প্রতীক ইজাজ

  ০৯ জানুয়ারি, ২০১৮

প্রত্যুত্তরে পুরনোরাও

নানা কথনে আলোচনায় নতুন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা

দায়িত্ব পাওয়ার পর এক সপ্তাহও পেরোয়নি। এরই মধ্যে নানা কথন ও মন্তব্যের ফুলঝুরিতে বেশ আলোচিত হয়ে পড়েছেন সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত নতুন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা। তাদের কথার উত্তর দিতে গিয়ে আলোচনায় জড়িয়ে পড়ছেন দফতর বণ্টন হওয়া পুরনো মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরাও। তাদের এমন কথনে অন্যান্য জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীসহ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতারা কিছুটা বিব্রত অবস্থায় পড়েছেন। এ নিয়ে সরকারের ভেতর ও বাইরে নানা আলোচনা চলছে।

নতুন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা একদিকে যেমন মন্ত্রিত্ব পাওয়ায় দল ও সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন; তেমনি দায়িত্বের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে গিয়ে অবচেতনভাবেই তুলে ধরছেন ওই মন্ত্রণালয়ের বিগত সময়ের নানা অনিয়ম ও ভুলত্রুটি। ব্যর্থতার কথা বলতে গিয়ে বিতর্কের মুখে ফেলছেন তার দফতরের সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের। এর ফলে ওইসব মন্ত্রীর সঙ্গে কিছুটা হলেও মনোমালিন্যের সৃষ্টি হচ্ছে নতুন মন্ত্রীদের। বিশেষ করে দফতর বদল হওয়া মন্ত্রণালয়ের বেশির ভাগ মন্ত্রীই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের হওয়ায়, এ নিয়ে শরিকদের সঙ্গেও আওয়ামী লীগের এক ধরনের ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মন্ত্রী-সাংসদদের অতিকথন দেশে বহুল প্রচলিত। এ ধরনের কর্মকা-ের কারণে অনেক প্রভাবশালী নেতাকে মন্ত্রিত্ব পর্যন্ত ছেড়ে দিতে হয়েছে। সর্বশেষ গত বছরের ১৭ আগস্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মেজর জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি উল্লেখ করে তুমুল বিতর্কের জন্ম দেন এমপি সুবিদ আলী ভূঁইয়া। ইতিপূর্বে বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলেও মন্ত্রীরা বেফাঁস কথা বলে সরকারকে বিপাকে ফেলেছে। তৎকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী ‘আল্লাহর মাল আল্লায় নিছে’ এবং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ‘উই আর লুকিং ফর শত্রুজ’ বলে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন।

আওয়ামী লীগ সূত্রমতে, মন্ত্রীদের নানা মন্তব্য ও বক্তব্যে সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী ও শীর্ষ কর্মকর্তারা অনেকেই বিব্রত। তারা একে অন্য মন্ত্রী এবং সরকারকে হেয়প্রতিপন্ন করার বক্তব্য হিসেবেই দেখছেন। তাদের বক্তব্য অনেকক্ষেত্রেই অপ্রাসঙ্গিক ও অতিকথন বলেও মনে করছে সরকারের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো। তাদের মতে, এমন অতিকথনে তারা নিজেরা যেমন হাস্যাস্পদ হচ্ছেন, তেমনি সরকারকে বিব্রত করছেন। একাধিক সিনিয়র মন্ত্রী নব্য মন্ত্রিত্ব প্রাপ্তদের কথাবার্তায় আরো সংযমী হয়ে কাজেই নিজের পরিচয় দিতে বলেন। তাদের মতে, জনগণ এখন অনেক সচেতন, কথায় আর চিড়ে ভেজে না, কাজ দিয়েই নিজের দক্ষতার প্রমাণ দিতে হবে।

