জয়া ফারহানা

  ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

মতামত

ভাষানীতি প্রতিষ্ঠা জরুরি

বাংলার প্রতি এ অঞ্চলের মানুষের ঝোঁক দেখা যায় উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে। অবশ্য তখনো উচ্চস্তরে বা উচ্চমহলে বাংলা ভাষা আদৃত নয়। অভিজাতের ভাষা হিসেবে আরবি-ফার্সি-উর্দু এবং সংস্কৃতের সমাদর। বলা যায়, বাংলা তখনো কেবল অন্ত্যজ অথবা মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভাষা হতে যাচ্ছে মাত্র। যদিও তার আগে বাংলা ভাষাকে পাড়ি দিয়ে আসতে হয়েছে বিস্তর বিপৎসংকুল পথ। কয়েক শতাব্দী ধরে এ অঞ্চলে বাংলা ভাষার বিবর্তন হয়েছে। পৃথিবীর বহু দেশের বহু ভাষার সমন্বয়ে বাংলা ভাষা ঋদ্ধ হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাংলা ভাষিক গোষ্ঠীর পরিচয় সংকট কাটেনি। প্রচার করা হয়েছে বাংলা হিন্দুর ভাষা। সংস্কৃত শব্দে ভরপুর এ ভাষা কখনো মুসলমানের হতে পারে না। কিন্তু বাংলা ভাষা সুলতানি আমল থেকে অথবা তারও আগে যখন আরব বণিক এ অঞ্চলে এসেছিলেন এবং আরবি-ফার্সি-উর্দুর সমন্বয়বাদিতার মাধ্যমে যেভাবে বাংলা ভাষা গঠন হয়েছে তাতে বাংলা ভাষাকে কিছুতেই কেবল ফোর্ট উইলিয়াম কেন্দ্রিক একটি সংস্কৃত ঘেঁষা একক ভাষা দাবি করা যাবে না।

এ দেশে মুসলিম দরবেশ বা সুফিরা এসেছিলেন সপ্তদশ শতাব্দীতে। চট্টগ্রাম এবং তার কাছাকাছি এলাকায় এরা এসেছিলেন প্রধানত বাণিজ্যের তাগিদে। ব্যবসার সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। অতএব তাদের যেমন বাংলা শিখতে হয়েছে, তেমনি ব্যবহারিক প্রয়োজনের তাগিদেই আরবি-ফার্সি-উর্দু ভাষার বিস্তর শব্দ বাংলায় ঢুকে গেছে। এতে বাংলার ক্ষতি হয়েছে, তা নয়। ভাষার সঙ্গে খোঁজখবর রাখেন এমন ব্যক্তিমাত্রই জানেন, নিজের ভাষার শব্দ খারিজ না করে অন্য ভাষার শব্দ রপ্ত করলে ভাষার স্বাস্থ্য উজ্জ্বল হয়। বাণিজ্য ছাড়াও যারা ইসলাম প্রচারে এসেছিলেন তাদের মারফতও বাংলা ভাষার বহুমাত্রিক পরিবর্তন পরিমার্জন ঘটেছে। বাণিজ্য বা ইসলাম প্রচার যেটাই হোক বাংলা ভাষার স্বাস্থ্য বৃদ্ধিতে আরবি-ফার্সি-উর্দুর বিস্তর মিশ্রণ বাংলার জন্য সুখকর অভিজ্ঞতা। দুখকর অভিজ্ঞতা হলো, যেসব ভিনদেশি বণিক বাংলা অঞ্চলে বাণিজ্য করতে এসেছেন অথবা যারা বিভিন্ন সময়ে বাংলা মুল্লুকের শাসনকাজ চালিয়েছেন তারা বাংলাকে বাণিজ্যের ভাষা হিসেবেই নিয়েছেন কেবল। বাংলা ভাষার প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি খুব প্রসন্ন ছিল না। বিস্তর অভিযোগ রয়েছে, গুপ্ত-পাল-সেন রাজত্বের সম্পর্কে। উনারাও প্রত্যেকে ধর্মচর্চা ও রাজকাজ পরিচালনার জন্য সংস্কৃত ভাষাকে সভ্যতার ভাষা বিবেচনা করেছেন। মুঘল পাঠান শাসন আমল যেমন রাজভাষা হিসেবে চালু ছিল ফার্সি। সম্রাট আকবরকে যে আমরা বাংলা সন চালুর জন্য ভূয়সী প্রশংসা করি, তিনিও কিন্তু আবুল ফজল বা অন্যান্য মারফত বাংলা সন চালুর কাজটি শুরু করেছিলেন কেবল কর আদায়ের জন্য। এ অঞ্চলের দরিদ্র প্রজা সাধারণ বাংলা ভিন্ন অন্য ভাষা বুঝত না। টাকা আদায়ের প্রয়োজনে অভিজাতরা বাংলাকে যোগাযোগের ভাষা হিসেবে চালু করেছিলেন।

