রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০৪ আগস্ট, ২০১৯

পর্যালোচনা

মানসিক বিকাশেই শিশুর কল্যাণ

আমরা তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই। মা-বাবার ঘরটা হয়তো শিশুর জন্য সাজানো বাগানই। কিন্তু এই পৃথিবীটাকে কি আমরা করতে পেরেছি তার জন্য সাজানো বাগানের মতো? অথবা সুকান্তের সেই বাসযোগ্য পৃথিবী? হয়তো পেরে উঠিনি। কিন্তু শিশুটিকে আমরা যদি বড় করে তুলি আপন মমতায়, সঠিক বিকাশে, তাহলে সে হয়তো তার পৃথিবীটাকে তার মতো করেই বাসযোগ্য করে তুলবে। মনের মতো সাজাবে আপন পৃথিবীর বাগানটাকে। এখনকার শিশুরা ফাস্ট ফুড খাচ্ছে, ঘরে বসে বসে টিভি দেখছে, কম্পিউটারে গেমস খেলছে। এতে শিশুরা বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শিশু বয়সে অনেকে উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধি এবং ডায়াবেটিসেও আক্রান্ত হচ্ছে, লিভার ফ্যাটি হয়ে যাচ্ছে। এভাবে যদি চলতে থাকে তবে দেশের শিশুদের জন্য অনেক কঠিন, জটিল, দুরারোগ্য রোগব্যাধি অপেক্ষা করছে বলে শিশু এবং অন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অভিমত। শিশুদের ভূরি ভূরি বইপত্র আর লেখাপড়া দিয়ে তাদের মনোজগতে এত মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে যে, সে ঘরে লেখাপড়া শেষ করে বাইরে কিছুক্ষণ যে খেলাধুলা করবে সে সময়টুকু বের করা খুব কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে। আবার আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের খেলাধুলার জন্য একটি মাঠও রাখিনি। সব দখল হয়ে গেছে। সাঁতার শিখবে তার জন্য এলাকায় একটি দিঘি, জলাশয় বা পুকুরও রাখিনি।

অগত্যা কম্পিউটার, স্মার্টফোনে তারা গেমস খেলছে, টিভিতে বিভিন্ন ভাষার কার্টুন দেখছে, হিন্দি টিভি চ্যানেলের কল্যাণে হিন্দি ভাষায় নির্মিত কার্টুন দেখে দেখে হিন্দি শিখে গেছে। জাতিসংঘের শিশু অধিকার কনভেনশন অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে সব মানুষই শিশু হিসেবে বিবেচিত। শিশুদের বিদ্যা বুদ্ধি মেধা জ্ঞান আহরণের পরিবেশ প্রদানের পাশাপাশি তাদের মননশীলতা, সৃষ্টিশীলতা, খেলাধুলা, শারীরিক সুস্থতার দিকেও আমাদের মনোযোগী হওয়া উচিত। শিশুদের ব্যক্তিত্ব, মুক্তবুদ্ধি চিন্তা-চেতনার বিকাশ প্রকাশ ঘটানোর জন্য, স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক সচেতনতা ও দায়বদ্ধতার মাধ্যমে দক্ষতা অর্জনের জন্য স্কুলের নির্দিষ্ট একাডেমিক শিক্ষার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ আবশ্যক। পাশাপাশি খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড যেমন নাচ, গান, ছবি আঁকা, নাটক, আবৃত্তি, গল্প বলা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসে বক্তৃতা ও আলোচনা করা এবং সামাজিক কর্মকান্ডে মানবিক ও নৈতিক গুণাবলির চর্চাকে সচল রাখাটাও জরুরি। দরিদ্র ও পথশিশুদের আর্থিক সাহায্য এবং দরিদ্র এবং অসহায় মানুষকে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দান, শীতকালে বা বন্যাদুর্গত এলাকায় খাদ্য, বস্ত্র, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন ও বাগান করা এবং রাস্তার ধারে বা বিভিন্ন পতিত স্থানে গাছ লাগানো, শিশু সমাবেশ, নিরক্ষরদের পাঠদান, ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে ধর্মীয় রীতিনীতি ও আচার অনুষ্ঠান শিক্ষা, ফার্স্ট এইড শিক্ষা, শিশু অধিকার নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা দেশ ও জাতির নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। দেশের প্রতিটি শিশুকে স্কুলে পাঠানো, শিক্ষাদান সুনিশ্চিত করার পাশাপাশি শিশুশ্রম বন্ধ করাও জরুরি পাশাপাশি বিরত রাখতে হবে ঝুঁকিপূর্ণ ওয়েল্ডিং, চামড়াশিল্প, নির্মাণকাজসহ বিভিন্ন কাজকর্ম থেকেও।

