মজিবর রহমান

  ১২ ডিসেম্বর, ২০১৯

পরিবেশ

তীব্র দূষণের কবলে দেশ

শুধু ঢাকা শহর নিয়ে ভাবলে চলবে না, ভাবতে হবে গোটা দেশ নিয়ে। সার্বিক বিচারে বাংলাদেশ দূষণের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের একটি। আমাদের নিজেদের একটি দূষণ পরিমাপক ব্যবস্থা থাকা দরকার, যা দিয়ে বোঝা যাবে দেশের কোনো অঞ্চলে দূষণের মাত্রা কত। তাহলে অঞ্চলভিত্তিক ব্যবস্থা নিতে সুবিধা হবে। অবশ্য সবই নির্ভর করবে সদিচ্ছার ওপর। বুঝতে হবে সমস্যার গভীরতা।

মাত্র কিছুদিন আগে আমাদের ক্রিকেট দল যখন ভারতের দিল্লিতে টি-২০-এর একটি ম্যাচ খেলতে গিয়েছিল আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম দলের সদস্যদের স্বাস্থ্যগত দিক নিয়ে। শহরটি তখন প্রবল দূষণকবলিত ছিল এবং পর্যবসিত হয়েছিল বিশ্বের শীর্ষতম দূষণ নগরীতে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসই বলতে হবে, কিছুদিন যেতে না যেতেই একই অবস্থা হলো আমাদের। গেল নভেম্বরের কটা দিন ঢাকা পরিণত হয়েছিল পৃথিবীর দূষিততম নগরীতে। দিল্লির দূষণ নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছিল দেশ-বিদেশে। সেদেশের সরকারও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছিল কিছু। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাময়িক বন্ধ রেখেছিল, যান চলাচল কমিয়ে দিয়েছিল শহরে। আমাদের দেশে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা গেল না। তবে কথাবার্তা হচ্ছে, এ নিয়ে এবং সেটি আগের তুলনায় বেশি মাত্রায়ই বলতে হবে।

বাংলাদেশে দূষণ তীব্র আকার এক দিনে নেয়নি, ধীরে ধীরে প্রবল হয়েছে চোখের সামনে। অস্বীকার করার উপায় নেই, এ ব্যাপারে যতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল, নীতিনির্ধারকরা ততটা গুরুত্ব দেননি। তারা উন্নয়নের পিছু ছুটেছেন পরিবেশ কিংবা দূষণের কথা মাথায় না রেখে। উন্নয়ন অপরিহার্য বিষয় এ কথা শত্রুও স্বীকার না করে পারবে না। কিন্তু সেই উন্নয়ন হতে হবে টেকসই ধাঁচের। আর টেকসই উন্নয়নের কথা ভাবলে অবশ্যই দূষণ ও পরিবেশের কথা মাথায় রাখতে হবে। নয়তো সেই উন্নয়ন গতি তো পাবেই না, উল্টো বাধাগ্রস্ত হবে। হাতের কাছে নেই এ রকম একটি রিপোর্ট কিছুদিন আগে পাঠ করেছিলাম। রিপোর্টের সারবত্তা হলো, একদল উদ্যোক্তা উদ্যোগ নিয়েছিলেন রাজশাহীর আম বলে খ্যাত আমাদের সুস্বাদু আম বিদেশে রফতানি করার। কোনো রকম রাসায়নিক ব্যবহার ছাড়া সযতেœ উৎপাদন করেও তারা সে আম রফতানি করতে পারেননি দূষণ ধরা পড়ায়। অর্থাৎ আমাদের জলবায়ুমন্ডল সবই দূষিত, স্বয়ংক্রিয়ভাবে দূষণ ঢুকে যায় ফলনে।

