ইসমাইল মাহমুদ

  ০৫ আগস্ট, ২০১৯

পর্যবেক্ষণ

বিদ্যালয়গুলোতে কমছে ঝরে পড়ার হার

আমার দাদু ছিলেন গ্রামের প্রধান মুরব্বি ও জনেবলে প্রভাবশালী। আমার বাবা আমার দাদিমার গর্ভে জন্ম নেওয়া একমাত্র পুত্রসন্তান। তাই পরিবারে আদরের কমতি ছিল না। সবার চোখের মণি ছিলেন আমার বাবা। আমার দাদিমা আমার ছোটবেলা আমার সঙ্গে গল্পচ্ছলে এক দিন বললেন, ‘তোমার বাবা আমার এতই আদরের ছিল যে, মাথায় তুলে রাখতাম না উঁকুনে খাবে, মাটিতে রাখতাম না পিঁপড়ায় খাবে। তাই তাকে বুকে আগলে রাখতাম।’ তাই ছোটবেলা থেকেই আমার পিতা ছিলেন একরোখা ও অসম্ভব জেদি স্বভাবের। দুষ্টামিতে তার ছিল জুড়ি মেলা ভার। আমার পিতার বয়স যখন সাড়ে পাঁচ বছর; তখন আমার দাদু তাকে পাশের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দেন। আমার দাদুও ছিলেন তার পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান। তিনি খুব একটা লেখাপড়া করেননি। ফলে অনেক আশা করে আমার পিতাকে স্কুলে পাঠান। দুষ্টামিতে বাঁধনহারা আমার পিতা ধীরে ধীরে দুটি বছর কাটিয়ে দেন। তখন তিনি তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। এক দিন স্কুল চলাকালীন সময়ে তিনি সহপাঠীর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে দুষ্টামি করছিলেন। এ সময় ওই সময়ের পুরো মহকুমায় জাদরেল শিক্ষক হিসেবে খ্যাতি পাওয়া শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে আসেন। ওই শিক্ষককে দেখলেই নাকি পিনপতন নীরব হয়ে যেত শ্রেণিকক্ষ। কেউ কারো সঙ্গে কথা বলা তো দূরের কথা নিঃশ্বাস ফেলাও অনেকটা বন্ধ হয়ে যেত। এদিকে ওই জাদরেল শিক্ষক ছিলেন আমার দাদুর সঙ্গে গ্রামের মুরুব্বিয়ানা নিয়ে যাদের শত্রুতা সেই পরিবারের। তো সেদিনের দুষ্টামিতে ওই শিক্ষক এমন ক্ষেপে গেলেন যে, আমার পিতাকে তারই সেøট দিয়ে মাথায় আঘাত করে বসেন। আমার পিতার মাথা ফেটে রক্ত ঝরতে লাগল। খবর পেয়ে আমার দাদু ছুটে আসেন স্কুলে এবং ঘোড়ায় করে নিয়ে যান শহরের হাসপাতালে। ঘটনার পর ৭ গ্রামবাসীকে নিয়ে বসে সালিস বৈঠক। আমার দাদু বৈঠকের পর জেদ ধরলেন যে স্কুলে তার একমাত্র ছেলের রক্ত ঝরেছে সেখানে আর ছেলেকে পাঠাবেন না। প্রয়োজনে ছেলেকে লেখাপড়াই শেখাবেন না। যেমন কথা তেমন কাজ। আমার পিতার আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। একটু বোঝার বয়স যখন আমার পিতার হয়েছিল; তখন তিনি আফসোস করতেন যদি ওই শিক্ষক এভাবে তাকে আঘাত করে রক্ত না ঝরিয়ে দুষ্টামি না করার জন্য মানবিকভাবে বোঝাতেন বা আদর-স্নেহে পড়ানোর চেষ্টা করতেন; তবে তার শিক্ষাজীবন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হতো না।

এরপর যখন আমার জন্ম হলো, ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলাম, তখন থেকেই আমার পিতা তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা আমাকে বর্ণনা করে আমাকে নৈতিক শিক্ষা দিতে লাগলেন। কী করলে সমাজের চোখে আমি আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারি; সে শিক্ষার প্রথম পাঠের শিক্ষক আমার স্বল্প শিক্ষিত পিতা। আমাকে যখন স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে গিয়েছিলেন তখন আমার পিতাও শহরের প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। তবে দাদুর মতো জনেবলে নয়, সম্মানের আসনে তার খ্যাতি তখন আকাশচুম্বী (পরবর্তীতে তিনি শ্রীমঙ্গল পৌরসভার কমিশনার, প্যানেল অব চেয়ারম্যান, প্রাইমারি স্কুল কমিটির সভাপতি, হাইস্কুল কমিটির শিক্ষানুরাগী সদস্য, রেলওয়ে ও জালালিয়া মসজিদ কমিটির সভাপতিসহ নানা সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন)। আমাকে স্কুলে নিয়ে প্রথম দিনেই আমার পিতা প্রধান শিক্ষককে বলে আসেন, ‘ছেলেকে স্কুলে দিয়ে গেলাম, নৈতিকতার বিপর্যয় ঘটলে, দুষ্টামি করলে পিটিয়ে মাংস তুলে ফেললেও আমার দুঃখ নেই।’ দ্বিতীয় দিনের শ্রেণিকক্ষেই প্রধান শিক্ষক আমাকে বললেন, ‘তোমার বাবা যেভাবে সমাজের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠেছেন; তেমনি তোমাকেও তার নাম, খ্যাতি, যশ রক্ষায় এগিয়ে যেতে হবে।’ আমার সেই প্রধান শিক্ষকের কথা এখনো আমি মনে প্রাণে ধারণ করে আছি।

