মো. কায়ছার আলী

  ১২ আগস্ট, ২০২০

পর্যবেক্ষণ

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ডেল্টাপ্ল্যান

আছে বন্যা প্লাবন খরা, আছে দুঃখ কষ্ট জরা। তার পরও এই দেশ আমাদের প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা।’ বিশ্ব ঐতিহ্যের সুন্দরবন, দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, সূর্যাস্ত-সূর্যোদয়ের লীলাভূমি কুয়াকাটা এবং হাজার নদনদীর বর্ষায় পলি দিয়ে গড়া নদীমাতৃক দেশ আমাদের প্রিয় জন্ম জন্মান্তরের শেষ ঠিকানা বাংলাদেশ। হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য থাকলেও এর অভ্যুদয়ে রয়েছে এক আনন্দ-বেদনার মহাকাব্য। যেখানে মিলেমিশে আছে হ্রদয়মথিত শোক এবং প্রতিরোধের দৃঢ়চিত্ত উত্থান, জীবন উৎসর্গ করে জীবন জয় করার আখ্যান। নিজস্ব মহিমা চেতনা বুকে ধারণ-লালন করে অপরাজেয় বাঙালি জাতি। ষড়ঋতুর এই দেশে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ষা মৌসুমে আমাদের অনেক এলাকা প্লাবিত হয়। বর্ষার জলধারার প্রায় ৯২ শতাংশ চীন ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসে। তখন প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানিপ্রবাহের কারণে দেশের কৃষি অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং মানুষের জীবনযাত্রায় প্রচন্ড নেতিবাচক হয়ে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। প্রায় ৮০ শতাংশ পানি অন্যত্র চলে যাওয়ায় পানির অপচয় ঘটে। এই পানি কীভাবে ধরে রাখা যায় বা প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করা যায়, তা নিয়ে দীর্ঘকাল যাবৎ গবেষণা চলছে।

মানবসভ্যতায় এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে পরিবেশ, যা মূলত মানবসভ্যতারই বিবর্তনের ফসল। নতুন শতাব্দীতে নানা কারণে-অকারণে এর মহাবিপর্যয়ের সংকেত ধ্বনিত হচ্ছে। আমাদের অতিবৃষ্টি, বন্যা, সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদির প্রাদুর্ভাব ইদানীং বেড়ে গেছে। তাইতো সেদিন খবরে দেখলাম মাদারীপুরে এক বিশাল স্কুল ভবন চিরতরে নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার দৃশ্য।

এভাবে চলতে থাকলে শেষ পরিণতি ভয়াবহ হবে। প্রতি বছর ৫০ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয় আবার ৫ হাজার হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। কীভাবে মাটির ক্ষয়রোধ করা যায়, তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা চলছে। কিছু পত্রিকার রিপোর্টের ভিক্তিতে আজ লিখতে বসলাম। আসলে রিপোর্ট হলো তথ্যের নির্মোহ গাঁথুনি, যাতে থাকে না, অনাহুত মন্তব্য, অপ্রয়োজনীয় বিশ্লেষণ, অযাচিত পক্ষপাতিত্ব এতে শুধুই থাকে সোজাসাপ্টা বর্ণনা। সে কারণে এটি হয়তো সুখপাঠ্য ঠিক নয়। কিন্তু দেশ বা জাতির জন্য খুবই উপকারী। একজন মানুষ শত বছর সাধারণত বাঁচে না বা ক্ষমতায় থাকে না। কিন্তু শত বছরের পরিকল্পনা করতে দোষ কী? রাষ্ট্রনায়করা তা করে থাকেন। বর্তমান সরকারের রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সভায় বন্যা, নদীভাঙন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামে পানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার জন্য অন্তত শত বছরকে সামনে রেখে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল হিসেবে ‘বাংলাদেশ ডেল্টাপ্ল্যান-২১০০’ অনুমোদন করেছেন। এর অধীনে আপাতত ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য অন্তত ৮০টি প্রকল্প গ্রহণ করবে সরকার। জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শতবর্ষী এ পরিকল্পনা নেয় সরকার। এতে দুনিয়ার সর্ববৃহৎ বদ্বীপ বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে আরেক বন্ধুপ্রতিম বদ্বীপ দেশ নেদারল্যান্ডস।

নেদারল্যান্ডসের রয়েছে নদী ব্যবস্থাপনার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। তারা সবকিছু সঠিকভাবে পরিকল্পনামাফিক বাস্তবায়ন করে চলেছে। ইংরেজি শব্দ ডেল্টা অর্থ বদ্বীপ। বদ্বীপ শব্দটি গ্রিক ডেল্টা থেকে এসেছে। বাংলায় ব বর্ণের সঙ্গে এর মিল থাকায় বদ্বীপ নামটি প্রচলিত হয়। বদ্বীপ প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা ত্রিকোনাকার ভূমি, যা নদীর মোহনায় (সমুদ্র নিকটবর্তী অঞ্চল) ভেসে আসা পলিমাটি দিয়ে সমুদের উপকূলীয় অঞ্চলে সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৪ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। কীভাবে বৃষ্টি ও বন্যার পানি সংরক্ষণ করে দীর্ঘমেয়াদি করা যায়, তা এই মহাপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত আছে। ২১০০ সালে বাংলাদেশকে কোন জায়গায় দেখতে চাই, তা বদ্বীপ পরিকল্পনায় বলা আছে। পৃথিবীতে এত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আর কোনো দেশে আছে কি না, তা আমার অতি ক্ষুদ্রজ্ঞানে জানা নেই। গাঙ্গেয় বদ্বীপে তথা আমাদের জন্মভূমিতে ডেল্টাপ্ল্যান টেকসই উন্নয়ন ভাবনা শতভাগ ধাপে ধাপে পরিকল্পনামতো কার্যকর হোক। হয়তো আমরা সেদিন (২১০০ সালে) কেউ বেঁচে থাকব না, তবে আমাদের পরের প্রজন্ম থাকবে। তারা সফলতা পাবে এ বিশাল মহৎ কর্মের জন্য।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close