খাদ্যাভ্যাস
আমিষ খুঁজি পোকামাকড়ে
শাকিল রিয়াজ
বিশ্বের নজর এখন পোকামাকড়ের দিকে। আমিষের চাহিদা মেটাতে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যবিদরা আমাদের খাবারের থালার দিকে ধাওয়া করছেন পোকামাকড়। আমিষ সমস্যার সমাধানে থালায় থালায় পোকাদের মচমচে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চান তারা। কিভাবে সম্ভব?
মানবদেহে আমিষ বা প্রোটিন প্রয়োজন। এই প্রোটিন আমরা পাই পশু-পাখির মাংস থেকে। বিশ্বব্যাপী বাড়ছে মাংসের চাহিদা। মাংসের ক্ষুধা গ্রাস করছে পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ। গোশত না হলে আমাদের চলে না, মাছ না হলে আমাদের চলে না। এই আমিষ বেঁচে থাকার যেমন প্রধান উপাদান, তেমনি জিহ্বায় সুড়সুড়ি দিতে পারঙ্গম। আমিষ হিসেবে মাছ-মাংসকেই দেহে ঢুকিয়েছে মানবজাতি, অনাদিকাল থেকে, বুঝে বা না বুঝে। এখন কথা উঠেছে, এটা কতটা টেকসই? পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য কতটা হুমকি? কথা উঠেছে আরও। রসনাবিলাস বড় কথা, না আমিষ আহরণ? দ্বিতীয়টিকে প্রাধান্য দিলে প্রোটিনের উৎপাদন ও পরিবেশনায় কার্যকর নতুন উপায় উদ্ভাবন জরুরি, বলছেন বিশেষজ্ঞরা। পোকামাকড় হয়তো পুরোপুরি সমাধান নয়, কিন্তু কিছুটা হলেও চাহিদা পূরণে সহায়ক।
দুই হাজারেরও বেশি ভোজ্য পোকা প্রজাতির সন্ধান রয়েছে বিশ্বে। যেগুলো রেকর্ড গতিতে বংশ বৃদ্ধি করতে পারে, বেঁচে থাকতে পারে অন্যের বর্জ্যে এবং যাদের জীবনযাপনে ন্যূনতম জায়গা, পানি আর সম্পদ প্রয়োজন পড়ে। প্রোটিন সমৃদ্ধির পাশাপাশি পোকায় রয়েছে আয়রন ও ক্যালসিয়ামের মতো খনিজ উপাদান। প্রলোভিত হওয়ার মতোই তথ্য।
বিশ্বজনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশের পাতে ইতোমধ্যে পোকামাকড় জায়গা নিয়েছে। আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে প্রতি বছর ১০ বিলিয়ন শুঁয়াপোকা উৎপাদন করা হয় খাওয়ার জন্য। উগান্ডায় ঘাসফড়িং এতটাই জনপ্রিয় যে, কেজিপ্রাইস যে কোনো মাংসের চেয়ে বেশি। ইউরোপ-আমেরিকার রেস্টুরেন্টগুলোতেও শুরু হয়েছে মচমচে পোকা নিয়ে নিরীক্ষা, পরিবেশনা। পাচকরা জানে, পুরনো অভ্যাস আর স্বাদ বদলাতে সময় লাগে না। তারা জানে, নতুন প্রজন্মের জিহ্বায় যে স্বাদ তুলে দেয়া যায়, তারা সেটাতেই অভ্যস্ত হয়।
