মিলের প্রধান ফটকের সামনে মিলের সিবিএ সভাপতি ইউসুফ সরদারের সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ নন-সিবিএ সম্মিলিত পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ জুটমিলের সিবিএ সাধারণ সম্পাদক আক্তারুজ্জামান, সিবিএ সহসভাপতি দেলোয়ার হোসেন, সাহেব আলী, যুগ্ম সম্পাদক হারুন অর রশিদ প্রমুখ। বক্তারা শ্রমিকদের প্রস্তাবিত মজুরি বাস্তবায়ন, শ্রমিক কর্মচারীদের বকেয়া মজুরি, শ্রমিকদের গ্রাচুইটি টাকা ও পাট ক্রয়ের টাকাসহ ৯ দফা দাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান।

অপরদিকে মিলের ফিনিশিং বিভাগের শ্রমিক রাশেদ, কারিগরি বিভাগের শ্রমিক আনোয়ার হোসেন, ওয়ার্কশপ বিভাগের শ্রমিক কবির হোসেন জানান, ১১ সপ্তাহ ধরে তাদের মজুরি না দেওয়ায় কষ্টে জীবনযাপন করছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে কোনো মতে সাহ্রি খেয়ে-না-খেয়ে রোজা রাখতে হচ্ছে। কান্নাজনিত কণ্ঠে শ্রমিকরা জানান, বাজারের কোনো দোকানদারও আর তাদের বাকিতে পণ্য দিচ্ছে না।

বাংলাদেশ জুটমিলের মহাব্যবস্থাপক মো. গোলাম রব্বানী মিলের উৎপাদন বন্ধের কথা স্বীকার করে বলেন, এ বিষয়ে বিজেএমসির সঙ্গে কথা বলে সমাধানের পথ বের করার চেষ্টা করছি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close