দূষণ নিয়ে কথাবার্তা এবার অন্যবারের তুলনায় বেশি। এর কারণ দ্বিবিধ। প্রথমত. এটা শীতকাল। শীতকালে দূষণ বেশি হয় এখানে। দ্বিতীয়ত. আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ারভিসুয়াল ও গ্রিনপিসের ইনডেক্স জরিপ খুব গুরুত্বের সঙ্গে সামনে এনেছে গণমাধ্যম। এ ছাড়া জাতিসংঘ ও পরিবেশ অধিদফতরের এ-সংক্রান্ত একটি ফল প্রকাশিত হয়েছে কিছুদিন আগে। আরেকটি ব্যতিক্রমী বিষয় হলো, বড় কোনো বাস্তবতা সাধারণত মেনে নিতে চায় না আমাদের উচ্চতর মহল। কিন্তু এবার তেমনটি ঘটল না, পরিবেশ ও বনমন্ত্রী স্বয়ং বাস্তবতা মেনে নিয়ে প্রতিকারের কথা বলছেন। এবার কাজ করে দেখাতে পারলেই হলো।

সূত্রোক্ত জরিপ, পরিমাপ, গবেষণা রিপোর্ট ও বিশেষজ্ঞ মহলের পক্ষ থেকে দূষণের কারণ হিসেবে প্রধানত তিনটি বিষয়কে চিহ্নিত করা হয়েছে। মূলত ঢাকা শহরকেন্দ্রিক ছিল তাদের এই বিশ্লেষণ। অবৈধ ইটভাটা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও অপরিকল্পিত নির্মাণযজ্ঞকে দূষণের প্রধান কারণ বলে বলা হচ্ছে। পরিবেশ অধিদফতরের হিসাবমতে, ঢাকা শহর দূষণের শতকরা ৫৬ ভাগ দায়ভার ইটভাটার। ঢাকা শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য ইটভাটা, যার একটা বৃহৎ অংশই অবৈধ। নীতিমালা আছে, কিন্তু মানা হচ্ছে না সেই নীতিমালার নির্দেশাবলি। লাইসেন্স নেই, নেই পরিবেশ ছাড়পত্র। পরিবেশবান্ধব বলা হচ্ছে যেসব ইটভাটাকে; সেগুলো প্রকৃতই পরিবেশবান্ধব কি না প্রশ্ন আছে তা নিয়েও। এ রকমই এক বিশৃঙ্খল অবস্থা ইটভাটা নিয়ে। মালিকরা খুব কমই তোয়াক্কা করেন এসব নীতিমালা বা ন্যায়নীতির। যে কারণে যথার্থ তদারকি অপরিহার্য হয়ে উঠছে। সেখানেও আছে গলত, তদারকি সঠিকভাবে হচ্ছে না। ফলে দূষণ তীব্রতর হচ্ছে দিন দিন।

যানবাহনের কালো ধোঁয়ার ক্ষতিকর দিক নিয়ে আলোচনা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু তার প্রতিকার নেই কোনো। ফিটনেসবিহীন যান সদর রাস্তা দাপিয়ে বেড়ায়, কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকে চারপাশ। বিরত রাখা যাচ্ছে না কোনোটিকেই। সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ পাস হওয়ার পর ধারণা করা গিয়েছিল পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটবে, কিন্তু আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না পরিস্থিতি দৃষ্টে। সরকার যদি কঠোর না হতে পারে, তাহলে কালো ধোঁয়ার নির্গমন বন্ধ হবে না কোনো দিন, দূষণও কমবে না। এসব যান সরাতে পারলে যানজটও কমার সম্ভাবনা থাকত।

অপরিকল্পিত নির্মাণযজ্ঞ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। বর্তমানের মতো শুষ্ক মৌসুমে দূষণপ্রবণতা বেশি। আবার এটাও ঠিক, শুষ্ক মৌসুম নির্মাণকাজের জন্য অধিকতর উপযোগী। বৃষ্টির সময় ভোগান্তি বেশি হয়, সে কারণে মানুষ শুষ্ক মৌসুমে এ ধরনের কার্যাদির বিপক্ষে না। একটু সতর্ক হলেই এ সময়ের দূষণ রোধ করা যায়। নির্মাণসামগ্রী ঢেকে পরিবহন করা, নির্মাণস্থলে নিয়মিত পানি ছিটানোÑ এ রকম সামান্য ব্যবস্থা গ্রহণ দ্বারা পরিবেশগত ক্ষতি রোধ করা যায়। এ ছাড়া নগর কর্তৃপক্ষ যদি নগরকে পরিবেশসম্মত রাখার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করে, তাহলে দূষণ নিশ্চিত নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