তবে নতুন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের এমন মন্তব্যকে ‘অতিকথন’ বলতে নারাজ আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য পীযুষ কান্তি ভট্টাচার্য্য। তিনি বলেন, ??মন্ত্রিসভার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যাদেরকে নির্বাচিত করেছেন, তা সঠিক। অতিকথন হচ্ছে, এটা আমি মনে করি না। বিমানমন্ত্রী যা বলেছেন, তার প্রমাণ তিনি রাখতে পারবেন কি না, এটা বলার সময় এখনো আসেনি। সবার বেলায়ই এটা সত্য। সবে তো তারা দায়িত্ব নিয়েছেন। আর বিমানমন্ত্রী হিসেবে রাশেদ খান মেননের ব্যর্থতা আছে। তাকে বদলানোর সিদ্ধান্তও সঠিক।

গত ২ জানুয়ারি পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে তিনজন ও প্রতিমন্ত্রী হিসেবে একজন শপথ নেন। এদের মধ্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দকে তার আগের কর্মস্থল মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, এ কে এম শাহজাহান কামালকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী, তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মোস্তাফা জব্বারকে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী এবং কেরামত আলীকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের প্রতিমন্ত্রী করা হয়। সেই সঙ্গে বেশকিছু দফতরও বণ্টন করা হয়। এর মধ্যে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেননকে সমাজকল্যাণমন্ত্রী করা হয়েছে। পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে করা হয়েছে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী। এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আনোয়ার হোসেনকে করা হয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রী। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে। এ ছাড়া সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে কাজ করে যাওয়া নুরুজ্জামান আহমেদকে একই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে।

দায়িত্ব পাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই নানা ধরনের মন্তব্য করে আলোচনায় চলে আসেন নতুন ও পুরনো এসব মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী। সেসব মন্তব্য বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে গণমাধ্যম। ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। এদের মধ্যে মন্তব্যে এগিয়ে রয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী এ কে এম শাহজাহান কামাল। দায়িত্ব পেয়ে এক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি রক্ত দিয়ে হলেও বিমানকে লাভজনক করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তার এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সে মন্ত্রণালয়ে চার বছর দায়িত্ব পালনের পর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়া রাশেদ খান মেনন তাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, এই মন্ত্রণালয়কে ঘিরে অনেক বদনাম আছে। এটি একটি আগুনের কু-। আমাদের সব সফলতা এই বিমান ধ্বংস করে দেয়। এগুলো মাথায় রেখে আপনাকে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

মোস্তাফা জব্বারের মন্তব্যও বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি মন্তব্য করেন, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ ক্যানসারে আক্রান্ত। অন্ধ গলিতে আছে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ। এমনকি ‘আমি বিটিআরসির ওপর ক্ষুব্ধ’ মন্তব্য করে এই নতুন মন্ত্রী বলেন, কেন তারা এখনো ইন্টারনেটের মূল্য নির্ধারণ করে দিতে পারেনি? কমায়নি। এই মন্ত্রী সরকারের মন্ত্রণালয় ও সেবাখাতকে ডিজিটালাইজড করার প্রতিশ্রুতিও দেন। পরে গত শনিবার এই নতুন মন্ত্রী এমন মন্তব্যও করেন, প্রধানমন্ত্রী আমাকে একটি ডুবন্ত নৌকা জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব দিয়েছেন। আমি এই নৌকাকে সফলভাবে জাগিয়ে তুলতে পারব এমন আস্থা ও বিশ্বাস থেকে প্রধানমন্ত্রী আমার ওপর এ দায়িত্ব দিয়েছেন। আমি সফল হলে প্রধানমন্ত্রীও সফল হবেন, শক্তিশালী হবেন। তার সম্মান রাখার জন্য আমি চেষ্টা করে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে জাগিয়ে তুলব। বিশেষ করে ‘আমার মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগসহ সব ভাষা হবে বাংলা’ এমন মন্তব্য বেশ সাড়া ফেলেছে।

