প্রতীক ইজাজ

  ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে স্বাগত সরকারের

সহিংসতা হলে ছাড় নয়

যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরাম নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানালেও কোনো ধরনের সহিংসতা বা নাশকতা মেনে নেবে না সরকার। শুরু থেকেই সরকারের মন্ত্রী, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও শরিক দলের শীর্ষ নেতারা বলে আসছেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রশ্নে এই প্রক্রিয়া কোনো ধরনের উসকানি বা সহিংসতা সৃষ্টি করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন বানচালের যেকোনো অপচেষ্টা প্রতিহত করার ঘোষণাও দিয়েছেন তারা। এমনকি এ ব্যাপারে সরকারের প্রস্তুতি আছে বলেও জানিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা।

গতকাল রাজধানীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নাগরিক সমাবেশের পর এসব হুশিয়ারি পুনরায় উচ্চারণ করলেন ক্ষমতাসীনরা। তারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে একদিকে যেমন এই ঐক্য প্রক্রিয়ার লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন; তেমনি আওয়ামী লীগকে ছাড়া দেশে কোনো ধরনের ঐক্য সম্ভব নয় বলেও যুক্তি তুলে ধরেন। তারা বিএনপিসহ ঐক্য প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার সক্ষমতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। এই সময় আওয়ামী লীগ নেতারা নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রে আবার ২০১৪ সালের মতো সহিংসতা হলে পাল্টা জবাব দেওয়ার জন্য দলীয় নেতাকর্মীদেরও প্রস্তুত থাকারও নির্দেশ দেন।

নাগরিক সমাবেশের ঘোষণাপত্রে উঠে আসা নির্বাচনী দাবিগুলোরও সমালোচনা করেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। তাদের মতে, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনসহ ঐক্য প্রক্রিয়া যেসব দাবি করেছে, তা অসাংবিধানিক। সরকার সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচন করবে। সংবিধানের বাইরে যাবে না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে দুইভাবে দেখছেন। তাদের মতে, যেসব আদর্শের কথা বলে যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরাম জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার কথা বলছে, সেটি হলে সত্যিকার অর্থে দেশের রাজনীতির জন্য ভালো হবে। আর তা যদি না করে কোনো ষড়যন্ত্রের পথে হাঁটে, তা হলে সেটি হবে গোটা দেশের জন্য ক্ষতিকর। তারা আশা করেন, এই প্রক্রিয়া বিএনপিকে জামায়াতে ইসলামী থেকে বের করে এনে নির্বাচনে অংশ নিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। তা হলে দেশের রাজনীতির জন্য কল্যাণকর হবে। একই সঙ্গে তারা জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, আর যদি তা না করে এই প্রক্রিয়া রাজনীতির বাইরে অন্য কিছু চিন্তা করে, তা হলে সেটি হবে নেগেটিভ। এ ব্যাপারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মীজানুর রহমান বলেন, এই জাতীয় প্রক্রিয়াকে ভালোই বলা চলে। ঠিক তফশিল ঘোষণার আগে এমন ঐক্যগুলোকে নির্বাচনী ঐক্য বলা চলে। যেহেতু এসব রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নিজেদের মধ্যে কোনো আদর্শিক মিল নেই, তার মানে এরা নির্বাচনের মাধ্যমে লাভবান হতে চায়। কোনো সুবিধা নিতে চায়। কারণ নির্বাচনে এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষমতা এদের নেই।

‘বিশেষ করে বিএনপিকে যদি জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির থেকে বের করে এনে মূল ধারার রাজনীতিতে দাঁড় করাতে পারে, তবে দেশের রাজনীতির জন্য পজিটিভ হবে’- বলে মত দেন এই বিশ্লেষক। ‘তবে তাদের কেউ কেউ যেভাবে নির্বাচন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন, যদি তারা নির্বাচন বানচালে কোনো অরাজকতা করতে চান, বা ঐক্য প্রক্রিয়ার নামে ‘আউট অব পলিটিকস’ চিন্তা করে, তা হলে সেটি হবে নেগেটিভ’Ñ এমন মন্তব্য করেন এই বিশ্লেষক। তিনি বলেন, তা হলে আমি এদের বলব ‘কিংস পার্টি ইন অ্যাডভান্স’।