এবার আসি মূল বক্তব্যে। প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকের বেত্রাঘাতে অনেকের শিক্ষাজীবন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছেÑ এমন উদাহরণ রয়েছে ভূরিভূরি। বিদ্যালয়গুলোতে ঝরে পড়ার হার ক্রমেই বাড়ছিল। একটা সময় এমন অবস্থা তৈরি হয় যে, পিতা-মাতা সন্তানকে স্কুলে পাঠালে সে সন্তান স্কুলে না গিয়ে বাইরে বাইরে ঘুরে বিকালে বাড়ি ফিরে যেত। যেসব কারণে বিদ্যালয়গুলোতে ঝরে পড়ার হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছিল তার মধ্যে অন্যতম কারণ ছিল শিক্ষকের বেত্রাঘাত ও মানসিক শাস্তি। ২০১০ সাল পর্যন্ত শিক্ষকের বেত্রাঘাত না খেয়ে শিক্ষাজীবনের সব শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে এমন শিক্ষার্থী আতশকাচ লাগিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

২০১১ সালের ১৩ জানুয়ারি হাইকোর্ট প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেওয়ার নামে নির্যাতনকে সংবিধান পরিপন্থি ঘোষণা করেন। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বন্ধে নীতিমালা চূড়ান্ত করে তার আলোকে ব্যবস্থা নিতে সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ নির্দেশনার আলোকে ২০১১ সালের ২৬ এপ্রিল সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ১১ ধরনের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি নিষিদ্ধ করে সরকার। নিষিদ্ধ শারীরিক শাস্তিগুলো হলোÑ শিক্ষার্থীদের হাত-পা বা কোনো কিছু দিয়ে আঘাত বা বেত্রাঘাত, চক বা ডাস্টার জাতীয় বস্তু ছুড়ে মারা, আছাড় দেওয়া ও চিমটি কাটা, শরীরের কোনো স্থানে কামড় দেওয়া, চুল টানা বা কেটে দেওয়া, হাতের আঙুলের ফাঁকে পেনসিল চাপা ও মোচড় দেওয়া, ঘাড় ধাক্কা দেওয়া, কান টানা বা ওঠবস করানো, চেয়ার, টেবিল বা কোনো কিছুর নিচে মাথা দিয়ে দাঁড় করানো বা হাঁটু গেড়ে দাঁড় করিয়ে রাখা, রোদে দাঁড় করে বা শুইয়ে রাখা কিংবা সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড় করানো এবং শ্রম আইনে নিষিদ্ধ কোনো কাজ শিক্ষার্থীদের দিয়ে করানো। এ ছাড়া শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে মা-বাবা, বংশপরিচয়, গোত্র-বর্ণ ও ধর্ম স¤পর্কে অশালীন মন্তব্য, অশোভন অঙ্গভঙ্গি করা বা শিক্ষার্থীদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে এমন বিষয়গুলোও মানসিক শাস্তি হিসেবে চিহ্নিত হবে বলে সেখানে জানানো হয়। কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে এ ধরনের শাস্তি দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হলে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। প্রয়োজনে ফৌজদারি আইনেও সেই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

এদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধের বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে চারটি সেøাগান নির্ধারণ করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। এসব সেøাগান যুক্ত হয়েছে সরকারি চিঠিতে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ দফতর ও সংস্থা থেকে মাঠপর্যায়ে পাঠানো সব চিঠিতে পর্যায়ক্রমে এসব সেøাগান ইতোমধ্যে সন্নিবেশিত করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। সেøাগানগুলো হলো : ১.‘শাস্তিমুক্ত বিদ্যালয়, শিক্ষা লাভে সহায় হয়’, ২. ‘শিশুর জন্য বেত ছাড়ি, সৃজনশীল বাংলা গড়ি’, ৩. ‘আদর আর ভালোবাসা, দিতে পারে সুশিক্ষা’, ৪. ‘শিখবে শিশু হেসে খেলে, শাস্তিমুক্ত পরিবেশে পেলে’।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close