মো. বিল্লাল হোসেন

  ২৭ জানুয়ারি, ২০২০

উন্নয়ন

অদম্য অগ্রযাত্রায় ডিজিটাল বাংলাদেশ

‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ একটি প্রত্যয়, একটি স্বপ্ন। বিরাট এক পরিবর্তন ও ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এখন এগিয়ে চলছে। একুশ শতকে বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ৬ জানুয়ারি ২০০৯ দেশরতœ শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো শপথ নেন। ২০২১ সালের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনে বছরে বাংলাদেশকে একটি ডিজিটাল অর্থনীতি এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি বিনির্মাণই ছিল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রধান বিষয়। বর্তমানে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল ভোগ করছি এবং উন্নত বিশে^র সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি দুর্বার গতিতে। বর্তমানে প্রায় ১২০টি বাংলাদেশি কোম্পানি তাদের তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য বিশে^র ৩৫ দেশে রফতানি করছে; যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২১ সালের মধ্যে এটি ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। ১২ ডিসেম্বর, ২০০৮ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা করে যে, ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ পরিণত হবে। একটি উন্নত দেশ, সমৃদ্ধ ডিজিটাল সমাজ, একটি ডিজিটাল যুগের জনগোষ্ঠী, রূপান্তরিত উৎপাদন ব্যবস্থা, নতুন জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি সব মিলিয়ে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের স্বপ্নই দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ডিজিটাল বাংলাদেশ বস্তুত জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রথম সোপান। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যে সমৃদ্ধি ও উন্নত জীবন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম, ডিজিটাল বাংলাদেশ আমাদের সেই স্বপ্ন পূরণ করবে। বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি ১৭ থেকে ১২ নভেম্বর ২০০৯-এ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ সামিট’ নামক এ বিষয়ে প্রথম শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করে, যাতে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা এবং অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো আলোচিত হয়। বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপই হলো ডিজিটাল বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে একটি উন্নত, বিজ্ঞানমনস্ক সমৃদ্ধ বাংলাদেশকে বোঝায়। ডিজিটাল বাংলাদেশ হচ্ছে সেই সুখী, সমৃদ্ধ, শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বৈষম্য, দুর্নীতি, দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ, যা প্রকৃতপক্ষেই সম্পূর্ণভাবে জনগণের রাষ্ট্র এবং যার মুখ্য চালিকাশক্তি হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি’। এটি বাংলাদেশের জনগণের উন্নত জীবনের প্রত্যাশা, স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা। এটি বাংলাদেশের সব মানুষের ন্যূনতম মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর প্রকৃষ্ট পন্থা। এটি বাংলাদেশের জন্য স্বল্পোন্নত বা দরিদ্র দেশ থেকে সমৃদ্ধ ও ধনী দেশে রূপান্তরের জন্য মাথাপিছু আয় বা জাতীয় আয় বাড়ানোর অধিকার। এটি হচ্ছে একুশ শতকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা। প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনাকে ডিজিটাল বাংলাদেশের পথিকৃৎ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কেননা, তিনি পথিকৃৎ হিসেবে লক্ষ্য অর্জনে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনার সুযোগ্য ছেলে এবং আইসিটিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় তথ্যপ্রযুক্তি তথা ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। এ ছাড়া ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকও কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে মূলত চারটি মূল স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে। ১. মানব সম্পদ উন্নয়ন ২. নাগরিকদের মধ্যে আন্তসম্পর্ক উন্নয়ন ৩.ডিজিটাল সরকার ব্যবস্থা বা ই-গভর্ন্যান্স ৪. তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের প্রচার।

দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি একটি দেশের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জকে যথাযথভাবে মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ সরকার তরুণদের তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ এবং সুসজ্জিত করে তুলছে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। গত বছরগুলোতে প্রায় ৬৫০০০ আইটি/ আইটিইএস পেশাদার তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এ প্রকল্পে মূলত জনপ্রিয় এবং বৈশি^ক চাহিদাসম্পন্ন বিষয় যেমন আইওটি, ব্লকচেইন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স এবং বিগ ডেটা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আইসিটি ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে এবং স্কুল পর্যায়ে এ ল্যাবের নামকরণ করা হয়েছে ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব’। নিঃসন্দেহে এটি দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রবর্তনের মাধ্যমে নাগরিকদের আন্তঃযোগাযোগ সহজতর হচ্ছে। ২০২১ সালের মধ্যে দেশের সব জায়গা শতভাগ ইন্টারনেটের আওতায় আসবে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৯৩ মিলিয়ন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এবং ১৬০ মিলিয়ন মোবাইল ব্যবহারকারী রয়েছে এবং মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বিশে^ নবম। বিশে^র সব নাগরিকের সঙ্গে আন্তঃসম্পর্ক বৃদ্ধির নিমিত্তে প্রায় ১ : ৭০০ জিবিপিএস সাবমেরিন কেবল স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া দেশে বর্তমানে ২৮টি হাইটেক পার্ক নির্মাণাধীন রয়েছে। এগুলোর কাজ সম্পন্ন হলে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশে^র আন্তঃসম্পর্ক উন্নয়ন হবে। ফলে বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। এ ছাড়া শিগগির বাংলাদেশ প্রবেশ করতে যাচ্ছে ৫-জির যুগে।

২০২৩ সাল নাগাদ সরকারের সব অফিস ও দফতরসমূহ ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করবে। বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন (www.bangladesh.gov.bd)-এর আওতায় প্রায় ৪৫০০০ সরকারি অফিস ও দফতরের ওয়েবসাইট রয়েছে। অর্থাৎ এক ক্লিকেই আমরা সরকারের সব কার্যাবলি ঘরে বসেই দেখতে পারব এবং সব সেবা ঘরে বসেই উপভোগ করতে পারব। দেশে প্রায় ৫ হাজার ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার রয়েছে; যেখান থেকে প্রান্তিক জনগণকে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনসহ আরো অনেক সেবা দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রায় ১০০ মিলিয়ন বাংলাদেশি নাগরিককে ডিজিটাল আইডি কার্ড প্রদান করা হয়েছে; যেটি বর্তমান সরকারের একটি বিশাল অর্জন। সরকারের সব ক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশন নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশ হবে বিশে^ উন্নয়নের রোল মডেল।

বর্তমান সরকার ২০২১ সালের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে প্রায় ৫ মিলিয়ন ডলার আয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ। বাংলাদেশের প্রায় সব ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি পণ্যের ব্যবহার বেড়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা আমাদের নিজেদের তৈরি পণ্য ব্যবহার করছি। অর্থাৎ বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প এগিয়ে যাচ্ছে অদম্য গতিতে।

মূলত এই চারটি মূলনীতিই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার হাতিয়ার। এটিকে শক্তিশালী এবং স্বচ্ছভাবে পরিচালনা করতে বর্তমান বদ্ধপরিকর। আমি বিশ^াস করি, এই মুল স্তম্ভগুলোর ওপর ভিত্তি করে দেশরতœ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশে^র বুকে মাথা উচুঁ করে দাঁড়াবে। উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে প্রটি স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, নাগরিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ডিজিটাল বাংলাদেশের ছোঁয়া লেগেছে। একদম ঘুম থেকে উঠে পত্রিকা পড়া থেকে শুরু করে ঘুমের আগে ফেসবুক ব্যবহার পর্যন্ত সব জায়গায় ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল ভোগ করছি আমরা। জীবনমানে ডিজিটালের ছোঁয়া বাংলাদেশকে এগিয়ে নিচ্ছে দুর্বার গতিতে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে অদম্য গতিতে। বেশি দিন বাকি নেই যখন বাংলাদেশকে বিশে^ অন্যান্য দেশ উন্নয়নের রোল হিসেবে মানবে। সেদিন বাংলাদেশ হবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা।

এসডিজির (২০১৬-২০৩০) মূলনীতি হলো ‘বাদ যাবেনা কেউ’। মূলত এই মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে অদম্য গতিতে এগিয়ে চলেছে বর্তমান সরকার। দেশের সব মানুষকে ডিজিটাল সেবার আওতায় আনতে নেওয়া হয়েছে সব কার্যক্রম। যাতে কেউ কোনো ধরনে নাগরিক সেবা হতে বঞ্চিত না হয়। এভাবে দেশের সব মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে পারলে আমরা দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির মাধ্যমে খুব সহজেই অর্জন করতে পারব এসডিজি। তখন দেশের উন্নয়ন হবে টেকসই উন্নয়ন।

সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা এবং তথ্যপ্রযুক্তি-বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে গত দশকে বাংলাদেশের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। বর্তমানে আমাদের জিডিপির হার ৮ শতাংশ, যেটি বিশে^র দ্রুত বর্ধমান অর্থনীতির একটি। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্য মতে, বর্তমান বিশে^ আমার ৩৪তম অর্থনীতির দেশ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা ২৪তম অবস্থানে উন্নীত হব। এসব উন্নয়নের পেছনে মূল চালিকাশক্তি হলো জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার। তাই এটি নিঃসন্দেহে বলা যায় কৃষিভিত্তিক একটি সমাজ থেকে বাংলাদেশ একটি সৃজনশীল ও মেধাভিত্তিক শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়ে মানবসভ্যতার ডিজিটাল যুগের নেতৃত্ব দেবেÑ এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close