অধ্যাপক মীজানুর রহমান আশা প্রকাশ করে বলেন, আমি আশা করব জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া পজিটিভ হবে। তারা নির্বাচনে আসবে। বিএনপিকে নির্বাচনে আনবে। সংবিধানের মধ্যে থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে সাহায্য করবে। বিশেষ করে বিএনপি খালেদা জিয়ার মুক্তি, সংসদ ভেঙে দিয়ে সহায়ক সরকার গঠনসহ যে সব পুরনো অসাংবিধানিক নির্বাচনী দাবি করে আসছে, সেখান থেকে তাদের বের করে এনে যদি নির্বাচনে অংশ নেওয়াতে পারে, তা হলে ঐক্য প্রক্রিয়া ইতিবাচক হবে। এরা আন্দোলন করতে চাইলে ভালো। তবে আন্দোলনের নামে অরাজকতা সহিংসতা করতে চাইলে এই প্রক্রিয়ার কাক্সিক্ষত ফল আসবে না।

‘তারপরও আমি আশাবাদী। আশা করব, তাদের এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশে ইতিবাচক রাজনীতির ধারা বেগবান হবে। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে। একটা সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে। আর যদি তা না করে তবে বলব, তাদের এই উদ্যোগ দেশের রাজনীতি ও নির্বাচনকে বানচাল করার অপচেষ্টা মাত্র’Ñ বলেন এই শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

সরকার ও আওয়ামী লীগ জাতীয় ঐক্যকে স্বাগত জানালেও ঐক্যের এসব দাবি অসাংবিধানিক ও অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করছে অনেক আগে থেকেই। সুষ্ঠু নির্বাচন প্রশ্নে জাতীয় ঐক্যের সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন ক্ষমতাসীনদের কেউ কেউ। এমনকি নির্বাচন সামনে রেখে মিথ্যাচার, সহিংসতায় উসকানিমূলক গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও হুশিয়ারি করে দেওয়া হয়েছে।

এর আগে গত ১৫ সেপ্টেম্বর শনিবার রাতে গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রথম বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানান। তিনি বলেন, তারা রাজনীতি করুক। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটা প্ল্যাটফর্ম তো থাকা দরকার। কিন্তু অন্যকিছু ভাবলে তাদের আশা পূরণ হবে না। এমনকি এই জোটের পক্ষ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি না পাওয়ার অভিযোগের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করুক। আমি কমিশনারকে (ডিএমপি কমিশনার) অনুরোধ করব। এ সময় তিনি আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

গতকাল জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নাগরিক সমাবেশের পর সরকারের মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের নেতারা এই প্রক্রিয়ার নানা দিক নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা করেন। এর মধ্যে সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সমাবেশে বিএনপির অংশগ্রহণের দিকে ইঙ্গিত করে এই প্রক্রিয়াকে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষকদের সাম্প্রদায়িক ঐক্য হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। তিনি এমনও বলেন, আওয়ামী লীগকে ছাড়া বাংলাদেশে জাতীয় ঐক্য সম্ভব নয়। যেখানে শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা ৬৬ পার্সেন্ট, আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ৬৪ পার্সেন্ট, সেখানে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশে জাতীয় ঐক্য সম্ভব নয়। এমনকি তিনি দলের নেতাকর্মীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, সবাই সজাগ থাকবেন, আবার যেন কেউ নাশকতা করতে না পারে। যেকোনো সহিংসতা প্রতিরোধ করতে হবে।

জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানালেও ‘এ ঐক্য যদি পেট্রল বোমা ও অরাজকতা সৃষ্টির হয়, তবে বিগত দিনের মতো জনগণ তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করবে’ বলে মন্তব্য করেছেন নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খান। এ সময় তিনি আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে অংশ নেওয়ার আহবান জানিয়ে বলেন, আপনারা (বিএনপি) অজুহাত দিয়ে পিছিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র করবেন না। নির্বাচনে আসেন। যদি না আসেন, তবু নির্বাচন হবে। যারা আসবেন তাদের নিয়েই হবে।

একইভাবে সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ড. কামাল হোসেন ও বদরুদ্দোজা চৌধুরীর জাতীয় ঐক্যের মূলশক্তি থাকবে বিএনপি-জামায়াত। তারা থাকবেন শুধু সাক্ষী গোপাল মাত্র। ষড়যন্ত্রের এই ঐক্য কোনো ফল দেবে না। আন্দোলন দূরে থাক, তারা একত্রে কোনো কাজই করতে পারবেন না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close