সাধন সরকার

  ০৮ জানুয়ারি, ২০১৯

বিশ্লেষণ

পরিবেশ আইনের প্রয়োগ

অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সম্পদ, মানুষের জীবন-জীবিকা, শ্বাস-প্রশ্বাসের বায়ু, খাদ্য, পানি ইত্যাদি প্রকৃতি-পরিবেশ সংরক্ষণের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশে আইন আছে অথচ আইনের প্রয়োগ নেইÑ এ কথাটি প্রায়ই শোনা যায়! প্রকৃতি-পরিবেশ সংরক্ষণে বাংলাদেশে বহু আইন ও নীতিমালা আছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, এসব আইন ও নীতিমালার কার্যকর প্রয়োগের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে! জনসাধারণও পরিবেশের বিভিন্ন আইন সম্পর্কে অবগত নয়। তথ্য মতে, পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ বিশ্বের পেছনের সারির দেশগুলোর একটি। পরিবেশের বিভিন্ন দূষণে প্রতি বছর এ দেশে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়।

রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণে বিশ্বে দ্বিতীয়। এ ছাড়া দেশের জেলাশহরগুলো বিভিন্ন দূষণে জর্জরিত। দেশের অধিকাংশ নদ-নদী দখল-দূষণের শিকার। নাব্য সংকটের কবলে পড়ে অনেক নদ-নদী এরই মধ্যে হারিয়ে গেছে, অনেক নদ-নদী হারিয়ে যাওয়ার পথে। দেশের অধিকাংশ শিল্প-কারখানায় বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) না থাকার ফলে নদ-নদীগুলোর দূষণ বেড়ে যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাছবিচারহীনভাবে বৃক্ষ নিধন করা হচ্ছে। পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণ করা হচ্ছে। প্লাস্টিক-পলিথিনের মারাত্মক দূষণ পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করছে। ‘নিষিদ্ধ’ পলিথিনের ব্যবহার হচ্ছে দেদার। ইটভাটার দূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। শহরগুলোতে বর্জ্য দূষণের কারণে নগরবাসীকে ব্যাপক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকালে প্রকৃতি-পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করা হচ্ছে। কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) বিবেচনা করা হচ্ছে না! এক কথায়, পরিবেশ বিপর্যয়ে সার্বিক অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। দূষণের কারণে শিশুসহ সব বয়সীর স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সার্বিক পরিবেশ রক্ষার্থে পরিবেশের সব আইন যেন থেকেও নেই!

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-১৯৯৭ (সংশোধনীসহ), পরিবেশ আদালত আইন-২০১০, বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন-২০১৭, পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০১৬, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০০৬, চিকিৎসা বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা-২০০৮, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ (সংশোধনীসহ), জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইন-২০১০, মোটরযান আইন-১৯৪০, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০০৫, পণ্যে পাটজাত পণ্যের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন-২০১৩ ইত্যাদি আইন থাকলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ হয় না! পরিবেশ আইনের প্রয়োগ হলে জনসাধারণের মধ্যে যেমন সচেতনতা তৈরি হবে, তেমনি পরিবেশও রক্ষা পাবে।

পরিবেশ আদালত আইনটি বাস্তবসম্মত ও কার্যকর না হওয়ার ফলে পরিবেশ সুরক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না! পরিবেশ আইন-২০১০ অনুসারে দেশের প্রতিটি জেলায় একটি আদালত গঠনের বিধান থাকলেও ৩টি পরিবেশ আদালত (ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট) ও ঢাকায় একটি পরিবেশ আপিল আদালত কার্যকর রয়েছে। ফলে বিভিন্ন জেলার পরিবেশ দূষণের মামলা পরিচালনায় বাদী-বিবাদী উভয়েরই সমস্যা হচ্ছে। প্রত্যেকটি জেলায় পরিবেশ আদালত না থাকার কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা পরিবেশ দূষণ-সংক্রান্ত মামলা দায়ের করতে পারছেন না। আবার পরিবেশ আদালতের সংখ্যা কম থাকায় মামলা নিষ্পত্তি করতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। দুঃখের বিষয়, বিদ্যমান পরিবেশ আদালত আইনের আওতায় সাধারণ মানুষ দূষণ সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা করতে পারেন না! তারা শুধু ক্ষতিপূরণের মামলা করতে পারেন। তথ্য মতে, বাংলাদেশে পরিবেশ আদালতগুলোয় বছরে গড়ে মাত্র ৮০টির মতো মামলা দায়ের করা হয়! প্রশ্ন হলো, দেশের অন্য আদালতগুলো যেখানে মামলার ভারে ন্যূব্জ, সেখানে পরিবেশ আদালতে এত কম মামলা দায়ের করা হয় কেন? প্রতিদিন গণমাধ্যমে পরিবেশ দূষণ, অবক্ষয় ও বিপর্যয়ের কথা শোনা গেলেও মানুষ কেন পরিবেশ আদালতের দ্বারস্থ হয় না? এর প্রধান কারণ হলো পরিবেশ আইন সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা এখনো সেভাবে গড়ে না ওঠা। সাধারণত দেখা যায়, পরিবেশ বিপর্যয় ও দূষণকারী ব্যক্তি ধনী, প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর হয়ে থাকেন। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত বা ভুক্তভোগী ব্যক্তি দরিদ্র তথা সাধারণ হওয়ায় অনেক সময় মামলা দায়ের করতে উৎসাহিত হন না। আবার ন্যায়বিচার নিয়েও অনেক সময় সন্দিহান থাকেন! দেখা যায়, মামলা চালনা করার খরচও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির থাকে না! এসব কারণে প্রশ্ন উঠতে পারে, পরিবেশ আদালত কতটুকু জনবান্ধব? আবার পরিবেশ আদালতে অভিযোগকারীকেই সব সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করতে হয়, যা অভিযোগকারীর জন্য কঠিন কাজ বটে! পরিবেশ আদালতে আবার পরিবেশ-সংক্রান্ত অন্যান্য সব (বন রক্ষা, পানি দূষণ, জীববৈচিত্র্য রক্ষা ইত্যাদি) মামলাও দায়ের করা যায় না। শুধু ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩-এর অপরাধসমূহের বিচার ও ক্ষতিপূরণের দাবি করা যায়। তাই এখন সময়ের প্রয়োজনে পরিবেশ আদালতে পরিবেশগত অধিকার সুরক্ষায় জনসাধারণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পরিবেশ আইন সংশোধন করে সব ধরনের মামলা করার এখতিয়ার ও সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। পাশাপাশি পরিবেশ-সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন ও বিধিমালার বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। এর ফলে নিজেদের আশপাশের পরিবেশ রক্ষার্থে জনসাধারণ সরাসরি ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close