শাহরীন তাবাসসুম

  ০৫ আগস্ট, ২০২০

পর্যবেক্ষণ

জনসংখ্যার এপিঠ-ওপিঠ

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’ প্রবাদটি সত্যি কিন্তু আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ হতে না পারলেও আগামী দিনের বেকার ঠিকই হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে প্রায় ২৫০ শিশু জন্ম নেয় এবং বাংলাদেশে প্রায় ৯ জন। ঘণ্টায়, দিনে, মাসে, বছরে কত হবে এসব হিসাব করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কী রেখে যাচ্ছি? ৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেশটিতে প্রতি বর্গমাইলে বসবাস করে ২,৮৮৯ জন মানুষ। ১৯৭১ সালের ৭ কোটি মানুষকে স্বাধীন করা দেশ ৫০ বছর না পেরোতেই জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮ কোটিতে। প্রতি বছর প্রায় ৩০ লাখ মানুষ যুক্ত হচ্ছে। যা কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলার জন্য যথেষ্ট। জনসংখ্যায় বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম দেশ আমাদের বাংলাদেশ, যদিও আয়তনে বিশ্বে আমরা ৯৪তম। ২০৫০ সালে এসে যে জনসংখ্যা হবে প্রায় ২২ কোটি। ১৯৮৯ সালে প্রথমবারের মতো পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা সম্পর্কিত তথ্য সামনে আসে। সেসময়ে মোট জনসংখ্যা ছিল ৫০০ কোটি। আর বর্তমান সময়ে এসে জনবিস্ফোরণের জন্য মোট জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৭৮ কোটিতে। প্রতি ১০০০ জনে ১৯ জন নতুন সদস্য আমাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। প্রতি বছর পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার সঙ্গে ৮ কোটি করে মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এভাবে চললে ২১০০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা ১ হাজার ১২০ কোটিতে গিয়ে পৌঁছাবে। এ মুহূর্তে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৫২ শতাংশের বয়স ৩০ বছরের নিচে।

এদিকে বিপুল পরিমাণ গাছ কেটে বাড়িঘর তৈরি করা হচ্ছে। অন্যদিকে অধিক পরিমাণে ফসলের জন্য উচ্চমাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হচ্ছে; যা নদী ও পুকুরের পানিতে মিশে তা দূষিত করছে। খাবার ও ফসল ফলাতে ভূগর্ভের পানি অধিক পরিমাণে উত্তোলন করা হচ্ছে ফলে পানির স্তর ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে; যা জলবায়ুর ওপরও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। আয়তনের দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের ৩০০০ ভাগের এক ভাগ মাত্র কিন্তু জনসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম দেশ। ১৯০১ সালের পৌনে তিন কোটি জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ১৮ কোটি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে জনসংখ্যার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। একদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য জনশক্তি দেশের জনসংখ্যা থেকে আসে, অপরদিকে জনসংখ্যার অনভিপ্রেত আধিক্য ঘটলে দেশের উন্নতির পথে বাহুল্য জনসংখ্যা প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। তাই জনসংখ্যা কখনো আশীর্বাদ আবার কখনো অভিশাপ হিসেবে দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে। জনসংখ্য বৃদ্ধির ফলে উদ্ভূত সমস্যাসমূহ বাংলাদেশের উন্নয়নকে যেভাবে ব্যাহত করছে, তাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিস্ফোরণ বলে অভিহিত করা হচ্ছে। অস্বাভাবিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে দেশের অর্থনৈতিক সংকট প্রবল আকার ধারণ করেছে এবং জাতির ভবিষ্যৎ ক্রমেই অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। দেশজুড়ে বাল্যবিবাহ, দারিদ্র্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার, চিত্তবিনোদনের অভাব, জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে অজ্ঞতা, বেকারত্ব, কর্মসংস্থানের অভাব, মৃত্যুহারের চেয়ে জন্মহারের আধিক্য ইত্যাদি কারণে জনসংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়ে বিস্ফোরণোন্মুখ অবস্থায় রয়েছে। জনসংখ্যার বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে জনসংখ্যা সমস্যাকে বাংলাদেশের এক নম্বর সামাজিক সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতি বছর জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে অতিরিক্ত ২৩ লাখ মানুষ দেশের জনসংখ্যার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এর ফলে দেশে আবাসন সমস্যা, খাদ্যাভাব, পুষ্টিহীনতা, মূলধন গঠনের হার হ্রাস, বেকারত্ব, মাথাপিছু আয়স্বল্পতা, নিম্নমুখী জীবনযাত্রার মান, আবাদি জমি হ্রাস, সড়ক দুর্ঘটনা, যানজট, দুর্ভিক্ষ, মহামারি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন প্রভৃতি সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। প্রাকৃতিক ও জৈবিক কারণে উচ্চ জন্মহার ও মৃত্যুহার জনসংখ্যা সম্পর্কে সরকারের পরিকল্পনা ও নীতিমালার পরিবর্তন পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে জনসচেতনতার অভাব ইত্যাদি কারণে দেশের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আমাদের দেশের বর্তমানে ৪০ শতাংশ যুবক কোনো ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম, প্রশিক্ষণ গ্রহণ অথবা কর্মের মধ্যে নেই। তারা পড়াশোনা যতটুকু করার করেছেন এবং বসে আছেন। জীবনের কোনো পরিকল্পনা নেই, প্রচেষ্টা নেই কর্ম সুযোগ তৈরি করার। একটাই পরিকল্পনা, একটাই প্রত্যাশা যে কবে চাকরি হবে। ১৩৫ কোটি মানুষ চীনে বসবাস করে, এই জনসংখ্যা চীনকে পৃথিবীর বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ বানিয়েছে। চীনের জনসংখ্যা পুরো পৃথিবীর জনসংখ্যার ২০ শতাংশ অর্থাৎ পৃথিবীর প্রত্যেক পাঁচজনের মধ্যে একজন চীনা! আর চীনারা এই জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করেছে। যার ফলে পৃথিবীর মধ্যে পরাক্রমশালী দেশগুলোর মধ্যে একটি চীন; যা সম্ভব হয়েছে কেবলই তাদের জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করার মাধ্যমে। চীন একসময় আমাদের দেশের মতো দরিদ্র ছিল। তারা অর্থনৈতিকভাবে নিজেকে শক্তিশালী করার জন্য ১২ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ রেখেছিল। চীন সরকারের বক্তব্য ছিল, এত ছেলেমেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে কী করবে? কোথায় চাকরি পাবে তারা? এত হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান দেওয়ার মতো প্রতিষ্ঠান চীনে নেই। এ সময়ে চীন শিক্ষার্থীদের আধুনিক প্রশিক্ষণ দিয়েছিল নানা ধরনের স্বল্পমেয়াদি ট্রেড কোর্সের মাধ্যমে। ফলে পণ্য উৎপাদনের খরচ কমে গেল। বর্তমানে যেকোনো পণ্য একেবারে সস্তায় উৎপাদন করার ক্ষমতায়। তাদের ধারে কাছে কোনো দেশ এখন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে চীনাপণ্যের প্রসার বেড়েছে প্রতিনিয়ত। চীন বর্তমান বিশ্ব বাণিজ্যের এক অপ্রতিরোধ্য পরাশক্তি। আর তাদের এই পরিক্রমনশীল বানিয়েছে শুধু তাদের জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরের মাধ্যমে। আমাদের উদ্যোক্তা প্রয়োজন। তাই শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন, গুরুত্ব দেওয়া উচিত কর্মমুখী শিক্ষার ওপর। আমরাও পারব জনসংখ্যাকে শক্তিতে রূপান্তর করতে। এজন্য গুরুত্ব দিতে হবে কারিগরি শিক্ষার দিকে। এ দেশে কারিগরি শিক্ষার প্রসার হয়নি বললেই চলে। নতুন কোনো কারিগরি প্রতিষ্ঠান সরকারিভাবে যেমন হচ্ছে না, আবার বেসরকারি উদ্যোগেও হচ্ছে না। দেশে অথবা বিদেশে প্রচুর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও এই সেক্টরের প্রতি নজর নেই কারো। বিদেশে প্রশিক্ষিত নার্স ও নার্সিংয়ের ওপর ডিপ্লোমা কিংবা উচ্চতর ডিগ্রিধারীদের প্রচুর চাহিদা। এই বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের সাহস দিতে হবে। যদি এসব ক্রমাগত বৃদ্ধি ও চলমান রাখা যায়, তবে একপর্যায় বেকারত্বকে ওয়ান ডিজিটে নিয়ে আসা সম্ভব হবে। বিদেশে ধরে নেওয়া হয় যে, প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন উদ্যোক্তা হবেন এবং তিনি বাকি চারজনকে কর্মের সুযোগ করে দেবেন।

