ডা. এস এ মালেক

  ০৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

মতামত

বিভ্রান্তি বাঞ্ছনীয় নয়

জাতীয় জীবনে সংকটকাল দেখা দিলেই বিভিন্ন মহল থেকে জাতীয় ঐক্যর কথা বলা হয়। সরকার ও বিরোধী দল বা দল নিরপেক্ষ সুশীলসমাজ ওই ধরনের ঐক্যের আহ্বান জানান। সরকারি দল থেকেও ঐক্যের আহ্বান জানানো হয়। একটা গণতান্ত্রিক দেশে সবাই মিলে দেশ গঠন প্রক্রিয়ায় অবদান রাখার প্রয়োজন রয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন একটা গণতান্ত্রিক নির্বাচন দিয়ে সংসদ ও গঠন করার পরও দেশকে সঠিক পথে এগিয়ে নিতে পারছিলেন না; তখনই বৃহত্তর ঐক্যের প্রয়োজনে বাকশাল গঠন করেন। অনেকে এটাকে স্বৈরাচারী বলে থাকেন। আসলে তিনি চেয়েছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে সবার প্রচেষ্টায় গড়ে তুলতে। জাতীয় ক্রান্তিকালের ওই সঠিক সিদ্ধান্তের কারণে আজও বঙ্গবন্ধুকে গণতন্ত্রের হত্যাকারী বলে অভিহিত করা হয়। তারই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাও ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় বিরোধী দলের সঙ্গে ঐক্য না হলেও সমঝোতার শুধু আহ্বানই জানাননি, প্রক্রিয়াও শুরু করেছিলেন। কিন্তু বিরোধী দল তাতে সাড়া দেয়নি। এবার ২০১৮ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েও তিনি দেশে বিদ্যমান সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বর্তমান জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিরোধী দল মূলত গণফোরাম ও বিএনপি এই আমন্ত্রণে সাড়া দেয়নি। সৌজন্যমূলক চা-চক্রে গণভবনে যায়নি। আসলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা শুধু সরকারপ্রধান নন, তিনি জাতির পিতার কন্যা, স্বাধীনতার পক্ষের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অবিসংবাদিত নেতা। বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশ কিছুটা ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। মূল বিরোধী দল বিএনপি মাত্র আটটি সিট পেয়েছে। তাতে করে সংসদীয় গণতন্ত্রকে কার্যকর করতে যে বিঘেœর সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরসনকল্পে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলের সংসদ সংসদদের সংসদে যোগদান ও সংসদীয় গণতন্ত্রে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। সংখ্যায় কম হলেও সংসদীয় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সরকার তাদের সহযোগিতা করবে। তা ছাড়া সংসদের বাইরেও আন্দোলনের প্রকৃতি যাতে সহিংসতামূলক না হয়, একটা সহনীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সংসদীয় ব্যবস্থা গতিশীল করার প্রয়াস চালানো যায়। সে জন্য প্রধানমন্ত্রী সবার সহযোগিতা চান। ঐক্যফ্রন্ট ছাড়া প্রায় ৭০ দল যোগদান করেছে, সলাপরামর্শ হয়েছে এবং রাজনীতির ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।

বিরোধী দল কেন কমসংখ্যক আসন পেল, নির্বাচনে তাদের শোচনীয় পরাজয় সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী তার নিজস্ব মতামত প্রদান করেছেন। তার কথাবার্তায় মনে হয়, তিনি আশা করেছিলেন, এবারের নির্বাচনে বিরোধী দল প্রয়োজনীয় আসন পাবে এবং সংসদীয় গণতন্ত্র আরো কার্যকরভাবে তার ধারা অব্যাহত থাকবে। এই কমসংখ্যক সিট পাওয়ায় তিনি বেশ কিছুটা উদ্বিগ্ন বলেই মনে হয়েছে। সেই কারণেই তিনি বিরোধী দলকে আশ্বাস দিয়েছেন, বিরোধী দল সংসদে এলে তাদের কথা বলার সুযোগ দেবেন। আসলে সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকার ও বিরোধী দলের ভেতর সমঝোতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন বলেই তিনি বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী।

নির্বাচন সম্পর্কে বিরোধী দল থেকে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছেÑ নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়নি, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, বিরোধী দলকে নির্বাচনে সমান সুযোগ দেওয়া হয়নি, প্রশাসন একতরফা সরকারের পক্ষে কাজ করেছে আরো কত কী, অভিযোগের যেন শেষ নেই। এসব পুরনো অভিযোগ নির্বাচন-পূর্ব থেকে শুরু হয়েছিল। নির্বাচনকালে কী যে ঘটেছে, তা তো দেশের বাইরের ও ভেতরের পর্যবেক্ষকরা অবলোকন করেছেন। নির্বাচন যে ১০০ ভাগ অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে, এরূপ দাবি তো সরকারি দলও করেনি। আর বিরোধী দল থেকে বলা হচ্ছে, এ নির্বাচন তামাশা ছাড়া কিছু না। তারা তাদের বক্তব্যের সপক্ষে প্রয়োজনীয় যুক্তিতর্ক দিয়েছে, তা প্রমাণ করার চেষ্টাও করেননি। শুধু সরকারকে ঘায়েল করার জন্য ঠিক টেপরেকর্ডের মতো সমস্বরে সবাই বলে চলেছেন। কে না জানে হাজার হাজার ভোটার লাইনে দাঁড়িয়ে ৮-১২টার মধ্যে ৩৫ শতাংশ ভোট দিয়েছেন। রাজনৈতিক দল হিসেবে শুধু আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক ৩৫ শতাংশের কম হবে না আর তার সঙ্গে তরুণ দেড় কোটি ও নারী ভোট যোগ দিলে ভোটের সংখ্যা দাঁড়াবে শতকরা ৫৫-৬০ ভাগ। এটাই প্রমাণ করে আওয়ামী লীগের বিজয় সুনিশ্চিত ছিল। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কারচুপি করা হয়েছে বলে যে দাবি করা হচ্ছে, বিরোধী দল থেকে তা কতটা যৌক্তিক, তা একমাত্র প্রমাণসাপেক্ষে বলা যেত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দু-একটা অভিযোগ করা হলেও তার প্রমাণের জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে জোর দাবি করেননি। দুপুর ১২টা পর থেকে নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয় বুঝতে পেরেই শুধু নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার যত কূটকৌশল আছে, আজ পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু নির্বাচনে কারচুপির কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেননি। এখন তারা নির্বাচনের ফলকে প্রত্যাখ্যান করেছেন ও পুনরায় নির্বাচন চান। তাদের দাবি দুটি সংাবিধানিকভাবে অবৈধ। তাই সংসদে যোগ না দিয়ে আগের মতো রাজপথে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা দলটি শুরু করে এর কুফল সমগ্র জাতিকে ভোগ করতে হবে।

শেখ হাসিনা এবার ক্ষমতায় এসেছেন সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে, যা তাদের ইশতেহারে রয়েছে। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তিনি ওয়াদা পূরণের কাজ শুরু করেছেন। তাই আগের মতো সহিংসতা করলে, উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হলে, প্রশাসনিকভাবে কঠোরভাবে দমন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী আশা করেন দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থবিরোধী দল ওই ধরনের নেতিবাচক কর্মসূচি না দেয়। দেশের মানুষ ভালো করেই জানে, বিএনপির যে করুণ অবস্থা, তাতে আন্দোলন করে সরকার পতনের কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে সহিংস আন্দোলন হলে জনগণের যে দুর্গতি হয় ও উন্নয়ন ব্যাহত হয়, সেদিকে বিচক্ষণ শেখ হাসিনা যেতে দিতে পারেন না। তাই সরকার গঠনের পরপরই তিনি আলোচনার দ্বার খুলে দিয়েছেন। যদি কোনো কারণে ঐক্যফ্রন্টের এমপি শপথ না নেন, তাহলে সাংবিধানিক ধারায় ৯০ দিনের পর আসন শূন্য হবে ও নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে নতুন এমপি শপথ নেবেন। এটা কি বিএনপির জন্য মঙ্গলজনক হবে। একদিকে সংসদে না গিয়ে ভোটাররা তাদের প্রতি যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তাদের প্রতি অবজ্ঞা হবে, অন্যদিকে রাজপথে আন্দোলনের হুমকি বিএনপিকে সংকটময় করে তুলবে। প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাশা, আজও প্রতিহিংসায় বশবর্তী হয়ে সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত দল হিসেবে বিএনপিকে গভীর সংকটে ফেলতে পারে। গণতন্ত্র কার্যকর করার জন্য শক্তিশালী বিরোধী দল প্রয়োজন। তাই বিএনপির ক্রমাগত অবক্ষয় গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গলজনক নয়।

আরেকটি কথা বলা বিশেষ প্রয়োজন, বাংলাদেশের রাজনীতির ধারাবাহিকতা যদি মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর ও বাস্তবতা এবং বর্তমান অবস্থার বিবেচনায় নেওয়া হয়, তাহলে এখানে আদর্শভিত্তিক যে বাস্তবতা বিদ্যমান আছে, সেখানে স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের পক্ষে জামায়াত জোটের সঙ্গে ঐক্যের আহ্বান যদি কেউ চিন্তা করে থাকেন, তা নিতান্তই যুক্তিহীন। বিরোধী দলের রাজনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিবেচনায় নিলে স্বাধীনতার পক্ষের বৃহত্তর দল ও শেখ হাসিনার পক্ষে ঐক্য বলতে যা বোঝায়, তার সম্ভাবনাও বিরাজমান নেই। শুধু বর্তমান কেন, আগামীতেও নয়। যত দিন বিএনপি, স্বাধীনতার শত্রু জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন না করে। বিএনপিতে মুক্তিযোদ্ধা আছেন ঠিকই, তারা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির সঙ্গে সমঝোতা বা ঐক্য হতে পারে না। যারা এ ধরনের ঐক্যের আহ্বান জানান, তাদের মূল লক্ষ্য পরিস্থিতি আরো জটিল করা। ব্যাপকভাবে বিজয়ী শেখ হাসিনা দেশ ও জাতিকে যেভাবে উন্নত করতে চান, সেই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার জন্য অনেকে ঐক্যের নামে গভীর ষড়যন্ত্র করছেন কি না, তা ভেবে দেখা দরকার। রাজনৈতিক ঐক্য বলতে যা বোঝায়, সমমনাদের ঐক্য। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি সংগ্রামে, প্রগতিশীল, বাম গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে সমঝোতা করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই সমঝোতা প্রক্রিয়া সমুন্নত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পরও তিনি একই প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছিলেন। দ্বিতীয়-বিপ্লবের কর্মসূচির সময়ও ঐক্য প্রক্রিয়ায় ফাটল ধরেনি। তবে তিনি আদর্শহীন বিরোধীদের সঙ্গে ঐক্য কেন, সমঝোতাও করেননি। আজকের বাস্তবতা আগের যেকোনো সময়ের চেয়েও খারাপ। সন্ত্রাসী, জঙ্গিবাদী ও স্বাধীনতাবিরোধীরা যে ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছেন, তা রাষ্ট্র ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি ভয়ংকর হুমকিস্বরূপ। তথাকথিত গণতান্ত্রিক দল বিএনপি যারা আজ উচ্চকণ্ঠে গণতন্ত্রের সপক্ষে অবস্থান নিয়েছে ও ক্ষমতাসীন দলকে স্বৈরাচারী বলে অভিহিত করেছে, তারা মূলত স্বাধীনতার শত্রুদের ইন্ধন দিয়ে তারা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ধ্বংসের কাজে লিপ্ত রয়েছে কি না, এখন এটাই বড় প্রশ্ন। স্বাধীনতার নেতৃত্বকারী দল আওয়ামী লীগের তাই বিএনপির সঙ্গে ঐক্য প্রক্রিয়া তো নয়ই, সমঝোতায় যেতে পারে না। আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা মানে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা এবং এসব মূল্যবোধ, যা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে, যারা এসবে বিশ্বাস করে না, তাদের সঙ্গে কীসের ঐক্য। ঐক্য ও সমঝোতায় পৌঁছাতে হলে বিএনপিকে জামায়াত পরিহার করে একটা স্বচ্ছ অবস্থান নিতে হবে। প্রমাণ করতে হবে তারাও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি।

লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close