সাধন সরকার

  ১৬ অক্টোবর, ২০১৯

মুক্তমত

জলবায়ু দুর্যোগ প্রশমনই চ্যালেঞ্জ

১৩ অক্টোবর ‘আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন’ দিবস। দুর্যোগ বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে প্রতি বছর এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশে দেশে দেখা দিচ্ছে নানা ধরনের দুর্যোগ। জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের প্রধান কারণ মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ তথা বায়ুম-লের তাপমাত্রা বৃদ্ধি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে প্রত্যেকটি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সব দেশ বা স্বল্পোন্নত দেশগুলো কিন্তু জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের জন্য দায়ী নয় আর দায়ী থাকলেও তার প্রভাব নগণ্য। যেসব দেশ কার্বন নিঃসরণে সবচেয়ে কম দায়ী, তারাই জলবায়ু পরিবর্তনগত দুর্যোগের সবচেয়ে বেশি শিকার। উন্নত দেশসমূহের মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে, মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। সম্প্রতি জাতিসংঘ তাদের এক সতর্কবার্তায় বলেছে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত এই পাঁচ বছর হতে যাচ্ছে পৃথিবীর উষ্ণতম বছর। ‘সায়েন্স অ্যাডভাইজরি গ্রুপ’র বরাত দিয়ে জাতিসংঘ বলেছে, শিল্পযুগের (১৮৫০ থেকে ১৯০০) আগের তুলনায় ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এ সময়ের গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ সেলসিয়াস বেশি। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ২০১৮ সালে কার্বন-ডাই অক্সাইডের নিঃসরণের হার ২ শতাংশ বেড়েছে। এর ফলে ২০১৮ সাল ২ হাজার ৭০০ কোটি টন কার্বন-ডাই অক্সাইডের নিঃসরণের রেকর্ড ছুঁয়েছে। তথ্যে আরো বলা হয়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১৯৯৩ সাল থেকে গড়ে ৩ দশমিক ২ মিলিমিটার হারে বেড়েছে। আর ২০১৪ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত এই বৃদ্ধির হার ছিল ৫ মিলিমিটারে ঠেকেছে।

২০১৫ সালে জলবায়ু সম্মেলনে হওয়া ‘প্যারিস চুক্তি’ মানতে উন্নত দেশসমূহ এখনো একমত হতে পারছে না! যেভাবে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে তাতে ভবিষ্যতে সমগ্র মানবজাতির জন্য কী অপেক্ষা করছে, তা কেউ-ই বলতে পারছে না! তবে ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সমগ্র মানবজাতির জন্য খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে বলে ধরে নেওয়া যায়! জলবায়ুজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহের জন্য উন্নত দেশসমূহ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অর্থায়ন দিতেও গড়িমসি করছে। সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে পৃথিবীকে রক্ষার দাবিতে সোচ্চার হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা। মূলত জলবায়ুকন্যা তথা সুইডিশ স্কুলছাত্রী ও পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গের ধারণায় অনুপ্রাণিত হয়েই বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় ১৫০টির বেশি দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরে (বাংলাদেশের ঢাকাসহ) আন্দোলনে নেমেছে শিক্ষার্থীরা। মূলত পরিবেশ তথা জলবায়ু বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় বিশ্ব নেতাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা এই আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তসরকারি প্যানেলের (আইপিসিসি) নতুন এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হিমালয় থেকে শুরু করে আ্যান্টর্কটিকাজুড়ে বরফ ও হিমবাহের স্তূপ দ্রুত হারে গলে যাচ্ছে। মূলত গ্রিনহাউস গ্যাসের উদ্গিরণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এই ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। আবার সমুদ্রের লবণাক্ততার বিরূপ প্রভাব বাষ্পীভবনের হারকে বাড়িয়ে দিয়েও সমগ্র পানিচক্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ফলে দেখা দিচ্ছে প্রকৃতির বিরূপ প্রভাব। জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগে বাংলাদেশে প্রায় দুই কোটির মতো শিশুর জীবন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে (যদিও এর মধ্যে রোহিঙ্গা শিশুরাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে)। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, উপকূলীয় লবণাক্ততাসহ নানা কারণে এসব শিশু ঝুঁকিতে রয়েছে। উল্লেখ্য, ঘূর্ণিঝড়ে ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ৩ লাখ এবং ১৯৯১ সালে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বাংলাদেশ যদিও আগের থেকে দুর্যোগ মোকাবিলায় বর্তমানে বহু গুণ সক্ষমতা অর্জন করেছে। যদিও জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ নিজের মতো করে কাজ করে যাচ্ছে।

মূলত মানুষের নানাবিধ কর্মকা-ের ফলে পরিবেশে যে তাপ তৈরি হয়, তার প্রায় সবটাই সমুদ্র শুষে নেয়। তাই বরফ গলার হার আগের থেকে বেড়েই চলেছে, বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা! জলবায়ু দুর্যোগের শিকার হয়ে দেশে দেশে মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ^নেতাদের এখনই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কেননা, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে উপকূলীয় দেশসমূহে মানুষের জীবনযাত্রার ওপর ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিশ্ব অর্থনীতির গতি ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। মানুষে মানুষে বৈষম্য তথা অসমতা তৈরি হচ্ছে। এখনই বাংলাদেশসহ সব দেশকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরে এসে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে অগ্রসর হতে হবে। আগামী দিনের খরা, দাবদাহ ও হিমবাহ গলনের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানি-পোড়ানো পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। বিশে^র প্রতিটি দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কিশোর-তরুণ জনগোষ্ঠীকে বৃক্ষরোপণের প্রতি উৎসাহিত করতে হবে। পলিথিন-প্লাস্টিকের ব্যবহার যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি মানুষের এই সুন্দর পৃথিবী অযাচিত কর্মকা-ের ফলে একটু একটু করে আমরা যদি অনিরাপদ করে তুলি, তাহলে তার বিরূপ প্রভাব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর মারাত্মকভাবে পড়বে।

লেখক : পরিবেশকর্মী ও কলামিস্ট

সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close