এস আর শানু খান

  ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৭

বিশ্লেষণ

৪৭ থেকে ৭১ এবং অতঃপর

১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস বা জাতীয় দিবস। বাঙালি জাতির জাতীয় জীবনে অবিস্মরণীয়, বরণীয় ও গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন। এই দিনেই বাঙালি জাতি বিশ্ব মানচিত্রে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করেছিল। বিজয় দিবসের সঙ্গে বাঙালি জাতির রক্তাক্ত সংগ্রামের ইতিহাস জড়িত। এই দিনটিকে ঘিরে এমন একটি ঐতিহাসিক পটভূমি

রয়েছে যেটা এখনো ক্ষণে ক্ষণে প্রতিটি মানুষের মনে দাগ কেটে যায়।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত থেকে বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের সূচনা হলেও বাঙালির স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রাম শুরু হয়েছিল তার অনেক আগেই। ১৯৪৭ সালে দেশে বিভাজনের ফলে সৃষ্ট দুই পাকিস্তানের একটি ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। যেটি আজকের পাকিস্তান। আর অপরটি ছিল পূর্ব পাকিস্তান। মূলত পূর্ব পাকিস্তান ছিল নামেমাত্র একটা সূত্র। পূর্ব পাকিস্তানের সহজ-সরল শান্তিপ্রিয় মানুষদের শোষণ করার একটা পরিকল্পিত আঁকা নকশা। দেশের সকল প্রকার কর্মকান্ড, অফিস, আদালত ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানের সকল নিয়ন্ত্রণ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে। কারণে-অকারণে নানা রকম প্রতিকূলতা আর দুঃখ দুর্দশাকে ঠেলে দেওয়া হতো পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ বাঙালির ওপর। সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হতো বাঙালিদের। নায্য অধিকার, নায্য দাবিগুলো থেকে সরিয়ে রাখার জন্য ছলাকলা অব্যাহত রাখা হতো। অকথ্য সব লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শিকার বাঙালি নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই শুরু করে। পশ্চিমাদের শাসন-শোষণ আর নানা নিপীড়ন থেকে নিজেদের বের করে আনতে তারা সচেষ্ট হয়েছিল পাকিস্তান সৃষ্টির সেই সূচনালগ্ন থেকেই। তারই প্রতিফল নানা সময়ে নানা রকম আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে গণআন্দোলনের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মাতৃভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাজপথ রঞ্জিত করেছিল সালাম, বরকত, জব্বার, শফিউল্লাহসহ আর নাম না-জানা তরুণরা। ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল মাতৃভাষাকে। ব্যর্থ হয়েছিল শত্রুদের সব ষড়যন্ত্র, সব ধরনের রণকৌশল। আর এটাই পরবর্তীতে সাহস জুগিয়েছিল বাঙালিকে। এই একুশের চেতনাই ১৯৬৯ সালে এদেশের মানুষকে গণ-অভ্যুত্থান ঘটাতে সাহস জোগায়। যার পরিণামও ছিল ভয়াবহ। পশ্চিমা শাসকরা বাঙালিদের স্বাধিকারের নায্য দাবিকে নস্যাৎযজ্ঞ শুরু করে। শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দমননীতি চালাতে থাকে। নিরস্ত্র হওয়া সত্ত্বেও বাঙালিরা এগুলো নীরবে মেনে নিতে

পারছিল না কোনোভাবেই। তাই তারা ঐক্যবদ্ধভাবে গড়ে তুলেছিল এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি। বাঙালিরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলে এবং যার কাছে যা ছিল তাই নিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়ে। ঝাঁপিয়ে পড়ে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ চলে। অসংখ্য বাঙালি মুক্তিসেনা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