আগামীতে যেন প্রশ্নপত্র ফাঁস না হয় সে চেষ্টা করা হবে বলে জানিয়েছেন কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলী। তিনি আরো বলেন, একটি কুচক্রী মহল প্রশ্নপত্র ফাঁস করার মাধ্যমে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করছে। এদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা কেউ না ঘটাতে পারে।

নতুন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের এমন মন্তব্যে কিছুটা হলেও ক্ষুব্ধ পুরনো দফতর হারিয়ে নতুন দফতর পাওয়া কিছু মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী। দায়িত্ব পরিবর্তনের পর ফেসবুকে ও গণমাধ্যমে মন্তব্য করেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। তিনি বলেন, আমি যদি কাজ না করতাম তাহলে এই শকটা পেতাম না। অবৈধ ভিওআইপির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলাম। তার ফল কি এটা হতে পারে? আমি ফেরেশতা নই, মানুষ, কষ্ট তো হবেই।

তিন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর দফরত বদলের কারণ একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলতে পারবেন বলে মন্তব্য করেন পানিসম্পদমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলতে পারবেন কেন, কিসের জন্য তিনি পরিবর্তন করেছেন। এ বিষয়ে আমার কোনো ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়া নেই। আমি কুম্ভ রাশির জাতক, কাজের লোক। আমাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, সেটা কেমন করেছি জনগণই বিচার করবে।

একইভাবে নতুন মন্ত্রণালয় পাওয়ার পর এক প্রতিক্রিয়ায় সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, দফতর বদল আমার জন্য সুখকর এই কারণে বলতে পারেন, আমি আকাশ থেকে একটু মাটিতে নামলাম। সামাজিক নিরাপত্তার প্রশ্নে বলেন, সামাজিক কল্যাণের প্রশ্নে বলেন, একেবারে সাধারণ মানুষের কাছে।

এর আগে গত বছর আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোট সরকারের নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, খাদ্যমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের অতিকথনে বেশ বিব্রত অবস্থায় পড়েছিল সরকার। ২০১১ সালের আগস্ট মাসে নৌমন্ত্রী ‘যারা সিগনাল চেনে, গরু-ছাগল চেনে, মানুষ চিনলেই তারা ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে পারে’ বলে বক্তব্য দিয়ে সমালোচনার ঝড় তুলেছিলেন। গত বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের এক অনুষ্ঠানে বিগত বাংলা নববর্ষ বরণে ঘটে যাওয়া নারী নিগ্রহকে ‘তেমন কিছু নয়’ এবং ‘এ ধরনের টুকিটাকি ঘটনা ঘটতেই পারে’ এমন বক্তব্য দিয়ে দেশজুড়ে আবারও সমালোচনার ঝড় তোলেন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর বিচার নিয়ে প্রধান বিচারপতিকে জড়িয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে তুমুল আলোচনায় আসেন খাদ্যমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তখন মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খাদ্যমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলামকে সতর্ক করে ধমক দিয়েছিলেন বলে গণমাধ্যমে খবর হয়েছিল। এছাড়া অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের শেয়ারবাজার, হলমার্ক ও জাতীয় বেতন স্কেল নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে সরকারকে কয়েক দফায় বিব্রত হতে হয়েছে। সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী প্রয়াত মহসিন আলী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের বেফাঁস কথার ধকল সরকারকে বইতে হয়েছে। বাড়িঘর তালা মেরে ঈদের ছুটিতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে আলোচনার ঝড় তুলেছিলেন মন্ত্রী সাহারা খাতুন। বাণিজ্যমন্ত্রী থাকা অবস্থায় কর্নেল (অব.) ফারুক খান কাঁচাবাজারে গিয়ে জনগণকে কম খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বিতর্কের ঝড় তুলেছিলেন। এছাড়া চট্টগ্রামের দলীয় এমপি আবদুল লতিফ কম্পিউটার প্রোগ্রামের ফটোশপের মাধ্যমে ‘নিজের শরীরের অংশের’ সঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মুখম-ল লাগিয়ে তুমুল বিতর্কের জন্ম দেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist