ইয়াসমীন রীমা

  ২৩ অক্টোবর, ২০১৯

পর্যালোচনা

শামুক-ঝিনুকে উপার্জন

বেঁচে থাকার জন্য মানুষ বিভিন্ন রকম পেশা বেছে নেয়। কিছু কিছু পেশা আছে স্বাভাবিক। আবার আশ্চর্য সব পেশা অবলম্বন করে মানুষ বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে অহরহ। এসব বিভিন্ন ধরনের পেশায় বৈচিত্র্যতার কথা উল্লেখ করে শেষ করা যাবে না। তবে দেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ কৃষিকাজে সংযুক্ত রয়েছে। প্রাণী ও উদ্ভিদের বিভিন্ন ব্যবসায়িক পেশার মানুষের সংখ্যাও কম নয়। শামুক-ঝিনুক কুড়িয়ে বা সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করছে দেশের অনেক মানুষ। তবে তারা অধিকাংশ চর অঞ্চলের বাসিন্দা।

শামুক বা ঝিনুক হচ্ছে মোলাস্কা (গড়ষষঁপধ) পর্বের গ্যাস্ট্রোপডা এধংঃৎড়ঢ়ড়ফধ শ্রণির প্রায় সব সদস্যের সাধারণ নাম। এরা নরমদেহী। সাধারণ শামুক স্থলচর, সামুদ্রিক ও স্বাদুপানির শামুককে বোঝায়। মরুভূমি, নদী ও স্রোতস্বিনী, বন্ধ জলাশয়, সমুদ্র উপকূলসহ অনেক আবহাওয়ায় শামুকের দেখা পাওয়া যায়। বেশির ভাগ শামুকই তৃণভোজী তবে কিছু সামুদ্রিক শামুক প্রজাতি উভয়ভোজী অথবা মাংসভোজী। শামুকের খোলক জ্যামিতিক স্পাইরল বা প্যাঁচের আকারে তৈরি। বেশির ভাগ খোলকই ডানহাতি অর্থাৎ যদি খোলসের কেন্দ্রের উঁচু অংশটি দর্শকের দিকে তাক করে থাকে, তবে প্যাঁচ বা স্পাইরালগুলো ঘড়ির কাঁটা যেদিকে ঘোরে, সেদিকে ঘুরতে ঘুরতে এগোবে। শামুকের চলার গতি অত্যন্ত ধীর।

শামুক হচ্ছে প্রাকৃতিক ফিল্টার। শামুক-ঝিনুক মরে গিয়ে তার মাংস ও খোলস পচে জমির মাটিতে প্রাকৃতিভাবে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও পটাশ তৈরি করে। ফলে জমির উর্বরতা বৃদ্ধিসহ ধানগাছের শিকড় মজবুত ও ফল অধিক হতে সাহায্য করে। অন্যদিকে জীবিত শামুক-ঝিনুক বর্ষা মৌসুমে আমন ধানের ব্যাপক উপকারে আসে। শামুক দূষিত পানি ফিল্টারিং করে প্রাকৃতিভাবে পানি দূষণমুক্ত রাখে। শামুকের নিঃসৃত পানির রয়েছে নানা ঔষধি গুণ। প্রচলিত আছে ঠান্ডা পাত্রে রক্ষিত শামুক নিঃসৃত পানি যেকোনো ধরনের চোখের রোগের জন্য খুবই উপকারী।

কৃষিজমি ও জলাভূমিতে প্রাকৃতিভাবেই জন্ম নেয় অসংখ্য শামুক। শামুক নিরীহ জলজপ্রাণী হওয়ায় সহজেই একে কুড়িয়ে নেওয়া যায়। বিভিন্ন প্রজাতির শামুক-ঝিনুক আয়ু ভিন্ন ভিন্ন। প্রকৃতিতে আকাটিনিডে শামুক ৫ থেকে ৭ বছর বাঁচে। আবার হেলিক্স প্রজাতির শামুক ২ থেকে ৩ বছর বাঁচে। বেশির ভাগ শামুকের মৃত্যু ঘটে শিকারির হাতে আর নয়তো পরজীবী দ্বারা। কিছু কিছু শামুকের ৩০ বছর পর্যন্ত বাঁচার নজির রয়েছে।

