মু. মিজানুর রহমান
পর্যালোচনা
যা থাকা জরুরি ইশতেহারে
আসছে ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮ বাংলাদেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অপ্রত্যাশিত কিছু না ঘটলে বা যৌক্তিক কোনো কারণে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ধার্যকৃত দিন-তারিখ পরিবর্তন না করলে উল্লিখিত দিনেই নির্বাচন হবে। সে হিসেবে এখন খুব বেশি দিন বাকি নেই। দেশে মাথা তোলা দলগুলোর নির্বাচনী প্রস্তুতি প্রায় শেষের দিকে, কোনো কোনো দলের হয়তো শেষ। বাকি আছে ইশতেহার ঘোষণার, যার মাধ্যমে দলগুলো জয়ী হলে কী কী কাজ করবে এবং এতে রাষ্ট্র এবং জনগণের কী ধরনের উপকার পাবে, সেসবের একটি প্রাথমিক ধারণা উপস্থাপন করে থাকে। একটি জাতীয় নির্বাচনে বিভিন্ন ইশতেহার ভিন্ন ভিন্ন হলেও অনেক ক্ষেত্রে বা মৌলিক দিকগুলোয় প্রায় একই রকম দেখা যায়।
দেশ ও জনগণের বেশ কিছু মৌলিক চাহিদার একটি হলো শিক্ষা। শিক্ষা ছাড়া কোনো ব্যক্তি যেমন সফল হতে পারে না, তেমনি একটি জাতি বা দেশের পক্ষেও সম্ভব নয় কাক্সিক্ষত ইতিবাচক পরিবর্তন আনা। আমরা বাংলাদেশিরা এখনো মনে করি শিক্ষা মানে হলো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা এবং এই পড়াশোনার উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হলো একটি ভালো চাকরি। কিন্তু ভালো চাকরির কোনো সুস্পষ্ট ধারণা আমাদের নেই। কেউ হতে চায় প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা আবার কেউ যেকোনো পর্যায়ের একটি সরকারি চাকরি পেলেই বেজায় খুশি। আমাদের সমাজে একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘সরকারি চাকরির পানিও ভালো’। কিংবা ‘হাতি বাঁচলেও লাখ টাকা, মরলেও লাখ টাকা’। সরকারি চাকরিকে এখানে হাতির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আবার কেউ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির প্রত্যাশা করে থাকেন। এসব চিন্তাধারা যে শিক্ষার মূল ধারণা থেকে অনেক দূরে, চাকরি লাভের আশায় শিক্ষার্জন করা অনুচিত বা কর্মমুখী শিক্ষাই সর্বোত্তম শিক্ষা, সে ব্যাপারে লাখ লাখ বেকারের দেশে নির্বাচনী ইশতেহারের এমন একটি সমস্যা সমাধানে বিশেষ চ্যালেঞ্জ থাকা জরুরি, যদিও কর্মমুখী শিক্ষার ছোঁয়া আমাদের সোনার দেশে ইতোমধ্যেই লেগেছে। পাশাপাশি আমাদের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষার্থী/প্রশিক্ষণার্থী-শিক্ষক/প্রশিক্ষকের প্রত্যাশিত অনুপাত অনুপাত ১২ : ১ প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এর লক্ষ্য, উদ্দেশ্যের নীতিগত তাগিদগুলোর মধ্যে একটি হলো ‘মুখস্থ বিদ্যার পরিবর্তে বিকশিত চিন্তাশক্তি, কল্পনাশক্তি ও অনুসন্ধিতসু মননের অধিকারী হয়ে শিক্ষার্থীরা প্রতিস্তরে মানসম্পন্ন প্রান্তিক যোগ্যতা নিশ্চিত করা, যা বাস্তবায়নের জন্য মাধ্যমিক পর্যায়ে চালু হয় সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি। ধারণা করা হয়েছিল, শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যার বালাই থেকে মুক্তি পাবে। কিন্তু সে আর হলো কোথায়? শিক্ষা ক্ষেত্রে সত্যিকারের সৃজনশীলতা আনয়ন এখন সময়ের দাবি। শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ ধর্ম অনুসারে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাদানের মাধ্যমে উন্নত চরিত্র গঠনেরও কথা বলা আছে শিক্ষানীতিতে। ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার জন্য পৃথক পৃথক পাঠ্যপুস্তক, রুটিনে ধর্ম বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি ও পরীক্ষায়ও এর উপস্থিতি সমগুরুত্বের সঙ্গে থাকার পরও সাধারণ ধারায় সঠিকভাবে ধর্মীয় শিক্ষা শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। এটি নিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ সরকারের কাজ করা জরুরি।
