রহিম আবদুর রহিম

  ১০ আগস্ট, ২০১৯

মুক্তমত

ছিটমহল বিনিময় ঈর্ষণীয় সাফল্য

দক্ষিণ এশিয়া তথা পৃথিবীর সভ্য জগতে নাগরিকত্বহীন এক মানবগোষ্ঠীর পরিচয় ছিল ছিটমহলবাসী। যে মহল, কোনো একটি রাষ্ট্রের খ- অংশ বা ভূখ-, অন্য কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে; যা ওই রাষ্ট্রের আইন সীমানা দ্বারা বেষ্টিত ছিল। এমন ভূখ-ই ছিটমহল বলে পরিচিত হয়ে আসছিল। এই ভূখ-েই বসবাসরত প্রায় ৫১ হাজার মানুষ যারা সভ্য সমাজের ভৌগোলিক অবস্থান থেকে দীর্ঘ ৬৮ বছর বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করেছে।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পরপরই ১৯৪৮ সালে নব্য স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তান এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যকার ছিটমহল সংক্রান্ত সমস্যার বিষয়টি প্রকাশ হয়। ১৯৭৪ সালে ১৫ মে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যে চুক্তি ‘মুজিব-ইন্দিরা’ চুক্তি নামে ইতিহাসে স্থান পায়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। সীমান্ত চুক্তি চাপা পড়ে যায় স্বার্থের অতল গহ্বরে। অবরুদ্ধ, রাষ্ট্রবিহীন ছিটমহলবাসী নির্যাতিত হতে থাকে। লুটপাট হয় সহায়-সম্পত্তি। আইন-আদালত কখনই ধারেকাছে পৌঁছাতে পারেনি। ২০১০ সালের এক দুপুরে তৎকালীন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গারাতি ছিটমহলে তা-ব চালায় বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার চার ইউনিয়নের প্রায় ১০ হাজার মানুষ। ১৯৭১-এর কায়দায় ছিটবাসীদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়। লুটতরাজ করা হয় ফসল এবং গৃহপালিত পশুসহ ঘরের সহায়-সম্পত্তি। ঘটনার সূত্রপাত জমিজমা সংক্রান্ত এক বিরোধকে কেন্দ্র করে রমজান আলী নামক এক ব্যক্তির খুনের মধ্য দিয়ে। এ ঘটনায় ওই সময় দেশ-বিদেশে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, চ্যানেল, রেডিও টেলিভিশনের সংবাদকর্মীরা কোমর বেঁধে মাঠে নামেন মানবতা প্রতিষ্ঠায়। ভারত এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মগজে নাড়া পড়ে। ভুক্তভোগীরা রাষ্ট্রীয় অধিকার পেতে আন্দোলনে নেমে আসে। চতুর্মুখী আন্দোলন, মানবিক আবেদন, বাংলাদেশ-ভারত সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ২০১৫ সালের ৬ জুনের অনুসমর্থনের দলিল বিনিময়ের ধারাবাহিকতায় সেই বছরে ১ আগস্ট রাত ১২টা ১ মিনিটে ১৯৭৪ ‘মুজিব ইন্দিরা’ চুক্তির আওতায় একে অন্যের অভ্যন্তরে থাকা ছিটমহলগুলো পরস্পরের সঙ্গে বিনিময় হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের তৎকালীন ছিটমহলগুলোর মধ্যে লালমনিরহাট জেলায় ৫৯টি, পঞ্চগড়ে ৩৬টি, কুড়িগ্রামে ১২টি এবং নীলফামারীতে ৪টি। এর মধ্যে ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ছিটমহলের সংখ্যা ছিল ৫১টি। যেখানে মোট ভূমির পরিমাণ ৭১১০.২ একর। যার লোকসংখ্যা ১৭ হাজার। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ছিটমহল ছিল ১১১টি, যেখানে ভূমির পরিমাণ ১৭১৫৮.১৩ একর, এখানকার লোকসংখ্যা ৩৪ হাজার। ছিটমহল বিনিময়কালে ১১১টি ছিটমহল থেকে ৯২১ জন অধিবাসী ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন। পক্ষান্তরে ভারত থেকে কোনো নাগরিক বাংলাদেশে আসেনি।

দীর্ঘ ৬৮ বছর যে ভূভাগের মানুষরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন আদালত থেকে বঞ্চিত ছিল, ভয়-আতঙ্ক যাদের একসময় নিত্যসঙ্গী ছিল। তারা এখন পাকা সড়কে হাঁটে, বিদ্যুৎ বাতির আলোতে আলোকিত অঞ্চল, স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, স্বাস্থ্যকেন্দ্র হাতের নাগালে। চাকরি হচ্ছে সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্যাংকিং সেবা ঘরে ঘরে। মাতৃকালীন, বয়স্ক, বিধবা ভাতা পাচ্ছে নিয়মিত। মসজিদ, মন্দির চকচকে। ব্যাপক উন্নয়ন সত্যিকার অর্থেই ঈর্ষাণীয়! সম্প্রতি আইসিটিতে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আইসিটি সম্পর্কীয় মৌলিক জ্ঞান বিস্তার, যুব সম্প্রদায়কে হাতে-কলমে আইসিটি শিক্ষায় দক্ষ করে স্বাবলম্বী, বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আইসিটি শিক্ষায় উপযুক্ত অবকাঠামো নির্মাণ ও পরিবেশ নিশ্চিত এবং সরকারি বিভিন্ন ই-সেবা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির জন্য এক বৃহৎ প্রকল্প চালু হয়েছে। সব মিলিয়ে বিলুপ্ত ছিটমহলগুলো উন্নয়নের ফিরিস্তি অত্যন্ত সন্তোষজনক। ছিটমহল বিনিময়ে ৪ বছর অতিবাহিত। ছিটমহল বিনিময়, মানবতা প্রতিষ্ঠা, মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়নে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ বাংলাদেশ ও ভারতে নেতৃত্বদানকারী নেতাকর্মী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের মুজিববর্ষে ‘মুজিব-ইন্দিরা’ পদকে ভূষিত করার বিষয়টি বিবেচনায় নিলে ইতিহাসের পাতা পরিমার্জিত হবে বলে অনেকেই মনে করছেন।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close