আমার ছেলেটি সুশির ভক্ত। রেস্টুরেন্টে, দোকানে সুশি খুঁজে ফেরে। নিজে বাসায় সুশি বানায়। সুশির বুফেতে ছেড়ে দিলে উন্মাদ হয়ে যায়। বছর বিশেক আগে আমার প্রথম সুশিতে কামড়ের কথা মনে আছে। খাবারের প্লেটে কাঁচা মাছ ছিল অভাবনীয় তখন। নিউজ করেছিলাম জাপানে গিয়ে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সুশি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার দৃশ্য। রঙ্গ করে সুশির কথা বলতাম তখন। এখন এই স্টকহোমের যেকোনো খাবারের দোকানেই সুশির দেখা মেলে। ঢাকায় রেস্টুরেন্টে সুশি খেয়ে এসেছি। নতুন প্রজন্ম যে স্বাদ, পদ আর ইনগ্রেডিয়েন্টস নিয়ে বড় হচ্ছে, তাদের বাবা-মা শৈশব-কৈশোরে তা চেখে তো দূরের কথা, চোখেও দেখেনি। একসময় হয়তো তারা আমাদের নিয়ে হাসবে যে, আমরা কোনোদিন লার্ভা বার্গার খাইনি কিংবা ক্যাটারপিলার ফ্রাই চিবুইনি।
অন্তত আমাদের গৃহপালিত পশু-পাখির মুখে তুলে দিয়ে শুরু করতে পারি নতুন এই আমিষ অভিযান। হাঁস-মুরগি-মাছের জন্য পোকামাকড়-কীটপতঙ্গ হতে পারে আমিষের প্রধান উৎস। একশ’ ভাগ প্রাকৃতিক ও পরিবেশবান্ধব। খামারে যে সয়া প্রোডাক্ট দেওয়া হয়, তা যেমন খাদ্যগুণ মানসম্পন্ন নয়, তেমনি পরবর্তীকালে মানবদেহের জন্য স্বাস্থ্য-হুমকির কারণ হতে পারে। বিশ্বের সয়া প্রোডাক্টের শতকরা ৮০ ভাগ সরাসরি চলে যায় খামারে। এক টন সয়া উৎপাদনে যেটুকু জায়গা প্রয়োজন, সেটুকু জায়গায় দেড়শ’ টন পোকামাকড় উৎপাদন করা যায়। যে মাছ ধরা হয় বিশ্বব্যাপী, তার শতকরা ১০ ভাগ চলে যায় খামারের মাছের খোরাক হিসেবে, পাউডার ফর্মে। অথচ পোকা হতে পারে মাছের প্রধান খাদ্য। যারা সমুদ্রে মাছ ধরেন, তারা জানেন, পানিতে ভাসা কীট, মাছি স্যামন মাছের কতটা পছন্দ।
পোকামাকড়ের খামার গড়ে উঠছে এখন দেশে দেশে। কীটপতঙ্গ আর অভিশাপ নয়, পঙ্গপাল নয় কোনো ভীতিকর নাম। এরা প্রকৃতির নিজস্ব স্যানিটেশনকর্মী হিসেবে ঢুকে গেছে আমাদের অর্থনীতির ডায়াগ্রামে। পোকামাকড় খাবার খুঁজে নেয় বর্জ্য থেকে, সেই পোকারাই আবার খাবার হয় গৃহস্থ পশু-পাখির। কখনো আস্ত, কখনো তেলে রূপ নিয়ে, কখনো প্রোটিন পাউডার হিসেবে। এই ধারা বিকশিত হচ্ছে মানুষের মধ্যেও।
পোকামাকড়ের যুগ আসছে। সঙ্গে নিয়ে আসছে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য সুসংবাদ। নিয়ে আসছে চাকরি, মুনাফা আর এই বিশ্বাস যে, ভবিষ্যতে আমিষের ঘাটতি হবে না। এই সবুজ গ্রহকে দাঁড়াতে হবে না সহ্যের সীমানায়।
আমরা যারা সূর্যাস্তের লালাভ আলোয় এখনো ঘাসফড়িংয়ের নাচ দেখে মুগ্ধ হই, ফুলে ফুলে প্রজাপতির দোল দেখে আন্দোলিত হই, তাদের হয়তো প্রস্তুতির সময় হয়েছে। আমাদের ভাতের পাশে ভর্তা হয়ে আসি আসি করছে এরা। বিকেলের পার্কে বাদামের বদলে ঠোঙ্গায় চড়ে আড্ডা মাতাতে সাজছে এরা। আর আমাদের মধ্যে যারা সাইকেল চালান, মোটরসাইকেলে চড়েন, তারা দু-চারটি মশা-মাছির স্বাদ ইতোমধ্যে পেয়েছেন।
লেখক : কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট। সুইডেন প্রবাসী
"