তথ্য মতে, ১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ শিশু অধিকার বিষয়ে একটি কনভেনশন বা সনদ গ্রহণ করে। ওই সনদের সূচনায় বলা হয়েছে-শৈশবে শিশুদের প্রদান করতে হবে বিশেষ যতœ ও সহায়তা; শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও সাবলীল উন্নয়নের জন্য তাকে পারিবারিক পরিবেশে লালন-পালন করতে হবে এবং পরিবারে থাকতে হবে শান্তি, ভালোবাসা ও পারস্পরিক সহযোগিতা; জন্মের আগে ও পরে শিশুর প্রয়োজন আইনানুগ ও বিশেষ নিরাপত্তা এবং যতœ; এবং বিশ্বের অনেক দেশে অনেক শিশু খুবই কঠিন অবস্থায় রয়েছে, তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়োজন। এর পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশে শিশু অধিকার আইন, ২০১৩ সংসদে গৃহীত হয়েছে। বর্তমান সরকার শিশুদের শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে। বছরের প্রথম দিনেই শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দিচ্ছে যা শিক্ষার্থীদের আনন্দিত এবং শিক্ষায় যে উদ্বুদ্ধ করছে তা বলাই বাহুল্য। শিক্ষার্থীদের জন্য সরকার অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করলেও প্রাথমিকের পর থেকে ধীরে ধীরে শিশুদের ঝরে পড়ার সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। বর্তমানে আমাদের শিশুরা কি তাদের বেড়ে ওঠার জন্য জাতিসংঘের কনভেনশন এবং আমাদের দেশের আইন-কানুন অনুযায়ী তাদের জন্য প্রযোজ্য শিশু অধিকার, সুযোগ-সুবিধাগুলো কি পাচ্ছে ? যদি পেয়ে থাকে তবে কতটুকুই বা পাচ্ছে? সহজ সরল উত্তর হচ্ছে একটি বিরাট না। বরং আমরা শিশুদের ঘাড়ে বইয়ের বিরাট বোঝার এক একটি ব্যাগ তুলে দিয়েছি। শ্রেণি অনুযায়ী তাদের পড়ার বিষয় এবং বইয়ের ছড়াছড়ি। শিশুরা বইয়ের আর পড়ার ভারে নুইয়ে পড়ছে। কিন্তু সেদিকে কারো খুব একটা নজর আছে বলে মনে হয় না।

এছাড়া কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ইংরেজি মিডিয়ামের শিশুদের তাদের মস্তিষ্কের ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত পাঠ্যপুস্তক দেওয়া হয়েছে। একটি দালান কোঠা আর কয়েকজন শিক্ষক হলেই কিন্তু একটি স্কুল খুলে দারুণ শিক্ষাধান্ধায় আপনিও নেমে যেতে পারেন নির্দ্বিধায়। প্রফিট নিয়ে কোনো চিন্তা নেই, নেই টেনশন। বরং নিশ্চিন্তে বিভিন্ন উপায়ে শতভাগ লাভ এখানে। শিক্ষা এখন মৌলিক অধিকার বা বিষয় নয় যেন একটি বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। ফলে অলিতে গলিতে পর্যন্ত স্কুলসহ নানা ধরনের শিক্ষালয় ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে। আগে বিরাট বিশাল খেলার মাঠ ছাড়া কি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় চিন্তা করা যেত। নিজস্ব ব্যায়ামাগার, কমনরুম, লাইব্রেরিসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা তো অবশ্যই থাকতে হতো। সেই বিরাট মাঠে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পাশাপাশি জাতীয় সংগীত গাওয়ার জন্য অ্যাসেম্বলি শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল বাধ্যতামূলক। তাছাড়া মাঠে শরীরচর্চার ক্লাস হতো। হতো বিভিন্ন শারীরিক কসরত এবং খেলাধুলা। এসব বিষয় খুব কড়াকড়িভাবে পালন করা হতো। এখন আর সেই সবের চিহ্নটুকুও খুঁজে পাওয়া যায় না। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আন্তঃস্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে খেলাধুলার প্রতিযোগিতার প্রচলন এখন আর দেখা যায় না। বরং তা উঠে গেছে বলাই ভালো।

আশার বিষয় হচ্ছে, বর্তমান সরকার জাতীয় দিবসগুলো যথাযোগ্য মর্যাদা ও গুরুত্বের সঙ্গে পালনের জন্য যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন এবং এ বিষয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কড়াকড়ি আরোপ করেছেন যা আমাদের আগামী প্রজন্মের কাছে দেশের ঐতিহ্য, ইতিহাস জানা এবং তাদের মাঝে দেশাত্মবোধ তৈরিতে অবদান রাখবে। সমাজবিজ্ঞানীরাও আমাদের শিশুদের বেড়ে ওঠা নিয়ে শঙ্কিত। তাদের মনোজগতে উন্মুক্ত আগ্রাসী আকাশ সংস্কৃতির বিভিন্ন ধরনের কুপ্রভাব এবং বদভ্যাসের বিরূপ প্রভাব পড়ছে বলে তাদের ধারণা। পাশাপাশি তাদের মধ্যে সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন আলগা হয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা। তারা শুধু নিজেদের ভুবনে বিচরণ করতে করতে নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্য ভুলে যেতে পারে। নিঃসঙ্গতা এবং একাকিত্ব তাদের পরিবার থেকে দূরে ঠেলে দিতে পারে যা নেশা বা মাদকাসক্তির দিকে আকর্ষিত করতে পারে। তাই অনেকের পরামর্শ হচ্ছে ছুটির দিনে পরিবার-পরিজন নিয়ে বাইরে ঘুরতে যাওয়া। লম্বা ছুটিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেশের ঐতিহ্য, পুরাকীর্তি, জাদুঘর, প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন, স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনারসহ বিভিন্ন প্রসিদ্ধ জায়গা এবং স্থাপনা দেখে আসা। সমুদ্র সৈকত, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, ময়নামতি, সিলেট, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন প্রসিদ্ধ জায়গাগুলো পরিদর্শন এবং এসব বিষয়ে তাদের জানানো এবং বুঝানো। আসুন শিশুদের ফার্মের মুরগির মতো ঘরে বন্দি করে না রেখে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, দেশজ ও লোকজ কৃষ্টি, সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয়ের পাশাপাশি দেশের অমর ভাষাশহীদ, মুক্তিযুদ্ধ, শহীদদের আত্মত্যাগ, মুক্তিযোদ্ধা এবং মা-বোনদের অবদানের শৌর্য-বীর্যের কথা তাদের অন্তরে প্রোথিত করার পথ উন্মুক্ত করে দিই।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close