মুক্তিবাহিনী দেশের ভেতরে ও বাইরে শত্রুদের পর্যুদস্ত করার লক্ষ্যে দুর্বার সংগ্রাম চালাতে থাকে। বাঙালির অদম্য সাহসের কাছে হার মানতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি শাসকরা। অবশেষে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় তারা। পূর্ব পাকিস্তান পরাধীনতার চরম শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে মুক্তি লাভ করে এবং একটি নতুন বাংলাদেশের জন্ম হয়। ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা। কিন্তু এ স্বাধীনতা সংগ্রাম হুট করেই দানা বেঁধে ওঠেনি। তেমনি আমাদের জাতিগত সংগ্রামও একদিনে গড়ে ওঠেনি। বুক ভরা প্রত্যাশা নিয়ে উদার সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, নিরপেক্ষতাবাদের সহিষ্ণুতা এবং সমাজতন্ত্রের সাম্য ও ন্যায়ভিক্তিক আদর্শে ১৯৭১ সালে প্রত্যাশিত সংবিধান প্রণীত হয়। কিন্তু এই কষ্টে অর্জিত প্রাপ্তির যথাযথ সুরক্ষা আমরা করতে পারিনি কখনো। বারবার ব্যর্থ হয়েছি নানাভাবে। স্বাধীন জাতি, সাহসী জাতি আজ ব্যর্থতায় নিমজ্জিত। গোটা সমাজ আজ নানা প্রতিকূলতায় আটকে গেছে। স্বপ্নের বাংলাদেশে আজ নানা সংকট। সামগ্রিকভাবে বিরাজমান হতাশা, নৈরাজ্য, অর্থনৈতিক সংকট, দ্রব্যমূল্য ও মুদ্রাস্ফীতির আবর্তে জনজীবন আজ দুর্বিষহ ও বিপর্যস্ত। নিরন্ন মানুষের মুখে আজও আমরা হাসি ফোটাতে পারিনি। পারিনি মৌলিক অধিকারকে নিশ্চিত করতে। আধুনিক বিশ্বের উন্নয়নমূলক সমৃদ্ধিকে আজও আমরা স্পর্শ করতে পারিনি সম্পূর্ণরূপে। বাঙালি জাতি পরাধীনতার বেড়ি থেকে বেরিয়ে আসতেই মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেছিলেন এবং দুর্ভাগ্য হলেও এ কথা সত্য যে, স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় চার যুগ অতিবাহিত হলেও চারপাশে তাকালে এখনো কেন জানি মনে হয় পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে সম্পূর্ণরূপে বের হতে পারিনি আমরা। পারিপার্শ্বিক নানা দেশের নানা রণ-ফাঁদে আজও আমরা পা দিয়ে পড়ে আছি। কখনো সে ফাঁদ থেকে বের হওয়ার কিঞ্চিৎ চেষ্টাও আমরা চালাই না। নিজেদের জীবনকে দেশের স্বাধীনতা, স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামে বিলীন করে দিয়ে যাওয়া মানুষগুলো কখনো ভাবেননি যে, তাদের উত্তরসূরিরা এমন পরিস্থিতি ডেকে আনবে এই দেশের বুকে। যেমনটা আজও আমরা পোহাচ্ছি। দরিদ্রতা আমাকে বেড়ি পরিয়ে রেখেছে। উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। বাঙালি জাতির মেরুদন্ডকে দুর্বল করে নানা অন্যায়, অপরাধ, তার রন্ধে রন্ধে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু এখানে শেষ করলে চলবে না। শুধু খারাপ দিকগুলো বিবেচনা করলেই চলবে না। যাই হোক না কেন আমাদের এ অর্জনকে, এই স্বাধীনতাকে কখনো কোনোভাবে ছোট করে দেখার অবকাশ নোই। কেননা আমাদের দেশের অবস্থাকে অবজ্ঞা করে বলা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ থেকে আজ আমরা মুক্ত। কেননা ব্যাপকভাবে না হলেও মোটামুটিভাবেই আমরা অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা স্বাবলম্বী হতে

পেরেছি। হয়তো মানবসম্পদ উন্নয়নে আমরা

বেশি পথ এগোতে পারিনি, কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে

আমরা অনেক বেশি অগ্রসর হয়েছি। যেটা সত্যিকার অর্থেই আমাদের কল্পনার বাইরে। বিজয়ের চেতনায়ই

আমরা এখন পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের মতো স্বপ্নকে

বাস্তবে রূপ দিতে চলেছি। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি দুর্নিবার গতিতে। রাস্তাঘাট, পুল,

কালভার্ট, ফ্লাইওভারসহ নানা উন্নয়নশীল উপকরণ দিয়ে সাধ্যের মধ্যেই সাজিয়ে তুলতে চেষ্টা করছি স্বপ্নের বাংলাদেশকে। যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেই লাখ লাখ বাঙালি নির্দ্বিধায় তাদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিল। স্মৃতি বিজড়িত একটা স্বাধীন বাংলাদেশ আজ পদার্পণ করেছে আশা ও আনন্দের এক নতুন শতাব্দীতে। বাংলাদেশ এখনো আর কোনো ক্ষুদ্র অনুন্নত, শিশু রাষ্ট্র নয়; নয় কোনো বিধ্বস্ত দেশ। প্রাপ্তির আলোয় আজ প্রত্যাশাকে দেখার সময়। সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরমক্ষণÑভবিষ্যতের স্বপ্নের মুহূর্ত। বিগত বছরগুলোর সব ব্যর্থতার গ্লানি মুছে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে আমাদের এ দেশকে। ব্যর্থতার ভিড় থেকেই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে সফল, সমৃদ্ধ ও আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist