নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

খেলাপি ঋণ কমাতে কৌশল খুঁজছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

ব্যাংকিং খাতে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যার নাম খেলাপি ঋণ। দীর্ঘদিন ধরে সুশাসন না থাকায় খেলাপি ঋণের সমস্যা জটিল আকার ধারণ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংক খাতে এখন খেলাপি ঋণ ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। এর সঙ্গে ব্যাংকের মূল হিসাব থেকে আলাদা করে রাখা খেলাপি ঋণ অবলোপন আছে আরো ৪৮ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের সঙ্গে অবলোপন করা এই মন্দ ঋণ যুক্ত করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। আদালতে মামলা করেও খেলাপিদের কাছ থেকে এ টাকা আদায় করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। এ অবস্থায় খেলাপি ঋণ আদায়ে আইনি সীমাবদ্ধতাগুলো চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও খেলাপি ঋণ কমাতে নতুন কৌশল খুঁঁজছে। এদিকে নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রী হওয়ার পরপরই আ হ ম মুস্তফা কামাল খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় ব্যাংক মালিকরা বৈঠক করেন এমডিদের সঙ্গে। এ সময় মালিকদের পক্ষ থেকেও খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার নির্দেশনা দেওয়া হয় এমডিদের। প্রায় সব বৈঠকেই খেলাপি ঋণ আদায়ে আইনি সীমাবদ্ধতার বিষয়টি উঠে এসেছে।

এ কারণে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই অংশ হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কার কি করণীয় তা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এর বাইরে আইন কমিশন, আইন মন্ত্রণালয়, বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে যুক্ত করা হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারা নিজেরা দফায়-দফায় বৈঠক করছেন। আবার এক প্রতিষ্ঠান অন্য প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গেও বৈঠক করছেন। সর্বশেষ গত বুধবার আইন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছে বাংলাদেশ ব্যংক।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ যাতে কমে আসে সে ব্যাপারে আমরা সবাই কাজ করছি। এরই অংশ হিসেবে নিজেদের মধ্যে বৈঠক হচ্ছে, অন্যদের সঙ্গেও বৈঠক হচ্ছে। আমরা নিজেরাও পর্যবেক্ষণ করছি, ব্যাংকাররাও করছেন।

এদিকে ব্যাংকের এমডিরা বলছেন, ব্যাংক কোম্পানি আইন, অর্থঋণ আদালত আইন ও দেউলিয়া আইনের কিছু বিষয় সংস্কার দরকার। কারণ অনেকেই ব্যাংকের দায় পরিশোধ না করে আদালতে চলে যাচ্ছেন। সেখান থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসছেন।

এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংক খাতের বড় সমস্যা হলো খেলাপি ঋণ। এই খেলাপি ঋণের কারণেই নানা সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। সরকার ও ব্যাংকাররা উভয়ে চাচ্ছেন খেলাপি ঋণ কমাতে। খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে বাণিজ্যিক ব্যাংক ছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংক, আইন কমিশন, আইন মন্ত্রণালয়, বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় সবাই একসঙ্গে কাজ করবেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এর আগে গত ১৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকে ব্যাংকার্স সভায় খেলাপি ঋণের উচ্চহার কমানোর নির্দেশ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। ওই সভায় খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার জন্য ব্যাংকারদের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, প্রভাবশালীরা মূলত সময়মতো ঋণ ফেরত দিচ্ছেন না। যে কারণে মামলা করেও কোনো ফল পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে ব্যাংকগুলো ঋণ পুনঃতফসিল, সুদ মওকুফ ও পুনর্গঠন করছে। এসব করেই বেশ কয়েকটি ব্যাংক মুনাফাও দেখাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বিএবির সভাপতি ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, বর্তমানে ব্যাংক খাতের বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। এটি কমাতে বিভিন্ন উপায় খোঁজা হচ্ছে। সরকার চাচ্ছে ব্যাংকিং খাতে সংস্কার হোক। আমরাও চাই, কারণ ব্যাংক খাত ভালো থাকলে অর্থনীতিও ভালো থাকবে। তিনি উল্লেখ করেন, আমরা খেলাপি ঋণকে কয়েকটি স্তরে বিন্যাস করতে চাচ্ছি। এর মধ্যে ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ চিহ্নিত করতে হবে।

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই থেকে ডিসেম্বর) ১ হাজার ৯৩৩ কোটি ৯২ লাখ টাকা খেলাপি ঋণ আদায় করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত আটটি ব্যাংক (সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক, বিডিবিএল, বিকেবি ও রাকাব)। যদিও এই ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ আদায়ের টার্গেট দেওয়া হয়েছিল ৫ হাজার ৮০ কোটি টাকা। এছাড়া অবলোপন করা খেলাপি ঋণ থেকে উল্লিখিত আটটি ব্যাংকের আদায়ের টার্গেট ছিল ৫৬১ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলো গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে আদায় করেছে ২০৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম পর্যালোচনায় দেখা গেছে, খেলাপি ঋণ আদায়ে লক্ষ্যমাত্রার ধারে-কাছেও যেতে পারেনি রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংক। এর মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে রূপালী ব্যাংক। একই অবস্থা বেসরকারি খাতের বেশির ভাগ ব্যাংকগুলোরও। এ কারণে চাপে রয়েছে অধিকাংশ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা (এমডি)।

প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। আর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১০ বছরে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে সাড়ে চার গুণ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close