অলোক আচার্য

  ১৯ অক্টোবর, ২০১৯

জিজ্ঞাসা

কবে আমরা মানবিক হব

দেশের মানুষ যখন বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরারের জন্য চোখের জল ফেলছে; ঠিক তখনই আরেকটি ঘটনা দেশবাসীকে হতবাক করে দেয়। সেটা হলো শিশু তুহিনের মৃত্যু। কী নির্মম, কী নৃশংস সে মৃত্যু; যা বাকশক্তি রোধ করে দেয়। সুনামগঞ্জে বাবা-চাচার হাতে নির্মমভাবে শিশু তুহিনকে মরতে হয়েছে। শুধু প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে তুহিনের বাবা, চাচা ও এক চাচাতো ভাই মিলে হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে রাখে। যে ছবিটি দেখে সারা দেশের মানুষ আঁতকে উঠেছিল। সামাজিক বিরোধ, হিংসা আর ক্রোধ আমাদের প্রায়ই বোধশূন্য করে দেয়। আমরা বিস্মিত যে, তুহিনকে যে হত্যা করেছে, সে তুহিনেরই বাবা-চাচা ও চাচাতো ভাই। একই পরিবারের রক্ত। আমাদের বিস্মিত হওয়ার শক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলেছি। একের পর এক নিষ্ঠুর ঘটনা আমাদের চোখের জলও শুকিয়ে ফেলেছে। কেবল গুজবের ওপর ভিত্তি করে যখন নিরপরাধ মানুষকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা হলো; তখনো আমরা হতভম্ব হয়েছি। এভাবেও মানুষকে মেরে ফেলা যায়! নিজের মনের কাছে কোনো জবাব দিতে পারিনি। আজও কোনো জবাব নেই। আজকের এই নিষ্ঠুর সমাজে নিরপরাধ মানুষগুলোর এমন অমানবিক মৃত্যু দেখে সমাজের ক্ষয়ে যাওয়া দিকে আঙুল উঠেছে। আমরা কোন সমাজে বসবাস করছি? এই সমাজের ভবিষ্যৎ কী? আজ যে নিষ্ঠুরতা মানুষের মনে জন্ম নিয়েছে; তা থেকে বের হতে কত দিন সময় লাগবে?

এ রকম আরো প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। তুহিনের মতো নিষ্পাপ শিশুর সঙ্গে ঘটে চলা নির্মমতা সমাজের কুৎসিত নষ্ট হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত বহন করে। তুহিনের হত্যাকান্ড নিয়ে যা দেখেছি, তা পড়তে গিয়েও শিউরে উঠতে হয়েছে। নিজের সন্তানকে এ রকম নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা যায় কেবল হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য, তা আমাদের ভাবনারও অতীত। সমাজে আজ এমন ঘটনা ঘটছে, যা কেউ ভাবতেও পারে না। বারবার প্রশ্ন উঠছে, তাহলে শিশুর নিরাপত্তা কোথায়? বাবার বুক যেখানে পরমনির্ভরতার আশ্রয়; সেখানে তুহিনকে এভাবে হত্যা করে সেই নিরাপত্তার আশ্রয়টিকে প্রশ্ন করেছে। যে এভাবে নিজ সন্তানকে হত্যা করতে পারে; সে তো মানুষ নয়, পশু! আবার পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট বলা যায়। পশুরাও নিজের সন্তানকে বাঁচানোর জন্য নিজের সবটুকু উৎসর্গ করে, সেখানে আমরা তো বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ!

এই সমাজ আসলে কোনদিকে অগ্রসর হচ্ছে? বর্তমানে আমাদের সমাজের ঘটনাপ্রবাহে নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছে। যে সমাজের কাউকে পিটিয়ে হত্যা করতে বিবেক বাধা দেয় না, শিশুর ওপর নির্যাতন করতে বিবেক বাধা দেয় না, চলন্ত বাস থেকে অত্যাচার করে ছুড়ে ফেলতে বিবেক বাধা দেয় না; সেই বিবেক নিয়ে প্রশ্ন তো জাগতেই পারে। বিবেকবোধ, জ্ঞান, সংযম, প্রেম সব কিছু বর্জন করে আঁকড়ে ধরে আছি মিথ্যে অহমিকাকে। যান্ত্রিক সভ্যতার উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে মানবিক সভ্যতা বিলীন হতে শুরু করেছে। দিন যত এগিয়ে যাচ্ছে এই মানবতার সংকট তত ঘনীভূত হচ্ছে। নিত্যনতুন ডিজাইনের পোশাক গায়ে দিয়ে রাস্তায় বের হচ্ছি, কিন্তু প্রকৃত লজ্জার মাথা খেয়ে বসে আছি। যেখানে মন নেই, রুচি নেই, মনুষ্যত্ব নেই, বিবেক নেই, ঘৃণা নেই, মানবিকতা নেই; সেখানে কোন সভ্যতার উত্তরণ ঘটছে, জানি না। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশনের খবরে সমাজের অস্থির চিত্র দেখি। দেখতে দেখতে চোখ সয়ে গেছে। মনের বোধের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। বিবেকের কোনো মূল্য নেই। আবেগ দিয়ে কিছুই হয় না। সেসব ভয়ংকর চিত্র দেখেও কোনো অনুভূতি হয় না। মনটা অজানা আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। কিছুই করার থাকে না। সভ্যতার বিকাশ সাধন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই যাত্রা তো ফের উল্টোদিকে টানছে না আমাদের। পশুর মতোই বোধশূন্য।