পাল, সেন, গুপ্ত, মুঘল, পাঠান, শক, হুন অথবা ওলন্দাজ, পর্তুগিজ, ইংরেজ, পাকিস্তানি কেউই বাংলাকে যোগ্য বা অভিজাতের ভাষা হিসেবে বিবেচনা করেনি। বাংলা চর্চা হয়েছে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের রেওয়াজে। তাদের চর্চায়, তাদের মুখের বুলিতে। বাংলা চাষাভুষাদের ভাষা, বাংলায় কাব্য চর্চা করা যায় না, বাংলায় লেখা গজল শ্রুতিমধুর হয় না, কর্ণকূহরে আরামপ্রদ নয়... বাংলার বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। কাজী নজরুল বাংলা ভাষায় ‘রুবাইয়াত’ লিখে প্রমাণ করেছেন, বাংলায়ও ফার্সির মতো প্রথম শ্রেণির গজল লেখা সম্ভব। রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষার ভেতরের সর্বোচ্চ শক্তিকে টেনে বের করেছেন। তার হাতে প্রমাণ হয়েছে, বাংলা ভাষায় শুধু প্রথম শ্রেণির সাহিত্য রচনাই সম্ভব নয়, বাংলা ধ্বনির রয়েছে এমন এক শক্তি, যা অন্য অনেক ভাষার নেই। ‘বাংলা ভাষায় এমন অনেক শব্দ রয়েছে, যা খালি উচ্চারণবিশিষ্ট নয়। এর অন্য অনেক মাত্রা আছে। এ অন্য মাত্রা বাংলার ভাষার বিশেষ বিশেষত্ব। কচ কচাৎ, কচকচ, কচাকচ, কচরকচর, কট কটাৎ, কটাস, কটকট, কটাকট, কটমট, কটরমটর, কড়কড়, কড়াৎ, কড়মড়, কিলকিল, কিলবিল, কুচ কুচ, কুটকুট, কুলকুল, কুরকুর, কুইকুই, কেউমেউ, ক্যাক্যা, কুচকুচে, কুটকুটে, ক্যাটকেটে... এ রকম বিস্তর শব্দ আছে বাংলা ভাষায়। যা শব্দ হয়ে ওঠার আগেই ধ্বনি হয়ে আমাদের কানে বাজে। যে বর্ণনা অর্থবদ্ধ শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা দুঃসাধ্য সেসব ধনাত্মক শব্দ ধ্বনিময়তার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে সক্ষম। বাংলা এমন-ই এক ভাষা যেখানে শব্দ শুধু ছবিকেই জাগিয়ে তোলে না, ভাবকেও জাগায়। কনকনে শীত, ফিনফিনে হাওয়া, ফুরফুরে মন এসব বললে খালি ছবি, ভাব, উপলব্ধি, বক্তব্য বা কথা প্রকাশ হয় না, শব্দের মাধ্যমে অনুভূতিকেও ধরা যায়। বাংলা ভাষার অনির্বচনীয়তা : ফরহাদ মজহার ]। যারা বাংলা ব্যবহার করতে চান না, তারা বাংলা ভাষার অর্থ প্রকাশের সীমাবদ্ধতা পরিভাষাগত নৈরাজ্য, ব্যাকরণগত জটিলতাসহ নানা অজুহাত টানেন। এসব অজুহাত দিয়ে উচ্চতর বিজ্ঞান চিকিৎসা, বিজ্ঞান প্রকৌশল অথবা আইন আদালতে বইগুলো বাংলায়

লেখা হয়নি। কিন্তু বাংলা ভাষার শক্তি অসীম এবং একটু চেষ্টা করলে বিদেশি শব্দ পরিবর্তিত আকারে বাংলায় এনে অথবা বাংলায় প্রতিশব্দ বের করে উচ্চশিক্ষার

সবস্তরে বাংলা ভাষা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। বাংলা ভাষার প্রতি বর্ণীকরণ, আরবি-ফার্সি শব্দের বাংলা বানান, বিকল্প বাংলা বানান, যুক্তাক্ষর বিষয়ক যেসব ছোটখাটো

সমস্যা আছে, তা দূর করা এমন কোনো কঠিন কাজ নয়। শক, হুন, মুঘল, পাঠান, গুপ্ত, সেন, পাল উচ্চবর্ণের হিন্দু বা পাকিস্তানি এখন নেই কিন্তু তাদের আত্মা ভর করা বাংলা বিদ্বেষী বাঙালিরা যদি বাংলার শত্রু হয়ে দাঁড়ায়, তবে বাংলা ভাষার দুর্দশা ঘোচানোর দায় আর কাকে দেব? স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা অনেক নীতি কাঠামো পেয়েছি, কিন্তু ভাষানীতি পাইনি। ধারণা করি, অন্যকে আঘাত করে কথা বলা আমাদের ভাষানীতি। তো এই ভাষানীতিতে ভাষার ব্যক্তিত্ববোধ প্রতিষ্ঠার আগে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠা জরুরি। ব্যক্তি বা নাগরিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা না হলে ভাষার মর্যাদাও প্রতিষ্ঠা হয় না। যদি তা ভিনদেশি শাসক না হয় তবু।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close