সীমান্ত প্রধান

  ২৯ মে, ২০১৭

রাজনীতি

আফগান থেকে বাংলাদেশ : অতঃপর...

আফগানিস্তানের কাবুল শহরকে একদা বলা হতো ‘এশিয়ার প্যারিস’। ইউরোপ আমেরিকা থেকে অবকাশযাপনে এই শহরটিকে বেছে নিত অনেক পর্যটক। কালের বিবর্তনে এটি এখন রূপকথার গল্প। কেউ বিশ্বাসও করতে চাইবে না। অথচ এটাই ছিল ১৯৭৩ সালের পূর্বেকার সময়ের বাস্তবতা। রাজা মোহাম্মদ জহির শাহর সময়কালে সে দেশটিতে নারী-পুরুষ এক কাতারে এসে শিক্ষাগ্রহণ করত। গবেষণা করত। সেখানে অবাধে হতো সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা। শহরে মিনি স্কাট পরে হাঁটতেন দেশটির নারীরা। নারী স্বাধীনতাও ছিল উল্লেখযোগ্য।

১৯৭৩ সালে দেশটির রাজতন্ত্রের পতনের পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাজা মোহাম্মদ জহির শাহকে পরাজিত করেন নেতা দাউদ খান। এর ফলে দেশটি বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক সমর্থন হারায়। শুরু হয় আফগানিস্তানজুড়ে গৃহবিবাদ। এ অবস্থায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭৯ সালে এখানে হস্তক্ষেপ করে। ৮০ হাজার সৈন্য পাঠিয়ে আক্রমণ করে রাশিয়া। ১০ বছর ধরে চলে যুদ্ধ। এতে করে দেশটিতে শুরু হয় অর্থনৈতিক বিপর্যয়। ৬০ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়ে পড়ে। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন চলে গেলে একাধিক গ্রুপ দেশটির ক্ষমতা দখলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। শুরু হয় তুমুল গৃহযুদ্ধ।

এর মধ্যে ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেয় তালেবানি জঙ্গিগোষ্ঠী। তালেবান দেশটির ক্ষমতা নেওয়ার পর দ্রুত পাল্টাতে থাকে দৃশ্যপট। রক্ষণশীল ইসলামী শাসন ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয় মানুষের ওপর। বাধ্য করা হয় তা মেনে নিতে। পাশাপাশি চরম প্রতিক্রিয়াশীলতার কারণে পুরো আফগানিস্তানের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে যায়। ঘরবন্দি হতে থাকে নারীরা। সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চাকে নিষিদ্ধ করা হয় এখানে। নারীর ক্ষমতায়ন তো দূরের ব্যাপার; দেশটিতে নারী শিক্ষাও নিষিদ্ধ। বিশ্বের সর্বোচ্চ নারী সহিংসতার দেশ হয়ে ওঠে আফগানিস্তান। এদেশে কোনো নারী শিক্ষাগ্রহণের অভিলাষ করলে তাকে হত্যা করা হচ্ছে। এখানে নারীর জন্য ‘বোরকা’ করা হয় বাধ্যতামূলক। নারীর জন্য শিক্ষা ও চাকরিকে করা হয় নিষিদ্ধ।

আমেরিকায় টুইন টাওয়ারে হামলার পর আফগানিস্তানে ২০০১ সালে মার্কিন সৈন্যরা এসে ঘাঁটি করে। তারা বিভিন্ন স্থানে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে তালেবান নেতা ওসামা বিন লাদেনকে। একটা পর্যায়ে ব্যর্থ হয়ে দেশটির শাসক হিসেবে হামিদ কারজাইকে নির্বাচন করা হয়। শুরু হয় গণতান্ত্রিক প্রদ্ধতিতে দেশ পরিচালনা। কিন্তু একবার যেই কট্টর ধর্মীয় বিধিবিধান চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তা থেকে সরে আসতে পারেনি দেশটির পুরুষ সমাজ। তারা নিজেদের হীনস্বার্থে ধর্মীয় অনুশাসনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে।

পৃথিবীর সব থেকে কট্টর পুরুষতান্ত্রিক আইন কায়েম করা হয় আফগানিস্তানে। ধর্মীয় লেবাসে চলে মধ্যযুগীয় বর্বরতা। পান থেকে চুন খসলে বিচারের নামে নারীকে প্রকাশ্যে বর্বর নির্যাতন করা হয়। জনসম্মুখে পেটানো হয় নারীকে আর সে দৃশ্য গোলাকার বৃত্তের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে অসংখ্য পুরুষ। দিনের পর দিন দেশটিতে এভাবে চলছে নারী নির্যাতন। ফলে ২০১৩ সালে নারী নির্যাতনে বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থানে উঠে আসে আফগানিস্তান।