পশুর চেয়েও ক্ষেত্রবিশেষে হিংস্রতায় আমরাই এগিয়েছি। সময়ের উল্টোযাত্রায় আজ আমরা সবাই সামিল হয়েছি। অল্প কজন ভালো মানুষ এ সমাজে আজ বড় বেকায়দায়। তারা এই আড়ম্বরপূর্ণ সমাজ নিয়ে কিছুটা বিরক্ত। খুলনার রাকিবের কথা মনে আছে? মলদ্বারে বাতাস ঢোকানোর ঘটনার মতো একটি নিষ্ঠুর ঘটনা আমাদের সামনে আসে। ভেবেছিলাম প্রথমবার ঘটার পরই ঘটনাটার পরিসমাপ্তি ঘটবে। কিন্তু তা হয়নি। তারপর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে একটি তুলা কারখানায় এক শিশু শ্রমিককে মলদ্বারে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করা হলো। শিশুটির নাম ছিল সাগর বর্মণ। ভারতে যখন চলন্ত বাসে একজন মেয়েকে ধর্ষণ করে বাস থেকে ফেলে হত্যা করা হয়, তারপর আমাদের দেশেও এ রকম ঘটনা ঘটতে থাকল। বাসে ধর্ষণ করার বিষয়টি ঘটতে থাকল।

শিশুরা ফুলের মতো। তাদের নিরাপদে বড় হয়ে ওঠার অধিকার রয়েছে। সমাজে শিশুর জন্য নিরাপদ পরিবেশ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। আমাদের দেশে শিশু হত্যা, ধর্ষণ, গৃহকর্মীর ওপর অত্যাচার বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে ধর্ষণের ঘটনা। সম্প্রতি বিশ^ শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ উপলক্ষে অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট (এএসডি) ও বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম আয়োজিত ‘শিশু অধিকার ও বর্তমান পরিস্থিতি’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া তথ্যে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৪৯৬ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে; যা গত বছর ছিল ৫৭১ জন। গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে শিশু ধর্ষণ বেড়েছে ৪১ শতাংশ হারে। এটি অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। নির্যাতনের টার্গেট করা হচ্ছে শিশুদের। ধর্ষণের মতো কুৎসিত লালসা মেটাতে শিশুদের টার্গেট করা হচ্ছে। কারণ শিশু শারীরিকভাবে দুর্বল এবং খুব সহজেই ভীত হয় এবং সবাইকে সরলতার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে। ফলে তাদের প্রভাবিত করা, তাদের ওপর নির্যাতন করা হচ্ছে। এই হার বৃদ্ধি পাচ্ছে অর্থ হলো সমাজে নোংরা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আমরা শিশুর জন্য একটি নিরাপদ সমাজ গড়তে ব্যর্থ হয়েছি। সমাজের প্রতিটি শিশুই সমান অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো যে, সমাজে সব শিশু সমান অধিকার নিয়ে জন্মায় না। বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন সমাজে শিশুকে নির্যাতন ও নিগৃহের শিকার হতে হয়। এবং প্রায়ই তা আমাদের মতো বড়দের কাছেই হয়। আমাদের জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও আমরা অজ্ঞানের মতো কাজ করছি। এত সব বিবেচনায় এই সমাজকে সভ্য বলতে দ্বিধা হয়। সভ্য হলে সামিয়ার মতো নিষ্পাপ শিশু ধর্ষণের শিকার হবে? একের পর এক ঘটনা আমাদের সামাজিক মূল্যবোধকে দুর্বল করে ফেলেছে। আমরা একটি নিরাপদ সমাজ গড়তে চাই। আর সে কাজে বাধা হচ্ছে তুহিনের বাবার মতো, শিশু ধর্ষকদের মতো, গৃহকর্মী অত্যাচারীদের মতো কিছু মানুষরূপী শয়তান। আমরা বারবার সভ্যতার দোহাই দিয়ে নিজেদের জাত উঁচু করার চেষ্টা করছি। কিন্তু লাভ হয়নি। সব দায় ঠেলে হিংস্রতা বেরিয়ে আসছে। সবচেয়ে হ্রিংস কে? এ প্রশ্নের উত্তরও হবে মানুষ। সবচেয়ে লোভী আর অহংকারী প্রাণীটির নামও মানুষ। মানুষকে ঠকিয়ে বড় হওয়ার চেষ্টা করে এই আধুনিক সভ্যতার মানুষই। মানুষ হওয়ার চেষ্টা করেও মনুষ্যত্ব অর্জন করতে পারিনি। তুহিনের মতো শিশু এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার আগে মানুষ সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণা নিয়ে গেল। আমাদের দুঃখ এখানেই। তুহিনদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার ভাষাও নেই। তুহিনদের জন্য কত দিনে নিরাপদ পৃথিবী গড়তে পারব, তার নিশ্চয়তা নেই। তবে চেষ্টা তো করতেই হবে তুহিনরা যেন এই সমাজ সম্পর্কে, মানুষ সম্পর্কে ভালো ধারণা পেয়ে নিরাপদে বড় হয়ে ওঠে। আজকের তুহিনরাই আগামীর বাংলাদেশ গড়ার শক্তি।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close