দেশের বিভিন্ন বিল ও চলনবিল-সমৃদ্ধ এলাকার প্রায় কয়েক হাজার মানুষ শামুক সংগ্রহ করে বিক্রি করে নিজেদের ভাগ্যবদল করতে সক্ষম হয়েছে। এসব বিল এলাকার থেকে শামুক সংগ্রহকারীরা বছরে শতকোটি টাকার ঝিনুক ও মুক্তার ব্যবসা করে থাকে। এসব পেশাজীবী শ্রমিকরা চুনকার নামে পরিচিত। তাদের পরনে চাকচিক্যময় পোশাক না থাকলেও তারা প্রতিদিন রোজগার করে কমপক্ষে এক থেকে দেড় হাজার টাকা। বিশেষ করে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নাটোর জেলার বিশাল অঞ্চল জুড়ে চলনবিল এবং পাবনার সুজানগরে গাজনার বিল থেকে শামুক-ঝিনুক সংগ্রহ করে প্রতি বছর যে পরিমাণ মুক্তা সংগ্রহ হয় তার দাম প্রায় ২০ কোটি টাকার। তাছাড়া ঝিনুক-শামুক থেকে তৈতি হচ্ছে মুরগি ও মাছের খাবার। তৈরি হচ্ছে চুন। এই দুই জেলার তৈরি চুন উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন জেলার চাহিদা পূরণ করছে। চলনবিল ও গাজনার বিল থেকে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ ঝিনুক সংগ্রহ করছেন একশ্রেণির পেশাজীবী শ্রমিক। প্রতিদিনের কুড়ানো ঝিনুক বগুড়া, রাজশাহী, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ থেকে মধ্যস্বত্বভোগীরা ট্রাকে পাইকারি হিসেবে ক্রয় করে নিয়ে যায়। এসব ঝিনুক-শামুক দিয়ে তৈরি হচ্ছে মুরগির খাবার, মাছের খাবার ও চুন।

ঢাকার দক্ষিণে পদ্মা নদীর তীরঘেঁষেই অবস্থিত বহুল পরিচিত আড়িয়ল বিল। বিলের উত্তর-পশ্চিমে দোহার ও নবারগঞ্জ উপজেলা এবং পূর্ব-দক্ষিণে সিরাজদিখান ও শ্রীনগর উপজেলার অবস্থান। ঢাকার দোহার, নবাবগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর, সিরাজদিখান উপজেলার প্রায় ১ লাখ ৬৬ হাজার একর জায়গায় ছড়িয়ে আছে ধানের মৌসুম শেষ হলে জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয় শামুক কুড়ানোর ধুম। প্রতিদিন প্রায় ২০ টন শামুক উত্তোলন করা হয় এই বিল থেকে। দোহার নবাবগঞ্জ অংশের দুবলী, মরিচপট্টি, শ্রীনগরের রাঢ়িখাল ও কেয়াটখালী এলাকায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলছে শামুক কুড়ানোর কাজ। ইরি মৌসুম শেষ হলে বৃষ্টির পানিতে ভেসে যেতে শুরু করে পুরো বিল। জুলাই মাসে বিলের মধ্যে শুধু পানি আর পানির সঙ্গে ভাসে শ্যাওলা ও লতাপাতা। জাল, জালি ও সরু কাপড দিয়ে পানির মাঝ থেকে ভাসমান শামুক তুলছে এলাকার সাধারণ দিনমজুররা। সঙ্গে রয়েছে ছোট ছোট কোষা নৌকা।

ঝিনুক সংগ্রহকারীরা মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে বিক্রি করে প্রতি মণ ৮০-৯০ টাকায়। এক মণ ঝিনুক থেকে চুন তৈরি হয় প্রায় ৩০ কেজির; যার বাজারমূল্য ৭০০ টাকা। তাছাড়া প্রতিদিন একজন শ্রমিক ৫০ থেকে ৬০ রতি মুক্তা সংগ্রহ করে থাকে; যা মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে ১০ টাকা রতি হিসেবে বিক্রি করে। গাজনা-চলনবিলে বছরে বিকিকিনি শতকোটি টাকা। পাবনা জেলার আটঘরিয়া উপজেলার খিদিরপুর গুচ্ছি গ্রামে ৯ শতাধিক শ্রমিক এ পেশায় জড়িত। তাদের মধ্যে অধিকাংশই বংশানুক্রমে এ পেশায় জড়িত আছে। শুধু পাবনা নয়, ৬৪ জেলার অধিকাংশ জেলায়-উপজেলায় তারা সারা বছর ঝিনুক কুড়ায়, তা বিক্রি করে যে টাকা পান, তাতে তাদের সংসার ভালোভাবেই চলছে। তাছাড়া মুক্তা বিক্রির টাকা তাদের বাড়তি রোজগার। এ টাকা তারা সঞ্চয় করতে পারেন বাড়তি উপার্জন হিসেবে।

শামুক-ঝিনুক পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পরিবেশ সহায়ক এ শামুকের অপরিকল্পিত ও অবাধে নিধন প্রতিরোধ না করলে জলদি প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ফসল উৎপাদন মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শামুকের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র তৈরি ও সংরক্ষণের এখনই পদক্ষেপ না নিলে এটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাই শামুকের অভয়ারণ্য তৈরির পাশাপাশি নিধন বন্ধে সবার সম্মিলিত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এই সম্পদ রক্ষা করা সরকার ও রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকেরই দায়িত্ব।

লেখক : সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close