এস এম মুকুল

  ১৬ জুন, ২০১৯

রম্যরচনা

বালিশ ছাড়া কি চলে

আমাদের বাঙালি জাতীয় জীবনে এমনিতেই নিত্যদিন হাসির ঘটনার অভাব নেই। তার ওপর রূপপুরের বালিশ কাহিনিতে হাসতে হাসতে পেটেখিল ধরার অবস্থা হয়েছে। অবশ্য এর আগে ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বন কর্মকর্তা আবদুল গণির বাসার বালিশ খুঁড়ে কাড়ি কাড়ি টাকা উদ্ধারে তাজ্জব বনে গিয়েছিলেন যৌথবাহিনীর সদস্যরা। দেশবাসী হয়েছিল হতভম্ব। এবার রূপপুরে বালিশ কাহিনি যেন রূপকথাকেও হার মানিয়ে দিল। দুর্নীতির টাকার অন্যতম ‘বৈধ খাত’ হিসেবে আবিষ্কৃত হলো রূপপুরের বালিশ কাহিনি। যদিও এই বালিশ তোলার বিল আটকে দেওয়া হয়েছে। তবে দায়ীদের কী শাস্তি দেওয়া হয় সেটাই এখন দেখার বিষয়। আমার মতে, এই বালিশ তোলার বিল বড় কথা নয়। তার চেয়েও বড় দুর্নীতি সঙ্ঘঠিত হয়েছে কিনা সে বিষয়ে তদন্ত করা দরকার। আর তার আগে প্রমাণ সাপেক্ষে অভিযুক্তদের চাকরিচ্যুত করার পাশাপাশি দুর্নীতির হিস্যায় টাকা আদায় করা বা তার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা উচিত। তা না হলে এভাবে ছাড় দিতে দিতে এই বালিশ কাহিনির আড়ালে আরো অনেক কাহিনিই ডানা মেলবে।

বালিশ ছাড়া কি একদিনও চলে? নাহ চলে না। বালিশ ছাড়া আমরা ঘুমাতে অভ্যস্ত নয়। এতদিন জানতাম বালিশ কেবলই ঘুমানোর বস্তু। এখন দেখছি বালিশের আরো অনেক মাহাত্ম্য আছে। অতি সম্প্রতি দেশজুড়ে চলছে বালিশের দাম নিয়ে নালিশ। দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্রিনসিটি প্রকল্পের ১৯টি ভবনের মধ্যে সম্পন্ন হওয়া দুটি ভবনের ১১০টি ফ্ল্যাটের আসবাবপত্রসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনা এবং সেগুলো ভবনে উঠানোর কাজে অস্বাভাবিক ব্যয় নিয়ে দেশজুড়ে চলছে রসিকতা। মাথার নিচের বালিশ এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’র জায়গা দখল করে নিয়েছে। খবরে প্রকাশ প্রতিটি বালিশ তুলতে খরচ পড়েছে ৭৬০ টাকা! বালিশসহ অন্যান্য জিনিসপত্র কেনাসংক্রান্ত দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে বিশেষ একটা তদন্ত কমিটিও নাকি গঠিত হয়েছে। তদন্ত কমিটি নিয়ে ভালো কোনো মন্তব্য করতে পারব নাÑ শুধু বলব তদন্ত কমিটির তদন্ত কে করবেন! ভাবতে অবাক লাগে হাস্যকর এমন দুর্নীতির দৃষ্টান্ত স্থাপনের পরও সেই কর্মকর্তারা আরামে মাথার নিচে বালিশ দিয়ে ঘুমাচ্ছেন! হিসাবে স্বাক্ষর করা পুত-পবিত্র কর্মকর্তারা যখন স্বীকার করে নিয়েছেন বেহিসাবি মালামালের কথা, সেখানেও চলে কমিটি কমিটি খেলা। জানা গেছে, বালিশ উঠানোর খরচ শুনে হাসাহাসি করেছেন বিচারপতিরা। এমন হাস্যকর মার্কা দুর্নীতির সার্কাস দেখালে বিচারপতিরা হাসবেন না তো কী করবেন? তবে আমজনতা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না যে- আমাদের হাসা, নাকি কাঁদা উচিত।

আহারে আমার এখন নির্মলেন্দু গুণের তোমার বালিশ কবিতার কথা মনে পড়ে গেল। তিনি লিখেছেন-‘... কেননা, আমি নিশ্চিত জানি,/যদি আমি তোমার বালিশে/একবার মাথা রাখতে পারি,/তবে গন্তব্যে পৌঁছার আনন্দে/আমি মৃতের মতো ঘুমাব।/ আর ওটাই হবে তোমার মধ্যে/ আমার বিলীন হবার রাত্রি।’ রূপপুরের বালিশ কাহিনির হোতারা কি তাহলে অদৃশ্যে বিলীন হবেন! কে জানে। তবে এসব বালিশ কাহিনির কথা শুনে দুঃখ লাগে। ভাবতেও লজ্জা লাগে যে, দেশে কৃষক তার ভর্তুকির টাকা পান না, উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পান না সে দেশে একটা বালিশ তুলতে ৭৬০ টাকা লাগে! হিসাব অনুযায়ী এক মণ ধানের মূল্যের চেয়ে একটা বালিশ তোলার খরচ বেশি হয়ে গেল! হায় সেলুকাস বাংলাদেশ।

ঘুমানোর অন্যতম অনুষঙ্গ হলো বালিশ। আর বালিশ যদি আরামদায়ক না হয় তাহলে রাতের ঘুম যে হারাম হবে এটাই স্বাভাবিক। আকার ও তোলার মানভেদে আমাদের দেশে একটি বালিশের দাম ২০০ থেকে সাধারণত হাজার টাকার মধ্যে হয়ে থাকে। তবে নেদারল্যান্ডসের এক ফিজিওথেরাপিস্ট একটি বালিশ তৈরি করেছেন যার দাম ধরা হয়েছে ৫৭ হাজার মার্কিন ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় যার দাম পড়বে ৪৫ লাখ ৫৬ হাজার টাকা! থিস ভ্যান ডার হিস্ট নামের এই ফিজিওথেরাপিস্ট গত ১৫ বছর পরিশ্রম করে এই বালিশটি তৈরি করেছেন। বালিশটি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে জগদ্বিখ্যাত মালবেরী রেশম, মিসরের তুলা, ডাচ মেমরি ফোম, ২৪ ক্যারেট গোল্ড ফেবরিক এবং বালিশটির চেন তৈরিতে ব্যবহার হয়েছে সাড়ে ২২ ক্যারেটের নীল রতœ।

বালিশটি তৈরি করা প্রসঙ্গে থিস ভ্যান বলেন, একজন ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে আমি আমার রোগীদের সবসময় ভালো বালিশ ব্যবহারের পরামর্শ দিই। কিন্তু কার জন্য কোন বালিশটি উপযোগী তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ মানুষের শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভিন্ন ভিন্ন রকমের। অতি সূক্ষ্ম মাপজোকের মাধ্যমে উন্নতমানের রোবোটিক মিলিং যন্ত্র ব্যবহার করে বালিশটি তৈরি করা হয়েছে। সুতরাং এটি যেকোনো মানুষের জন্যই উপযোগী। এছাড়া এটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, চাইলেই আপনি এটি আপনার সুবিধামতো যেকোনো জায়গায় নিয়ে যেতে পারবেন। অবশ্য এর সঙ্গে তুলনা করলে রূপপুরের বালিশের দাম খুব কি বেশি হয়েছে!

তথ্য তালাশে জানা গেছে, ৫০ বছর আগে জাপানিরা মাথার বালিশ হিসেবে ব্যবহার করত এক টুকরো কাঠ। আর বাঙালির জীবনে গল্প-উপন্যাস-সিনেমায় কোলবালিশের রকমারি ব্যবহার দেখে কত যুবক-যুবতির ঘুম হারাম হয়েছে, সে অনেক রসগল্পের ঘটনা। ধনী-গরিব সবার জন্যই বিছানার একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হলো বালিশ। বালিশ জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে কে না পছন্দ করেন। কিন্তু এবার এদের সরিয়ে দিতে পারেন, যদি আপনি একাকী হন। যদি সঙ্গী না থাকে তো সমস্যা নেই। বিছানায় থাকবে ‘বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড বালিশ’। শুধু ঘরে নয়Ñ ভ্রমণকালেও চাই খানিক বিশ্রাম। আর ভ্রমণকালে প্রয়োজন এমন একটি বালিশ যা হবে হালকা, অ্যালার্জি প্রতিরোধক ও আরামদায়ক। সবচেয়ে ভালো আর সেরা হচ্ছে তুলা ও উলের বালিশ। ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে ভালো আর সেরা হচ্ছে তুলার বালিশ। এগুলো নরম ও কোনো অ্যালার্জির ভয় নেই। আবার সিন্থেটিক ফাইবার দিয়ে তৈরি বালিশ ভ্রমণের জন্য খুব ভালো। এগুলো ওয়াটার প্রুফ থাকে বলে ভ্রমণে কোনো অসুবিধায় পড়তে হয় না। সিন্থেটিক বালিশ দামে কম ও টেকে বহুদিন। যাদের অ্যালার্জির সমস্যা আছে, তারা নির্দ্বিধায় এটি ব্যবহার করতে পারেন।

বালিশ সম্পর্কে এবার অন্য রকম তথ্য জানুন, বালিশের বিকল্প হিসেবে ২৩০ বছর ধরে কম্বল ব্যবহার করে আসছিলেন দেশে কারাবন্দিরা। অবশেষে এ-ই প্রথম বন্দিদের ঘুমানোর জন্য দেশের কারাগারগুলোতে তুলার বালিশ সরবরাহ করা হয়েছে। জানা গেছে, ১৭৮৮ সালে ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে প্রথম একটি ‘অপরাধী ওয়ার্ড’ তৈরি করা হয়, যা পরবর্তী সময়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে উন্নীত হয়। কিন্তু সেখানে শুরু থেকেই বন্দিদের ঘুমানোর জন্য কোনো বালিশ দেওয়া হতো না। দেশের সবগুলো কারাগারে এই নীতি অনুসরণ করা হয়। তার বদলে প্রত্যেককে তিনটি করে কম্বল, একটি প্লেট ও একটি গামলা দেওয়া হতো। তিনটি কম্বলের একটি বিছানোর জন্য, আরেকটি ভাঁজ করে বালিশের মতো ব্যবহার করা এবং অন্যটি গায়ে দেওয়ার জন্য। শুধু ডিভিশনপ্রাপ্ত ও হাসপাতালে ভর্তি বন্দিরা বালিশ ও মশারি ব্যবহার করতে পারেন। তবে এখন আর এই অবস্থাটি নেই। কারা কর্তৃপক্ষ বন্দিদের আরামে ঘুম ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা চিন্তা করেই একটি করে বালিশ সরবরাহের কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আইজি প্রিজন্স ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন সংবাদ মাধ্যমকে জানান, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত আরামদায়ক ঘুমের জন্য বালিশ অন্যতম একটি উপাদান। তাই মানবাধিকার রক্ষায় ও বন্দির সুস্বাস্থ্যের কথা ভেবে এ-ই প্রথমবারের মতো বন্দিদের আরামদায়ক তুলার বালিশ প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

আচ্ছা আপনার কী জানা আছে, হোটেলের বিছানা-বালিশ সাদা হয় কেন? লক্ষ্য করে দেখবেন প্রায় সব হোটেলের বিছানার লেপ, চাদর, বালিশ ও তোয়ালে সাদা হয়। জানা গেছে, ১৯৯০-এর দশকে হোটেলের কক্ষে সাদা চাদর, বালিশ ও তোয়ালের ব্যবহার শুরু হয়। একে জনপ্রিয় করে তোলে ওয়েস্টিন ও শেরাটন। দুই হোটেলের ভাইস প্রেসিডেন্ট অব ডিজাইন এরিন হুভার মনে করেন, সাদা বিছানা অতিথিদের মাঝে ভ্রম সৃষ্টি করে। এ দেখে তারা মনে করেন রুমটি মাত্রই পরিষ্কার করে গুছিয়ে রাখা হয়েছে। এতে দর্শনার্থীরা আরামবোধ করেন। আবার সাদা রং মনের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। মনে শুভ্রতা ও পরিচ্ছন্নতার তাড়না আসে। অপরপক্ষে বিজ্ঞান মতে, সাদা রং আলোর প্রতিফলন ঘটায়। এতে রুম আরো উজ্জ্বল দেখায়। অবশ্য অনেকে সাদা রং বিলাসিতার প্রতীক বলে মনে করেন। তাই হোটেল রুমের বিছানায় সাদা চাদর ব্যবহার করা হয়। বা চমৎকার যুক্তি! বালিশ নিয়ে লিখতে গিয়ে মনে পড়ে গেল আমার জন্মস্থান নেত্রকোনার গয়ানাথের বালিশ মিষ্টির কথা। গয়ানাথের প্রতি পিস বালিশ মিষ্টির দাম ১০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত। অবশেষে বলতে চাই, বালিশ মিষ্টি খান। বালিশ নিয়ে, বালিশ জড়িয়ে ঘুমান আর দুর্নীতির বালিশের কথা ভুলে যান।

লেখক : সাংবাদিক ও বিশ্লেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close