বাংলাদেশ উদ্যোক্তা তৈরি ও বিকাশের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করা হয় না। আমাদের দেশের শতভাগ ছাত্রই পড়াশোনা করে চাকরি করার জন্য। কিন্তু এত চাকরি কে তৈরি করবে? কোনো বেসরকারি, সরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এত চাকরির সুযোগ তৈরিই সম্ভব না। দেশের জনগণ, পরিবার এবং পরবর্তী প্রজন্মকে এই বাস্তবতা জানতে হবে, বুঝতে হবে অর্থাৎ তাদের মানসিকভাবে তৈরি হতে হবে। দেশে এখনো একটা মানসিকতা কাজ করে যে, এই কাজ আমার না, ওই কাজ আমার জন্য না। এই মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আগামীতে দেশের কোন কোন খাতে কত পরিমাণে লোকবল প্রয়োজন, তা নির্ধারণ করতে হবে। দেশে সেবা খাতগুলো কী কী, তা চিহ্নিত করতে হবে। দেশের যুবসমাজকে দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। যার যেমন যোগ্যতা বা সামর্থ্য রয়েছে, তাকে সে অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দিতে হবে। শহর থেকে গ্রাম প্রায় প্রতিটি ঘরেই ইলেকট্রিক্যাল পণ্য ব্যবহার হচ্ছে। আর ইলেকট্রিক্যাল পণ্য মাঝেমধ্যেই মেরামতের প্রয়োজন হয়। তাই এই খাতটি হয়ে উঠতে পারে একটি বিশেষ খাত। দেশে এভাবে সম্ভাব্য সেবা খাতে কী কী এবং কতজন লোক প্রয়োজন, তা নির্ধারণ খুবই জরুরি। কবে এমএ, বিএ, বিএসসি, পাস করবে, কবে চাকরি হবে, তারপর কর্মক্ষম হবÑ সে ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। জনসংখ্যা কমিয়ে ফেলা কোনো সমাধান নয়। আজকের জনসংখ্যা কমিয়ে ফেললে একসময় সে জনসংখ্যা আবারও বেড়ে উঠবে। এমন কিছু প্রকল্প হাতে নিতে হবে এবং এমন কিছু প্রকল্প উদ্ভাবন করতে হবে; যেগুলোর মাধ্যমে জনসংখ্যাকে পরিণত করা যাবে শক্তিতে। তার জন্য বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, পরিকল্পনাবিদদের একত্রে কাজ করতে হবে। সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা এবং যুগোপযোগী পদক্ষেপই পারে একটি জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে। আর এভাবেই আমরা গড়ে তুলতে পারব সোনার বাংলাদেশ।

লেখক : শিক্ষার্থী

এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close