আজ থেকে ৫০ বছর আগেও আফগান নারীরা চিকিৎসা পেশায় আসতে পারতেন। নারী-পুরুষ একসঙ্গে থিয়েটার, ভার্সিটি ক্যাম্পাস অথবা বিভিন্ন স্থানে অবাধে চলাফেরা করতেন। আইন ও শাসনের ঐতিহ্য ছিল এবং একটি সরকার ছিল,

যে সরকার বিদেশের সাহায্য ছাড়া বিশাল অবকাঠামো, যেমন জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বা রাস্তাঘাটের আধুনিকায়ন করতে

পারত। এদেশের সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ছিল,

শিক্ষা তাদের বিভিন্ন সুযোগ ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এনে দেবে। অথচ সবকিছু গত তিন দশকে ধ্বংস হয়ে গেছে। আসলে ধ্বংস হয়ে যায়নি, ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। তবে আশার কথা হলো; সম্প্রতি দেশটিতে আবারও শুরু হয়েছে নারী শিক্ষা।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন জরিপ থেকে জানা যাচ্ছে,

বর্তমানে আফগানিস্তানে নারী শিক্ষার হার প্রায় ২২ শতাংশের ওপরে। তবে এরা প্রায় সবাই ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী। প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের মধ্যে শিক্ষার হার এখনো আগের অবস্থানেই রয়েছে।

আফগানিস্তানের অতীত বর্তমান নিয়ে এই আলোচনা থেকে আমরা দুটি জিনিসই গ্রহণ করতে পারিÑএক. অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল এবং দুই. ধর্মীয় অনুশাসন জোর করে চাপিয়ে দেওয়া। এক সময়কার ‘এশিয়ার প্যারিস’ কিন্তু ধ্বংস হয়েছে এ দুটি কারণেই। একটি দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে হলে প্রয়োজন সুষ্ঠু সুন্দর সর্বজনীন শাসন ব্যবস্থা। শিক্ষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে কোনো দেশ যে এগিয়ে যেতে পারে নাÑ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে আফগানিস্তান। একই সঙ্গে বর্তমান বিশ্বে নারী ক্ষমতায়নকে অস্বীকার এবং সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণের পথ রুদ্ধ করে কখনই একটি দেশ এগিয়ে যেতে পারে না। তা আফগানিস্তানের অতীত দেখলেই বোঝা যায়।

ধর্মীয় কট্টর অনুশাসনের মাধ্যমে কখনই কোনো দেশ এগিয়ে যেতে পারে না। আফগানিস্তানও পারেনি। অন্য কোনো দেশও পারবে না। এ কথাটি যখন বিশ্বময় সমাদৃত; তখন বাংলাদেশে বাড়ছে ধর্মীয় সংগঠনগুলোর আস্ফালন! আমাদের সেক্যুলার সরকারও সেসব সংগঠনগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে যাচ্ছে। একের পর এক পূরণ করে যাচ্ছে তাদের ইচ্ছেগুলো। যার প্রথম প্রতিফলন ঘটেছে চলতি বছরের পাঠ্যপুস্তকে। দ্বিতীয়টি ছিল কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি প্রদান। সর্বশেষ হেফাজতে ইসলামের মতো কট্টর ধর্মভিত্তিক একটি সংগঠনকে খুশি করতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টে স্থাপিত গ্রিক দেবীর আদলে তৈরি করা ভাস্কর্যটি মধ্যরাতে সরিয়ে ফেলা হয় !

সুপ্রিম কোর্ট থেকে ‘লেডি জাস্টিস’ ভাস্কর্যটি সরানো মানেই চরম প্রতিক্রিয়াশীল একটি গোষ্ঠীর জয় আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী প্রগতিশীল শক্তির পরাজয়। এ কারণে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী শুক্রবার (২৬ মে) জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনে এক সমাবেশ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছে, ‘প্রধানমন্ত্রী তার প্রতিশ্রুতি মোতাবেক মূর্তি সরিয়ে নিয়েছেন, তাই তার প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।’ তবে হেফাজতে ইসলাম একই সমাবেশ থেকে আরো কিছু দাবি জানিয়েছে, যা বলতে গেলে আকাশসম। তারা নতুন করে দেশের সব মূর্তি (ভাস্কর্য) সরানোর দাবি তুলেছে! তারা সমাবেশে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে এ-ও বলেছে, কোনোভাবেই তারা দেশে মূর্তি (ভাস্কর্য) স্থাপন মেনে নেবে না। তাই সব মূর্তি (ভাস্কর্য) অপসারণের দাবি তুলেছে এ

গোষ্ঠীটি। এতে করে বোঝা যায়, সুযোগ পেলে এই কট্টর ইসলামপন্থী সংগঠনটি সামনে হয়তো নারী নেতৃত্বকেও হারাম বলে ফতোয়া দেবে। নারীর অবাধ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করবে। দেশের সব নারীর জন্য তারা হয়তো বোরকা বাধ্যতামূলক ঘোষণা করবে! যা আমাদের মতো দেশের জন্য একটি বিপদ সংকেত।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist