গাজী মো. রাসেল

  ২৪ মে, ২০১৮

মারাকানা ট্র্যাজেডি ও উরুগুয়ের রাজত্ব উদ্ধার

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল হঠাৎ করেই। তবে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ানক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিল দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে। অনেক দিন ধরেই যুদ্ধের একটা আবহ তৈরি হয়েছিল পৃথিবীর বুকে। জার্মানি, ইতালি ও জাপানের পূর্ব পরিকল্পনার চূড়ান্ত ফসল ১৯৩৯ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। গোলা বারুদের এ যুদ্ধের কারণে এক যুগের জন্য নির্বাসনে চলে যায় ফুটবলযুদ্ধ। অবশেষে ১৯৫০ সালে বিশ্বকাপ ফেরে ল্যাটিন আমেরিকায়; বিশ্বমঞ্চ বসে ফুটবলের তীর্থভূমি ব্রাজিলে।

চতুর্থ বিশ্বকাপের একটা কেতাবি নাম দেওয়া হয়েছিলÑ জুলে রিমে কাপ। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে ফিফার সভাপতির দায়িত্ব পালন করা জুলে রিমের সম্মানার্থেই এই নামকরণ করা হয়েছিল।

পরপর দুই আসর ইউরোপ ঘুরে আবার বিশ্ব ফুটবলের মহাযজ্ঞ মঞ্চস্থ হয় দক্ষিণ আমেরিকায়। চতুর্থ বিশ্বকাপে স্বাগতিক ব্রাজিল ও ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইতালির মূলপর্বে খেলাটা নিশ্চিত ছিল। কিন্তু বাকি ১৪ দল নির্ধারণ করতে বেশ বেগ পেতে হয় ফিফাকে। যুদ্ধবাজ জার্মানি ও জাপানকে নিষিদ্ধ করা হয় আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে। দুই আসর বিরতি দিয়ে অভিমান ভেঙে ব্রাজিল বিশ্বকাপ যোগ দেয় প্রথম বিশ্বজয়ী দল উরুগুয়ে।

তবে নিজেদের মহাদেশে বিশ্বকাপের আসর বসায় বাছাইপর্ব না খেলতে বেঁকে বসে আর্জেন্টিনা, পেরু ও ইকুয়েডর। দল তিনটি যোগ দেয় ইউরোপিয়ান তিন জায়ান্ট আগের দুই বিশ্বকাপের রানার্স-আপ হাঙ্গেরি, চেকোসেøাভাকিয়া। বাছাইপর্ব না খেলার আন্দোলনে বাড়তি অনুপ্রেরণা এসব দল পেয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার ও ফিলিপাইন তাদের একাত্মতা ঘোষণা করায়।

সব এশিয়ান দল বিশ্বকাপ বয়কট করার ফায়দাটা তুলে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল ভারত। কিন্তু একমাত্র এশিয়ান দল হিসেবে মূলপর্বের টিকিট পেলেও অদ্ভুত এক দাবিতে বিশ্বকাপ বর্জন করে ভারতীয়রা। বুট পরে খেলতে অস্বীকৃতি জানায় ভারত। খালি পায়ে বিশ্বকাপ খেলার যে দাবিটা তারা তুলেছিল, সেটা নাকচ করে দিয়েছে ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা।

শেষ পর্যন্ত চতুর্থ বিশ্বকাপ মাঠে গড়িয়েছিল কোনো এশিয়ান এবং আফ্রিকান দল ছাড়াই। আগের দুই আসর ষোলো দলের হলেও বহু নাটকীয়তার পর ব্রাজিল বিশ্বকাপ মঞ্চস্থ হয় ১৩টি দল নিয়ে। অংশ নেওয়া দলগুলো হলোÑ ব্রাজিল (স্বাগতিক), ইংল্যান্ড, ইতালি, স্পেন, উরুগুয়ে, সুইডেন, যুগোসেøাভিয়া, সুইজারল্যান্ড, মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, বলিভিয়া, চিলি ও প্যারাগুয়ে। এই আসরে সর্বোচ্চ পাঁচটি ল্যাটিন আমেরিকান দল অংশ নেয়। ইউরোপে ছয়টি এবং উত্তর আমেরিকার দুটি দল ব্রাজিল বিশ্বকাপের অংশ হয়।

চতুর্থ আসরে টুর্নামেন্টের ফরমেট নিয়ে নাটকের নতুন মোড়। নক-আউট পদ্ধতি বাদ দিয়ে প্রথম পর্ব শুরু হয় রবিন লিগ রাউন্ড পদ্ধতিতে। অংশগ্রহণকারী ১৩টি দলকে চার গ্রুপে বিভক্ত করা হয়। গ্রুপ চ্যাম্পিয়নরা শেষ চারের টিকিট পায়। শুরু এবং শেষ দুটোই হলো রবিন লিগ রাউন্ডের মাধ্যমে। ব্রাজিল বিশ্বকাপই একমাত্র বিশ্বিকাপ যেখানে ছিল না কোনো ফাইনালের আনুষ্ঠানিকতা। তাই ব্রাজিল-উরুগুয়ে ম্যাচটা হয়ে যায় টুর্নামেন্টের ‘অলিখিত ফাইনাল’।

এই লড়াইটিই শেষ পর্যন্তু পুরো আসরের মূল অংশ হয়ে থাকল। ঐতিহাসিক মারাকানা স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচে মুখোমুুখি হয় পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষ দুই দল স্বাগতিক ব্রাজিল ও উরুগুয়ে। যেখানে শিরোপা জয়ে ব্রাজিলই ফেবারিট ছিল। নিজেদের মঞ্চে বিশ্বজয়ের সুবর্ণ সুযোগ ছিল সেলেকাওদের সামনে। সমীকরণটাও ছিল ব্রাজিলের অনুকূলে। দুই ম্যাচে দুই জয়ে চার পয়েন্ট ছিল ব্রাজিলের। শেষ ম্যাচে উরুগুয়ের সঙ্গে ড্র করলেই চলত। ৪৭ মিনিটে গোল করে এগিয়েও ছিল স্বাগতিক শিবির। প্রায় দুই লাখ ফুটবলপ্রেমীদের উচ্ছ্বাসে বারবার কেঁপে উঠেছিল মারাকানা স্টেডিয়াম।

৬৬ মিনিটে উরুগুয়ে সমতায় ফিরলেও উল্লাস থামছিল না ব্রাজিলের। কিন্তু ৭৯ মিনিটে মারাকানা স্তব্ধ করে উরুগুয়ের দ্বিতীয় গোলটি করে বসেন অ্যালিসিডেস ঘিয়াগা। রীতিমতো শ্মশানের নীরবতা নেমে আসে মারাকানায়। তাতেই রচিত হলো বহুল আলোচিত ‘মারাকানা ট্রাজেডির’। ব্রাজিলের ইতিহাসে স্মরণকালের সেরা ট্রাজেডির ওপর দাঁড়িয়ে দ্বিতীয়বারের মত শিরোপা উল্লাসে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উরুগুয়ে। পাঁচ পয়েন্ট নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ফোরলান, সুয়ারেজদের দেশ।

ব্রাজিলের দুঃস্মৃতির ক্ষতে সান্ত¡না হয়ে এলো এডমিয়ারের (৮) গোল্ডেন বুট জেতাটা। টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ২২টি গোল হয়েছিল ব্রাজিলের। সেখানে উরুগুয়ে গোল সংখ্যা ১৫! তবে এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছেÑ এই আসরে কেউ দেখেনি লাল কার্ড। পুরো টুর্নামেন্টের একমাত্র হলুদ কার্ড দেখেছিলেন ব্রাজিলের বিগওডি। ব্রাজিল বিশ্বকাপে ফুটবলাররা কতটা শৃঙ্খল ছিল, সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছে এই তথ্যটাই।

বিশ্বকাপ ফ্যাক্টস :

ফাইনাল ছাড়া একমাত্র বিশ্বকাপ হয়েছে ব্রাজিলে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে মাঝের দুটি বিশ্বকাপ হয়নি।

১৯৫০ বিশ্বকাপের নাম পাল্টে রাখা হয়েছিল জুলে রিমে কাপ।

শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে মারাকানা দেখেছে প্রায় দুই লাখ সমর্থক।

পুরো টুর্নামেন্টে রেফারির খরচ হয়েছে মাত্র একটি (হলুদ) কার্ড।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist