বিশ্বজিত রায়

  ১০ মে, ২০১৯

পর্যালোচনা

ফণীর আঘাতে বঙ্গোপতীর

ঘূর্ণিঝড় ফণীর ফণায় নীল উপকূলীয় অঞ্চল। প্রকৃতি সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়টি যতটুকু প্রলংকরী হওয়ার কথা ছিল বাস্তবে ততটা শক্তিশালী না হওয়ায় ভয়ংকর বিপদের মুখ থেকে রক্ষা পেয়েছে বাংলাদেশ। ঘূর্ণিঝড় ফণী নিয়ে যে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল, তা কেটে গেছে। ফণী শুধু ফণাই তুলেছে মাত্র। ভয়ংকর এ দুর্যোগ অসংখ্য প্রাণ কেড়ে না নিলেও সর্বত্র রেখে গেছে ক্ষতচিহ্ন। মহাদুর্যোগের আশঙ্কায় ফণী শেষ পর্যন্ত দুর্বল গতি নিয়ে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকার বোরো ধান ও ফসলের খেতে চালিয়েছে ধ্বংসযজ্ঞ। ফণীর প্রভাবে বৃষ্টি ও ঝড়ো বাতাস ফলমূল-সবজিসহ কৃষিতে মহাসর্বনাশ ডেকে এনেছে। প্রবল বাতাসে মাটির সঙ্গে লেপটে গেছে ধান। অতিবৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে আধাপাকা বোরো ফসল। বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে পুকুর ও ঘের থেকে ভেসে গেছে মাছ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড় ফণীর তান্ডবে প্রায় ৩৬ হাজার ৬০৩ হেক্টর জমির বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় ১৩ হাজার হেক্টর জমির রবিশস্য নষ্ট হয়েছে। কৃষকরা আতঙ্কে প্রায় ৯ লাখ হেক্টর জমির আধাপাকা বোরো ধান কেটেছেন। কৃষকের পাকা ধানের মাঠে যেন মই দিয়েছে ঘূর্ণিঝড় ফণী। ফণীর ছোবলে কৃষকের অবর্ণনীয় ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ অতিক্রম করার পথে ফণী ভোলা, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, পটুয়াখালী ও নোয়াখালীর বিস্তীর্ণ এলাকার হাজার হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত করেছে। ঝড়ে গাছের ডাল ভেঙে, বিধ্বস্ত কাঁচা ঘরে চাপা পড়ে ও পানিতে ডুবে অন্তত ১১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

একদিকে প্রকৃতি সন্তুষ্টির বিকৃত রেশ, অন্যদিকে প্রাণ অস্তিত্ব ও ধ্বংসযজ্ঞের নীরব হাহাকার। শুধু কি তাই। মানুষ যেমন প্রকৃতি তান্ডবে পীড়িত হয়, তেমনি চারপাশের পরিবেশে এক বিদঘুটে চেহারা ফুটে ওঠে। ঘূর্ণিঝড়ে লন্ডভন্ড এলাকার জীবন-জড়তা স্বাভাবিক রূপে ফিরে পাওয়ার সুযোগ পেতে না পেতেই চলে আসে আরেকটি বিকট বৈরিতা। যে ধাক্কা সামলে সামলে ক্লান্ত উপকূলীয় চরাঞ্চল ও দ্বীপাঞ্চলের প্রতিবেশ পরিবেশ মানুষরা। এ থেকে পরিত্রাণ কিংবা মুক্তির উপায় খুঁজে পাওয়া যতটা না কঠিন তার চেয়ে বড় কঠিন মানুষের স্বভাব পাল্টানো। প্রকৃতি তার স্বাভাবিক রীতি অনুসরণ করে মাত্র। কিন্তু মনুষ্যরিপু প্রকৃতিবান্ধব সব আধার ধ্বংস করে প্রকৃতিকে অস্বাভাবিক আচরণের পথে নিয়ে যাওয়াই যেন মানবজাতির প্রধানতম প্রচেষ্টা। এই অশুভ আক্রমণ থেকে মানুষকে ফিরে আসতে হবে।

ভারতীয় দৈনিক দ্য হিন্দু জানিয়েছিল, ১৯৭৬ সালের পর এত শক্তিশালী ঝড়ের মুখোমুখি হয়নি ভারতীয় উপমহাদেশ। ফলে ৪৩ বছরের মধ্যে এটিই সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়। সুপার সাইক্লোন হওয়ার পথে ফণীর তান্ডবে লন্ডভন্ড হতে পারে এ অঞ্চল। ফণীর ভয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছিল ভারতের ওড়িশা, অন্ধ্র প্রদেশ, তামিলনাড়–, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উপকূলের মানুষ। বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, গত ৪৩ বছরের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ফণী। ভারতীয় আবহাওয়া অফিসের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৬৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বঙ্গোপসাগর এবং পার্শ্ববর্তী আরব সাগরে ৪৬টি প্রবল ঘূর্ণিঝড় দেখা গেছে। এর মধ্যে অক্টোবর-নভেম্বরে ২৮টি ঝড়ের সৃষ্টি হয় আর মে মাসে সাতটি। ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এপ্রিল-মে মাসে বঙ্গোপসাগরে যত ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়েছে, তার কোনোটিই এত শক্তিশালী ছিল না। সারা বিশ্বে প্রতি বছর ২০ থেকে ৩০টি ঘূর্ণিঝড় এমন শক্তি সঞ্চয় করে আঘাত হানে। বাংলাদেশের সরকারি তথ্য অনুসারে, ১৯৬০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মোট ৩৩টি বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে বিবেচনা করা হয় ১৯৭০ ও ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়কে। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর সর্বোচ্চ ২২৪ কিলোমিটার বেগে চট্টগ্রামে আঘাত হানা প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ১০-৩৩ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। তাতে পাঁচ লাখ মানুষ নিহত হয়। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলে আঘাত হানে লাখো প্রাণঘাতী এক ঘূর্ণিঝড়। এই ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস কেড়ে নেয় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষের জীবন। এ ছাড়া প্রায় এক কোটি মানুষ নিঃস্ব হয়।

প্রাণহানি ও ভয়াবহতার দিক থেকে পৃথিবীর ঘূর্ণিঝড়ের ইতিহাসে ষষ্ঠস্থান দখল করে আছে বাকেরগঞ্জ ঘূর্ণিঝড়। ১৮৭৬ সালের ৩১ অক্টোবর বাকেরগঞ্জের উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এই ঘূর্ণিঝড় ‘দ্য গ্রেট বাকেরগঞ্জ ১৮৭৬’ নামেও পরিচিত। ঘূর্ণিঝড়ে বাকেরগঞ্জের নিম্নাঞ্চল সম্পূর্ণ প্লাবিত হয়। ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ২ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়ালতম প্রাকৃতিক ধ্বংসলীলা ঘটে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর। এদিন সিডর নামের ঘূর্ণিঝড়টি দেশের উপকূলীয় ও দক্ষিণাঞ্চলের ৩০টি জেলায় আঘাত হানে। বেসরকারি মতে, প্রায় ২০ লাখ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়। সরকারিভাবে ৩ হাজার ১৯৯ জনের মৃত্যু ও ১ হাজার ৭২৬ জনের নিখোঁজ হওয়ার কথা জানানো হয়। ২০০৯ সালের ২৫ মে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাংশে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আইলা। এতে প্রাণ হারান ১৮ জন। ২০১৩ সালের মে মাসের শুরুর দিকে বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণাংশে সৃষ্টি হয় মহাসেনের। ২০১৭ সালের ৩০ মে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় মোরার আঘাতে ৫৪ হাজার ৪৮৯টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মারা যান ৮ জন। আরেকটু পেছনে গেলে দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৯৬০ সালের ৩১ অক্টোবরের প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ৫ লাখ ১৪৯ জন নিহত হয়। ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রামে ১ অক্টোবর ২০-২২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের প্রবল ঘূর্ণিঝড় হয়। ১৯৮৫ সালের ঘূর্ণিঝড় উরিরচরের ঘূর্ণিঝড় নামে পরিচিত।

১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে যে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে সেটি ছিল ভয়ংকরতম প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি। ওই ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ৫ লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। এরপর ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়েও ১ লাখ ৩৮ হাজারের মতো প্রাণহানি ঘটেছিল। সেই আমলে আগেভাগে ঘূর্ণিঝড় আসার খবর যেমন মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়নি; তেমনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও উপকূল থেকে মানুষজনকে সরিয়ে আনার কার্যক্রমও তেমন জোরদার ছিল না। সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ে ৫ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ হয়েছিল গোটা পূর্ববাংলা। তখন আধুনিক প্রযুক্তিহীন আবহাওয়া অধিদফতরের সীমাবদ্ধতা আর বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর আবহাওয়া অধিদফতরের পরিবর্তন সত্যিই প্রশংসনীয়। ব্যাপক হারে ক্ষতিগ্রস্ত জানমালের সে সময়টা আর বর্তমান সময়ের তুলনা করলে ক্ষতির পরিমাণ হবে কয়েকগুণ বেশি। পূর্বঘোষিত ফণীর প্রাণবিধ্বংসী ধ্বংসলীলা থেকে বাঁচাতে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। যদি আবহাওয়া অধিদফতরের পূর্বঘোষণা অর্থাৎ সতর্ক সক্ষমতা না থাকত তা হলে রেকর্ড মৃত্যুর অসহনীয় অবস্থায় পতিত হতো বাংলাদেশ। আবহাওয়া অধিদফতরের সেই সক্ষমতা দেশের মানুষকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনছে বারবার। কখনো রুয়ানো, কখনো সিডর, কখনো ফণীর মতো শক্তিশালী প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ প্রশংসার দাবি রাখে। তবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশকে এ ব্যাপারে আরো যতœবান হতে হবে। যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থাকে দুর্যোগ প্রশমিত বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

প্রকৃতি নিষ্ঠুর নিয়তির কাছে পৃথিবীর কোনো জায়গাই নিরাপদ নয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম হতে পারে না। প্রকৃতিভেদে দেশের প্রতিটি স্থানেই কমবেশি দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয় সাধারণ মানুষকে। তবে অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবন অনেকটা বেশি অনিরাপদ। সর্বদাই প্রকৃতির নির্দয় আক্রমণের কাছে মাথা নত করতে হয় তাদের। সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসাই যাদের শেষ পরিণতি। ভাগ্যবিড়ম্বিত এ মানুষরা প্রকৃতির নির্মমতার কাছে কতটা অসহায়, তা গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশিত সংবাদে পরিষ্কার প্রতীয়মান। ফণী পরবর্তী সংবাদপত্রে স্থান পাওয়া খবরে মানুষের দুর্ভোগ-দুর্দশার চিত্র ভাবিয়ে তুলেছে পরিবেশ সচেতন মানুষকে। সমুদ্রতীরবর্তী এ অঞ্চলগুলো যেহেতু বেশি আবহাওয়া বিঘিœত; সেহেতু বিশেষ ব্যবস্থার আওতায় রেখে এ এলাকার ভুক্তভোগী জনসাধারণকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close