কবির মোল্লা

  ২৬ জানুয়ারি, ২০১৯

মতামত

দুর্নীতিরোধে জনসচেতনতা

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শাসনামলের টানা তৃতীয় দফা শুরু হয়েছে বলতে গেলে এ বছর শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি। এর আগের দুই দফায় দলটির উল্লেখযোগ্য অর্জন হলো, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে আমাদের এ বাংলাদেশকে উচ্চ আসনে নিয়ে যাওয়া। এর মধ্যে অন্যতম হলো, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের পথে কার্যকরীভাবে অনেকদূর অগ্রসর হওয়া। জীবনমানের উন্নয়নের সূচকে জাতিসংঘ ঘোষিত সূচকের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে দেশকে রোল মডেল রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থায়ী করা। জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা। এগুলোর কোনোটি এখনো দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জীবনে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। তবে প্রত্যেক নাগরিকের জীবনে যে এর নিশ্চয়তা বিধান করা সম্ভব, তা জনগণের আস্থায় আনা সম্ভব হয়েছে। যেভাবে দেশ অগ্রসর হচ্ছে, তাতে ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে এসব টার্গেট পূরণ আর কোনো কঠিন সমস্যা নয়। গত দুই দফায় নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ সাফল্যের সঙ্গে আরেকটি যে কাজ করেছে তা হলো স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচারের আওতায় এনে সাজার রায় কার্যকর করেছে। আর এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়নের ধারাবাহিকতা টেকসই করতে দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান ঘোষণা করেছেন। নতুন মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেও তিনি মন্ত্রীদের সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সব মন্ত্রী মনিটরিংয়ে থাকবেন। কাজেই দুর্নীতিবিরোধী যে অবস্থান প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, তাকে আমি স্বাগত জানানই। আসলে জাতীয় জীবনে যেকোনো অগ্রগতি অর্জনের জন্য কোথাও না কোথাও থেকে শুরু করতে হয়। সৌভাগ্যের ব্যাপার হলো, দুর্নীতিবিরোধী এবারের অভিযান শুরু হয়েছে রাষ্ট্রের একেবারে সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে। রাষ্ট্রের শীর্ষ কর্তাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর সতর্কবার্তাকে রাষ্ট্রের সবস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও জনগণের অনুসরণ করা উচিত। তাহলেই পুরো দেশ একধারায় এগিয়ে যাবে। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুধু রাষ্ট্রীয় সরকারি পর্যায়ে নয়, বেসরকারি পর্যায়েও কঠিনভাবে অনুসরণ করা উচিত। প্রধানমন্ত্রী যে এ দেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত করতে চান, তা তিনি বেশ জোরালোভাবেই বারবার তুলে ধরেছেন। জনগণের প্রতি মমতার প্রমাণ তো বঙ্গবন্ধু প্রাণ দিয়েই শোধ করে দিয়েছেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এবারের বিজয়ে জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন এবং এ বিষয়ে তার মতামত তুলে ধরেছেন।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্পন্ন হয়েছে বিজয় সমাবেশ। অনুষ্ঠানের শুরুতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মরণ করেন স্বাধীনতা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দালন, জাতির পিতাসহ ১৫ আগস্টের সব শহীদ এবং জাতীয় চার নেতাকে। তিনি পুনর্বার অঙ্গীকার করেন, বাংলাদেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত করার। তিনি বলেন, যে প্রতিশ্রুতি তিনি জনগণকে দিয়েছেন, তা পূরণ করবেন। তিনি আরো বলেন, বিজয় পাওয়া যত কঠিন, সেটা রক্ষা করা আরো বেশি কঠিন। জনগণ শান্তির পক্ষে ও উন্নয়নের পক্ষে রায় দেওয়ায় দেশবাসীকে কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের মানুষ যে বিশ্বাস রেখেছে, তার মর্যাদা জীবন দিয়ে হলেও তিনি রক্ষা করবেন। মা-বোনসহ নারী ও তরুণ প্রজন্ম যারা প্রথমবারের মতো ভোট দিয়েছেন, কৃষক-শ্রমিক-কামার-কুমার-তাঁতি, শিক্ষক-আইনজীবীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে প্রধানমন্ত্রী ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়ার জন্য। তিনি নির্বাচন কমিশনসহ সব কর্মকর্তাকেও ধন্যবাদ জানান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন, তাদেরকেও ধন্যবাদ জানান।

পঁচাত্তরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ও বিভিন্ন লড়াই-সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। আমি আমার জীবনকে উৎসর্গ করেছি বাংলার ক্ষুধার্ত নিরন্ন মানুষের কল্যাণের জন্য, তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য। স্বজনহারানোর বেদনা নিয়েও প্রতিজ্ঞা করেছি এ দেশকে গড়ে তুলব। বাংলাদেশে একটি মানুষও ক্ষুধার্ত থাকবে না, গৃহহীন থাকবে না। এ দেশ হবে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ।’

তিনি মাদক, সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত এবং সুশাসনের বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের কথাও বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি সহযোগিতা চাই দেশের জনগণের কাছে, দেশের তরুণ সমাজ ও সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে। আসুন, আমাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে। বিশ্বে এ দেশ যে সম্মান ও মযাদা অর্জন করেছে, এ দেশের মানুষ যেন সেই সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে চলতে পারে। তিনি উদ্ধৃতি দেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার, ‘তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল/ এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি/নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ আসুন আমরা প্রতিজ্ঞা করি, জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা আমরা প্রতিষ্ঠা করবই।”

৭১-এ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আমি দেখিনি। তবু মনে পড়ে গেল বঙ্গবন্ধুর সেই কথা, কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না। অবচেতনেই, অপ্রাসঙ্গিকভাবেই কেন জানি মনে পড়ে গেল বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ। যে ভাষণে কুমিল্লায় এক ফৌজি সমাবেশে তিনি বলেছিলেন, মনে রেখো, শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে। তুমি যখন শাসন করবা, সোহাগ করতে শেখ। তাদের দুঃখের দিনে পাশে দাঁড়াবে। তাদের ভালোবেসো। কারণ তোমার হুকুমে সে জীবন দেবে। তোমাকে শ্রদ্ধা অর্জন করতে হবে। সে শ্রদ্ধা অর্জন করতে হলে তোমাকে শৃঙ্খলা শিখতে হবে। নিজকে সৎ হতে হবে। নিজের দেশকে ভালোবাসতে হবে এবং চরিত্র ঠিক রাখতে হবে। তা না হলে কোনো ভালো কাজ করা যায় না, দেশের মুখ কালো করো না, সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুখ কালো করো না। তোমরা আদর্শবান হও। সৎপথে থেকো। মনে রেখো, মুখে হাসি মনে বল তেজে ভরা মন, মানুষ হতে হবে মানুষ যখন। মাঝে মাঝে আমরা অমানুষ হয়ে যাই। এত রক্ত দেওয়ার পর যে স্বাধীনতা এনেছি, চরিত্রের পরিবর্তন এখনো অনেকের হয়নি। এখনো ঘুষখোর দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারি, মুনাফাখোর, বাংলার দুঃখী মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। দীর্ঘ তিন বছর এদের আমি অনুরোধ করেছি, আবেদন করেছি, হুমকি দিয়েছি, কিন্তু চোরে নাহি শোনে ধর্মের কাহিনি। কিন্তু আর নয়।

দুর্নীতি আজ ব্যক্তি পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়ের বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের নানা অধ্যায়ে অভাব, অনটন, অশিক্ষা-কুশিক্ষা আমাদের মাঝে দুর্নীতি ছড়াতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। আমাদের দেশে এখন আর আগের মতো দারিদ্র্য নেই। সরকারের পক্ষ থেকে সরকারি-বেসরকারি সর্বস্তরে সাধারণ মানুষের বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের পক্ষে যথেষ্ট সহায়ক। সে কারণে তাদের এখন দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া শোভা পায় না। আর দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে তাই রাঘববোয়ালরা ধরা পড়লে সরকারের পক্ষ থেকে আর কিছুই করার থাকবে না। তাই সরকারের আগাম ঘোষণার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সবার উচিত সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনার পথে অগ্রসর হওয়া। অনৈতিক জীবনের চক্র থেকে বের হয়ে আসতে হবে। জাতির পিতার স্বপ্নের দেশ গড়তে প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের একযোগে আজ দুর্নীবিরোধী জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেই পথে এগিয়ে যেতে হবে। তবেই এ প্রান্তিকেই সরকার দেশকে ১০০টি কার্যকরী উন্নয়নের সোপানে নিয়ে তার ফল জনগণকে উপহার দিতে পারবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট, কানাডা প্রবাসী

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close