ইফতেখার আহমেদ টিপু

  ২৩ জুন, ২০১৭

পরিবেশ

পাহাড়কে ভালোবাসতে শিখুন

রাঙামাটিসহ পার্বত্য তিন জেলায় খাদ্য ও জ্বালানি সংকট তীব্রতর হচ্ছে। পাহাড়ধসে পার্বত্য এলাকার সঙ্গে চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য স্থানের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় সেখানে মানবিক সংকট মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। পাহাড়ধসে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় পার্বত্য এলাকায় খাদ্য ও জ্বালানি পাঠানোর সহজতম পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। পাহাড়জুড়ে বিরাজ করছে খাদ্য-জ্বালানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অভাব। প্রশাসন পার্বত্য এলাকায় নিত্যপণ্যের সরবরাহ বাড়ানো এবং দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করলেও তা খুব একটা ফলপ্রসূ হচ্ছে না।

পার্বত্য তিন জেলার সঙ্গে চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য এলাকার সড়কপথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় কয়েক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সড়ক যোগাযোগ পুনঃস্থাপনে সেনাবাহিনীর সদস্যসহ এলাকাবাসী নিরন্তর চেষ্টা চালাচ্ছেন। যোগাযোগ পুনঃস্থাপনের আগে পাহাড়ে বিদ্যমান সংকট মোচনের উপায় নেই বললেই চলে। দেশের অন্যান্য অংশ থেকে সড়কপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সংকট যেমন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তেমনি হাজার হাজার মানুষ কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। এ সংকট মোচনে নৌপথে পার্বত্য তিন জেলায় খাদ্যসহ নিত্যপণ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। সড়ক যোগাযোগ পুনঃস্থাপনের প্রয়াসকে আরো বেগবান করতে হবে।

পাহাড়ি এলাকার দুর্গত মানুষের ত্রাণ তৎপরতাও জোরদার করা দরকার। পাহাড়ধস যেকোনো পাহাড়ি এলাকার যাপিত জীবনেরই অনুষঙ্গ। এ বিপদ ঠেকাতে গাছপালা নিধন এবং পাহাড় কাটার কা-জ্ঞানহীনতার অবসান ঘটাতে হবে। পাহাড়ের ঢালে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে ঘরবাড়ি নির্মাণ কঠোরভাবে রোধ করতে হবে। বাসস্থান অবশ্যই মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। তবে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে ঘরবাড়ি তৈরি করে নিজেদের জীবন বিপন্ন করার বিষয়টি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। পাহাড়ধসের বিপদ ঠেকাতে স্থানীয় সরকারসহ সরকারি প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা গড়ে তোলার দিকেও নজর দিতে হবে। পাহাড়ি এলাকার রাস্তাঘাট নির্মাণ ও উন্নয়নকাজে পাহাড়ের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারেও থাকতে হবে সতর্ক। পার্বত্য তিন জেলা বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পাহাড়ে বসবাসকারী নাগরিকদের বিপদের দিনে পুরো জাতিকে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। বাড়াতে হবে সহমর্মিতার হাত।

শুধু প্রাকৃতিক কারণেই পাহাড়ধসে পড়ছে, তা কিন্তু নয়। নিয়ন্ত্রণহীন পাহাড় কাটা, পাহাড়ে স্থাপনা নির্মাণসহ আরো কিছু অপরিণামদর্শী মনুষ্য তৎপরতার পরিণামে ধসে পড়ছে পাহাড়। বর্ষায় প্রাণহানি ছাড়াও পরিবেশ-প্রকৃতিতে এর ভয়ংকর বিরূপ প্রভাব নিয়ে কারো কোনো চিন্তা আছে বলে মনে হচ্ছে না। নির্বিচারে পাহাড় কেটে অসংখ্য ঘরবাড়ি তৈরি করা হয়েছে। পাহাড় কেটে চলছে প্লট ও ফ্ল্যাট বিক্রির রমরমা বাণিজ্য।

দীর্ঘকাল ধরে পাহাড় কাটা, স্থাপনা নির্মাণ, পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা গাছপালা উজাড়ের ফলে পাহাড়ের অবশিষ্ট মাটি আলগা হয়ে যায়। যার ফলে বৃষ্টি হলে পাহাড়ের গা বেয়ে তীব্র বেগে নেমে আসা ঢল আলগা মাটি ধুয়ে নিয়ে নিচে নামতে থাকে। পাহাড় হয়ে পড়ে দুর্বল, জীর্ণশীর্ণ। ঘটে পাহাড়ধস। মারা যায় পাহাড়ের ঢালে বস্তিতে বাস করা নিম্ন আয়ের হতদরিদ্র, ছিন্নমূল মানুষ। শুধু বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ের ঢালের বসতি উচ্ছেদের ব্যবস্থা করলেই সমস্যার সমাধান হবে না, পাহাড়ধস ঠেকানোরও উদ্যোগ নিতে হবে। বন্ধ করতে হবে পাহাড় কাটা, পাহাড়ের বৃক্ষ উজাড়, উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ।

পাহাড়ে অনিয়ন্ত্রিত বসতি গড়ে তোলা, নির্বিচারে পাহাড় কাটা, গাছপালা নিধন এবং অপরিকল্পিতভাবে রাস্তাঘাট নির্মাণের কারণে পাহাড়ধসের বিপর্যয় নেমে আসছে। বারবার মৃত্যু হানা দিচ্ছে পাহাড়ের ঢালে বসত করা গরিব মানুষদের দিকে। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। পাহাড়ধসে মৃত্যু সাংবার্ষিক বিষয় হয়ে দাঁড়ালেও গত সোম ও মঙ্গলবারের পাহাড়ধস অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ছবির মতো সাজানো জনপদ রাঙামাটিকে যেন এবড়ো-থেবড়ো করে দিয়েছে কোনো ভয়াল দৈত্য। রাঙামাটি শুধু নয়, পার্বত্য তিন জেলায় এমন বিপর্যয়কর ঘটনা অতীতে কখনো ঘটেনি। মাত্র কদিন আগে লংগদু উপজেলায় এক বাঙালি যুবকের হত্যাকা-কে কেন্দ্র করে বাঙালি ও পাহাড়িদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিলেও পাহাড়ধসের ঘটনায় দুই সম্প্রদায়কে যেভাবে একে অপরের বিপদে এগিয়ে আসতে দেখা গেছে, তা এক আশাজাগানিয়া ঘটনা। পাহাড়ি বাঙালি একে অন্যের জন্য যেভাবে ছোটাছুটি করছেন, একে অন্যের শোকে যেভাবে কাঁদছেন, তাতে পাহাড়ি এলাকার হৃদয়ের প্রতিচ্ছবিই যেন ফুটে উঠেছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় সংকীর্ণতাকে হটিয়ে মানবিক সত্তাকে সামনে আসতে সাহায্য করেছে। এ সম্প্রীতি বহাল থাকলে পাহাড়ি এলাকার পুনর্বাসন যেমন দ্রুততর করা সম্ভব হবে, তেমনি গড়ে উঠবে সম্প্রীতির পরিবেশ। আমরা আশা করব, নিজেদের স্বার্থেই পার্বত্য তিন জেলায় বসবাসকারী পাহাড়ি বাঙালি সব সম্প্রদায়ের মানুষ সম্প্রীতির এ পরিবেশকে যেকোনো মূল্যে এগিয়ে নেবে। এবং সেই সঙ্গে বলব, পাহাড়কে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতে শিখুন। সেও আপনাকে ভালোবাসা দিতে কার্পণ্য করবে না।

লেখক : চেয়ারম্যান, ইফাদ গ্রুপ

Email: [email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist