এম এ রউফ, মুহাজিরুল ইসলাম রাহাত, সিলেট

  ০৭ এপ্রিল, ২০১৮

ওয়ানস্টপ সেক্সুয়াল সার্ভিসের ঠিকানা ছিল রোকেয়ার বাসা

সিলেটের বারুতখানার মা ও ছেলে খুনের ঘটনায় নিহত রোকেয়া বেগম ও তার সঙ্গে বসবাসরত দুলালের মধ্যে কোনো বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল না। দুলাল রোকেয়াকে রক্ষিতা হিসেবেই ব্যবহার করতেন। সম্প্রতি সেই সম্পর্কেও ফাটল ধরে। এরপর রোকেয়া রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী শহরতলীর মুক্তির চকের নাজমুলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। প্রায় ১০ মাস ধরে রোকেয়া ও নাজমুল মিরাবাজারের খারপাড়া ওই বাসায় বসবাস করেছেন। তারা বৈবাহিক সম্পর্ক ছাড়াই স্বামী-স্ত্রীর মতো বসবাস করতেন। বিষয়টি জানতেন রোকেয়ার স্বজনরাও। দুলালের মতো নাজমুলও রক্ষিতা হিসেবেই ব্যবহার করেছেন রোকেয়াকে। সম্প্রতি এক লন্ডনি মেয়ের সঙ্গে নাজমুলের বিয়ের কথা-বার্তা পাকা হয়ে যায়। আর সেই বিয়ের বাধা হয়ে দাঁড়ান রক্ষিতা রোকেয়া। কোনোভাবে তিনি নাজমুলকে হাতছাড়া করতে চাচ্ছিলেন না। সেই আক্রোশ থেকে খুন করা হয়েছে রোকেয়া বেগমকে। সঙ্গে তার এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া ছেলে রবিউল ইসলাম রূপমকে। সিলেটের কোতোয়ালি থানায় সাংবাদিকদের সামনে গ্রেফতার হওয়া নাজমুলকে হাজির করে পুলিশ তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। পুলিশ জানিয়েছে, ওয়ানস্টপ সেক্সুয়াল সার্ভিসের ঠিকানা ছিল খুন হওয়া রোকেয়ার বাসা।

পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে এসব কিছু পেলেও গ্রেফতার হওয়া নাজমুল খুনের ঘটনা সম্পর্কে এখনো মুখ খুলেনি। সাংবাদিকদের সামনেও বলেছে- ‘আমি ঘটনার কিছুই জানি না।’ তবে রোকেয়ার সঙ্গে তার সম্পর্কে কথা স্বীকার করেছেন।

গত রোববার দুপুরে সিলেট নগরীর মিরাবাজারের খারপাড়ার ১৫- জে, বাসার নিচতলার ফ্ল্যাট থেকে পুলিশ রোকেয়া বেগম ও তার ছেলে রবিউল ইসলাম রূপমের লাশ উদ্ধার করে। ঘটনার সময় বেঁচে যাওয়া রোকেয়া বেগমের ৫ বছরের সন্তান রাইসাকেও পুলিশ আহত অবস্থায় উদ্ধার করে। খুনের ঘটনা সম্পর্কে রাইসা পুলিশকে জানিয়েছে তার মা রোকেয়া বেগমকে খুন করেছে নাজমুল ও ভাইকে খুন করেছে তানিয়া। এরপর থেকে পুলিশ ওই দুইজনকে খুঁজছিল।

এর মধ্যে পুলিশ প্রযুক্তিগত অনুসন্ধান শুরু করে। সেখানে দেখা গেছে রোকেয়া বেগমের মোবাইল ফোনে নাজমুলের যোগাযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি। নাজমুলের মোবাইল ফোনেরও প্রায় সময় অবস্থান ছিল খুনের বাসায়, খুনের ঘটনার সময় নাজমুলের অবস্থানও ছিল ওই বাসাতেই। লাশ উদ্ধারের দিন দুপুর থেকে হঠাৎ করে নাজমুলের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর থেকে সেসব যোগাযোগ বন্ধ করে আত্মগোপনে চলে যায়।

নাজমুলের বাড়ি সিলেটের শাহ্?পরান থানার নিকটবর্তী গ্রাম মুক্তিরচকে। তার বাবা করিম মেম্বার। পুলিশ টানা দুইদিন অভিযান চালিয়ে সিলেট শহরতলীর বটেশ্বর এলাকা থেকে গত মঙ্গলবার গভীর রাতে নাজমুলকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর পুলিশ সিলেটের কোতোয়ালি থানার ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টারে থাকা রাইসাকে নাজমুলের ছবি দেখালে রাইসা নাজমুলকে শনাক্ত করে।

সিলেটের কোতোয়ালি থানার ওসি গৌসুল হোসেন জানিয়েছেন- তারা বিকেলে সিলেট মুখ্য মহানগর হাকিম সাইফুজ্জামান হিরোর আদালতে হাজির করে নাজমুলের ৭ দিনের রিমান্ড চান। আদালত তার ৭ দিনেরই রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। এখন তাকে কোতোয়ালি থানাতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

তিনি আরো জানান, রোকেয়া বেগম সিলেট শহরতলীর দক্ষিণ সুরমার নৈখাই এলাকায় ভাইদের সঙ্গে জমি কিনেছেন। সেখানে প্রায় ৩০ লাখ টাকা ব্যয় করে তিনি বাসা তৈরির করছেন। এছাড়া সিলেট নগরীর মিরাবাজারে যে বাসায় বসবাস করতেন সে বাসার ভাড়া ছিল ১৫ হাজার টাকা। সেই বাসা আধুনিক ফার্নিচারে সুসজ্জিত ছিল। পুলিশ রোকেয়া বেগমের কললিস্ট পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে তার সঙ্গে সিলেট নগরীর বহু হাই প্রোফাইল মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। এরই মধ্যে পুলিশ দুইজনকে শনাক্ত করেছে। তাদের বিষয়েও তদন্ত চলছে।

কোতোয়ালি থানা পুলিশ জানিয়েছে- রোকেয়া বেগমের বাসায় ঘটনার দিন বেশকিছু আলামত উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ছিল বেনসন সিগারেটের প্যাকেট, ইয়াবা সেবনের সরঞ্জামাদি, কয়েকটি কনডমের প্যাকেট। পুলিশ জানায়- রোকেয়া বেগমের বাসা ছিল ওয়ানস্টপ সেক্সুয়াল সার্ভিসের ঠিকানা। তার ওখানে অনেকেই যেত এবং তারা নিরাপদে সেক্স করার সুযোগ পেত। পাশাপাশি মাদকও পাওয়া যেত। আর এটিই ছিল রোকেয়ার আয়ের অন্যতম উৎস। তানিয়া নামের ওই যুবতী রোকেয়ার বাসার কাজের মেয়ে ছিল না। তানিয়াও ছিল যৌনকর্মী। সে পুরুষদের নিয়ে ওই বাসাতে যেত এবং সেখানে পুরুষদের সঙ্গে মিলিত হত। তানিয়া হয়তো আসল নাম নয়, এমনই সন্দেহ করছে পুলিশ। তাকে এখনো গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। যৌন ব্যবসার টাকা ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে তানিয়ার সঙ্গে কয়েক দিন আগে বিরোধ বাধে রোকেয়ার। এই বিরোধের জের ধরে তানিয়াই বাসায় নিয়ে এসেছিল এলাকার যুবক কাঞ্চা সুমনসহ কয়েকজনকে। এরপর থেকে কাঞ্চা সুমন ও তার বন্ধুরা প্রায়ই ওই বাসায় গিয়ে আমোদ-ফুর্তি করত।

পুলিশ জানায়- নিহত রোকেয়ার বাসা থেকে যে কম্পিউটার ও ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়েছে সেখানে প্রায় ৪০ নারীর ছবি পাওয়া গেছে। এসব ছবির মধ্যে কোনো কোনো নারীর ছবি অর্ধনগ্ন আবার কোনো কোনোটি ছিল পুরো নগ্ন। পুলিশ ধারণা করে- এসব নারীরা তানিয়ার বাসায় যেত। তারা খদ্দেরদের মনোরঞ্জন করত। এসব নারীর সন্ধানও পুলিশ করছে।

তার বাসায় এসব মানুষের অবাধ যাতায়াতে এলাকার মানুষ প্রায়ই বিব্রত হত। রোকেয়ার বেপরোয়া জীবনযাপন তাদের কাছে ধরা পড়ে। এ কারণে সেখানে বসবাস করা রোকেয়ার জন্য দায় হয়ে পড়েছিল।

ভয় এখনো তাড়া করছে রাইসাকে

জান্নাতুল ফেরদাউস রাইসা। বয়স পাঁচ বছর। ছোট্ট ওই শিশুটির চোখের সামনেই হত্যা করা হয়েছে তার মা ও ভাইকে। ঘাতকরা তাকেও হত্যার উদ্দেশে গলা টিপে ধরেছিল, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর মৃত ভেবে ফেলে রেখে যায়। মা-ভাইয়ের লাশের সঙ্গে তার কেটেছে দুইদিন। সে ভয় এখনো তাড়া করে বেড়ায় শিশু রাইসাকে। পুরুষ দেখলেই ভয়ে আঁতকে উঠছে সে, লুকিয়ে রাখছে নিজেকে। ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনো তাকে এমন অস্বাভাবিক আচরণ করতে দেখা যায়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিলেটের কোতোয়ালি থানার এসআই রোকেয়া খানম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন- বেঁচে যাওয়া রাইসাকে ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখা হয়েছে। তার এক আত্মীয় সঙ্গে রয়েছেন।

শিশু রাইসার বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গৌছুল হোসেন বলেন, রাইসার মনে এখনও ভয় কাজ করছে। সে তার রুমের চাবি বারবার লুকিয়ে রাখছে। তার ধারণা, কেউ এসে তাকেও মেরে ফেলবে। তিনি বলেন, চোখের সামনে মা-ভাইয়ের নৃশংস খুনের দৃশ্য হয়তো ভুলতে পারছে না শিশুটি। তাকে খেলনা দিয়ে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করা হলেও মাঝেমধ্যে সে তার মা-ভাইকে খুঁজছে।

ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টারের দায়িত্বরত এক নারী পুলিশ সদস্য জানান, রাইসার শরীরে হাত দেওয়া যাচ্ছে না, বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। খেলাধুলার ফাঁকে যখন মা ও ভাইকে খোঁজ করে তখন খুব কষ্ট হয়। কী বলে যে সান্ত¦না দেব এই শিশুটিকে তা ভেবে পাই না।

সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মুহম্মদ আবদুল ওয়াহাব বলেন, লোমহর্ষক স্মৃতির বৃত্ত থেকে রাইসাকে বের করে আনতে মনোবিদের সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন। তিনি ‘প্রতিদিনের সংবাদ’কে বলেন, রাইসা এখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে পরামর্শ করবেন বলেও তিনি জানান।

কোতোয়ালি থানার ওসি গৌছুল হোসেন জানান, গ্রেফতারের পর নজরুলের ছবি রাইসাকে দেখানো হলে সে নজরুলকে চিনতে পেরেছে। সে বলেছে ‘তাইন আমার নজরুল আংকেল’ (উনি আমার নজরুল চাচা)। হত্যার সময় তানিয়ার সঙ্গে যে কয়জন ছিল তাদের মধ্যে নজরুলও ছিল বলে পুলিশকে জানিয়েছে রাইসা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist