সাধন সরকার

  ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯

মুক্তমত

মিরপুর জল্লাদখানা বধ্যভূমির কান্না

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হায়েনাদের ধ্বংসযজ্ঞের কাহিনি সারা বিশ্বের অজানা নয়। স্বাধীনতার পরও তাদের বিভিন্ন কুকীর্তির প্রমাণ বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে আসে নির্মম ও নৃশংস গণহত্যার কথা। স্বাধীনতার পর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বহু গণহত্যার চিহ্ন তথা বধ্যভূমির খোঁজ পাওয়া যায়। ঢাকা তো বটেই বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বধ্যভূমির একটি হলো মিরপুরের ‘জল্লাদখানা বধ্যভূমি ১৯৭১’। এটি এখন জাদুঘর। মুক্তিযুদ্ধের সময় মিরপুর ছিল ঢাকার নীরব এলাকাগুলোর একটি। অর্থাৎ এখনকার মিরপুর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেই সময়কার মিরপুর বিহারি অধ্যুষিত এবং কিছুটা নির্জন এলাকা হওয়ার সুবাধে এখানে ব্যাপক হারে হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের প্রশিক্ষিত সে সময়ের জল্লাদরা।

মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর পেরিয়ে (১১ নম্বরের দিকে যেতে) বেনারসি পল্লীর পাশেই এই বধ্যভূমির অবস্থান। বধ্যভূমির প্রবেশপথের ফটকের গায়ে লেখা রয়েছেÑ ‘কান পেতে শুনি কী বলতে চাইছে মিরপুর জল্লাদখানা বধ্যভূমি’। ভেতরে প্রবেশ করতেই প্রথমে নজরে আসবে একটি মাটির স্মারক। ‘শূন্য হৃদয়’ নামের এই স্মারকটির স্থপতি কবি রবিউল হুসাইন। এর চারপাশ ঘুরে জানা যায়, সারা দেশে বিভাগ অনুযায়ী ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৪৭৭টি বধ্যভূমির কথা। এ ছাড়া রয়েছে একটি ফলকচিত্র। গণহত্যার এই প্রতীকী দৃশ্যের শিরোনাম ‘জীবন অবিনশ্বর’। এর পাশে রয়েছে একটি ঘর, যেটি সংগ্রহশালা নামে পরিচিত। এটির প্রবেশপথে রয়েছে একটি ঘণ্টা, যেটি বাজিয়ে প্রবেশ করতে হয়। প্রবেশ করে জানা গেল, মিরপুরে শহীদদের নামের তালিকা। এর ভেতরে কাচের সেলফের মধ্যে রয়েছে বধ্যভূমির মাটি। জল্লাদখানা স্মৃতিপীঠের পূর্বদিকে রয়েছে ‘স্মৃতি টাওয়ার’।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক নিরীহ বাঙালিদের নির্যাতনের পর বধ্যভূমিতে গণকবর দেওয়া হতো। মূলত স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মিরপুরের বিহারি অধ্যুষিত এলাকাগুলো বধ্যভূমিতে রূপ নিয়েছিল! ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও অবরুদ্ধ ছিল মিরপুর। এর প্রায় দেড় মাস ধরে বাঙালিদের ওপর নির্মম নির্যাতন করা হয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর অবাঙালি বিহারি, রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের সহায়তায় বাঙালিদের হত্যা করে সেপটিক ট্যাংকে ও কূপে ফেলে রাখা হতো। তথ্যসূত্রে জানা যায়, পাম্প হাউসের কূপের সামনের স্থানটিতে শিরñেদ ও হত্যা করা হতো ধরে নিয়ে আসা বাঙালিদের। তারপর লাশ ফেলে দেওয়া হতো পানিভর্তি গহ্বরে। এ বধ্যভূমি থেকে ৭০টি মাথার খুলি, ৫ হাজার ৩৯২টি অস্থিখন্ড, মেয়েদের শাড়ি, ফ্রক, ওড়না, অলংকার, জুতা, তসবিসহ শহীদদের ব্যবহার্য নানা জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি সকালে মুক্ত হয় অবরুদ্ধ মিরপুর। এখানে মূলত পাকিস্তান পিরিয়ডে পরিত্যক্ত একটি পাম্প হাউসের ভেতরে ও বাইরে ছিল দুটি কূপ। একটা গভীর ও অন্যটি অপেক্ষাকৃত কম গভীর। জানা যায়, কম গভীর কূপটির মুখে বাঙালিদের হত্যা করে তাদের মাথা ফেলে দেওয়া হতো, আর দেহটি ফেলে দেওয়া হতো গভীর কূপটিতে! ধারণা করা হয়, খ্যাতনামা চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানকে এই মিরপুরের জল্লাদখানার আশপাশেই হত্যা করে লাশ গুম করা হয়েছিল।

১৯৯৯ সালের ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেডের সহযোগিতায় মিরপুরের এই জায়গায় খননকাজ চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে বধ্যভূমি আবিষ্কার করা হয়। ২০০৭ সালের ২১ জুন এই স্থাপনাটির দ্বার উন্মোচন করা হয়। ২০০৮ সালে তৎকালীন সরকার পুনরায় জল্লাদখানা কর্মসূচি শুরু করে এবং স্থপতি ও কবি রবিউল হুসাইনের সার্বিক পরিকল্পনায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রচেষ্টায় তৈরি করা হয় জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠ (উইকিপিডিয়া)। প্রতিদিনই গড়ে ১৫০ থেকে ২০০ দর্শনার্থী এখানে আসেন। উদ্বোধনের পর থেকে এ পর্যন্ত এ সংগ্রহশালা পরিদর্শন করেছেন প্রায় সাড়ে আট লাখ মানুষ। নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে শিশু-কিশোরদের নিয়ে বধ্যভূমিগুলো একবার সবার দেখে আসা উচিত।

লেখক : পরিবেশকর্মী ও কলামিস্ট

সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close