এই তিন প্রধান কারণ ছাড়াও আরো অনেক কারণ আছে দূষণপ্রবণতার। শিল্প-কারখানার বর্জ্য এর একটি। দেশ দ্রুত শিল্পায়িত হচ্ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে শিল্পবর্জ্য। এর ব্যবস্থাপনা সঠিক ও পর্যাপ্ত না হলে পরিবেশ আরো নাকাল হয়ে দূষণ ক্রমাগত বাড়বে। যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে অ্যাফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বা ইটিপির বাধ্যবাধকতা আছে; সেগুলো নিয়মিত তদারকির আওতায় না আনলে এসব প্লান্টের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না কিংবা পেলেও বন্ধ পাওয়া যাবে। পানি দূষণের প্রতিক্রিয়া ব্যাপক, মানুষ ও প্রকৃতি দুই-ই এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বর্জ্য ঢালার উৎস করা হচ্ছে নদী-জলাশয়-খালকে। ঢাকার খালগুলোকে দখলমুক্ত করার উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে। উদ্যোগটি ভালো, কিন্তু সেগুলো যদি হয় ভাগাড়ের আধার; তাহলে ফলাফল হিতে বিপরীত হবে। শব্দদূষণ মারাত্মক মাত্রায় উপনীত। মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক এ সমস্যাকেও পাশ কাটিয়ে যাওয়া আত্মঘাতী হবে। দূষণের ক্ষতিকর দিক নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। এটি উৎপত্তি ঘটাতে পারে ক্যানসারসহ প্রাণহানিকর নানা ব্যাধির। বাস্তবেও আমরা তা প্রত্যক্ষ করছি। মানুষ ব্যাপক হারে আক্রান্ত হচ্ছে কিডনি বিকল, ক্যানসার ইত্যাদি দুরারোগ্য সব রোগে। চিকিৎসা করাতে গিয়ে মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে অত্যধিক ব্যয়ভারের কারণে। উন্নত দেশে চিকিৎসার জন্য ইন্স্যুরেন্স প্রথা চালু আছে, সে কারণে ব্যয়বহুল চিকিৎসাও সেসব দেশের মানুষের গায়ে লাগে না। আমাদের দেশে সে রকম ব্যবস্থা নেই, ভাবনা-চিন্তা দরকার এ বিষয়েও। দূষণ গড় আয়ুতে প্রভাব ফেলবে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা, গড় আয়ু কমে যাবে। নবজাতকরা এর শিকার হবে বেশি। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই, গড় আয়ু বিষয়ে আমাদের যে অগ্রযাত্রা তা ব্যাহত হবে; ক্ষতির শিকার হবে বেশি অনাগত শিশু।

দূষণ উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করবেÑ এ কথা আম রফতানির উদ্যোগ ভেস্তে যাওয়ার উদাহরণ টেনে বুঝিয়েছিলাম। এর ফলে বিদেশি বিনিয়োগ, বিশেষত যে প্রকল্পে বিদেশিদের এখানে অবস্থান করে পরিচালনার প্রশ্ন আসবে, তা কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। নিশ্চিত মন্দ প্রভাব পড়বে পর্যটনশিল্পে, বিদেশিদের আগমন কমে যাবে। আমরা কি এসব বিষয়ে সচেতন? যে আওয়াজ উচ্চকিত, বর্তমানে তা কি থেমে যাবে শুষ্ক মৌসুম গত হলেই?

শুধু ঢাকা শহর নিয়ে ভাবলে চলবে না, ভাবতে হবে গোটা দেশ নিয়ে। সার্বিক বিচারে বাংলাদেশ দূষণের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের একটি। আমাদের নিজেদের একটি দূষণ পরিমাপক ব্যবস্থা থাকা দরকার, যা দিয়ে বোঝা যাবে দেশের কোনো অঞ্চলে দূষণের মাত্রা কত। তাহলে অঞ্চলভিত্তিক ব্যবস্থা নিতে সুবিধা হবে। অবশ্য সবই নির্ভর করবে সদিচ্ছার ওপর। বুঝতে হবে সমস্যার গভীরতা।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close