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুসারে ২০১৮ সালের মধ্যে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১ : ৩০ অর্জন করার কথা কিন্তু বিভিন্ন কারণে সরকার এখানে ব্যর্থ হয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রা অতি দ্রুতই অর্জন করা দরকার। সময় এসেছে মাধ্যমিক শিক্ষাও প্রাথমিকের মতো সরকারীকরণ করা। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনেক সময় বিভিন্ন শিক্ষাবিদ বা শিক্ষাকর্মীরা ‘সনদ’ নির্মাণের কারখানা বলে থাকেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হওয়ার কথা একেকটি গবেষণা কেন্দ্র। এমনকি বিশ্ব র?্যাংকিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুব ভালো অবস্থানে নেই, অধিকাংশ তো এই র?্যাংকিংয়েও নেই। এই অবস্থার পরিবর্তন আনাও কি পরবর্তী সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হওয়ার কথা নয়? পরিকল্পনায় রয়েছে দেশের প্রতিটি জেলায় অন্তত একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের, আপাতদৃষ্টিতে একে ইতিবাচক বলা যায়। তবে এ মুহূর্তে আমাদের স্বতন্ত্র দুটি বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন। একটি ‘কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়’ অন্যটি ‘শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়’। উচ্চতর পর্যায়ের বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেখভাল, সনদ প্রদান ও নতুন নতুন নানামুখী বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদনসহ নিজস্ব ক্যাম্পাসে কর্মমুখী বিভিন্ন একাডেমিক প্রোগ্রাম ও প্রশিক্ষণ পরিচালনা করবে, এমন বিশ্ববিদ্যালয়েরও দরকার আছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এবং সেসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়মিত শিক্ষাবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া হয়ে থাকে। এসব থেকে নিজ দেশের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বাইরের শিক্ষার্থীদেরও ডিগ্রি দিয়েছে। বাংলাদেশের বহু শিক্ষার্থী-শিক্ষকও ওইসব থেকে ডিগ্রি এবং প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন প্রয়োজনের তাগিদে। খরচ করতে হয়েছে লাখ লাখ টাকা। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যারাই ডিগ্রি নিয়েছেন বা নিচ্ছেন তাদের বড় অংশ নিজের খরচে নেননি। কখনো সরকার, আবার কখনো বা ওই বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর খরচ বহন করেছে। সরকার যেহেতু দেশের ও দেশের শিক্ষাব্যবস্থার স্বার্থে লাখ লাখ টাকা খরচ করে প্রতি বছরই এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জনের জন্য বা প্রশিক্ষণের জন্য শিক্ষার্থী ও প্রশিক্ষণার্থী পাঠায়। এ থেকেই এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের গুরুত্ব বোঝা যায়। ধীরে ধীরে এর প্রসার বাড়ছেই। নির্বাচনী ইশতেহারে এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রতিশ্রুতি থাকুক।
বিদ্যালয় ও বিদ্যালয়ের বাইরে চলমান কোচিং ব্যবসা থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে মুক্ত করার সময় এসেছে। এসব কোচিংয়ের ফাঁদে পড়ে শিক্ষার্থীরা আজ অধিকাংশ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ছাড়া তেমন অংশ নিচ্ছে না। শিক্ষকদের একটি বিশাল অংশও শ্রেণিকার্যক্রমে মন না দিয়ে কোচিং ব্যবসায় নেমেছে। হতে পারে বেসরকারি শিক্ষকরা এমপিও থেকে যে পরিমাণে মাসিক অর্থ পাচ্ছেন, তা দিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে থাকা কষ্টকর। এসবও আলোচনার টেবিলে থাকা জরুরি। মাধ্যমিক শিক্ষাকে প্রাথমিকের মতোই জাতীয়করণের সময় এসেছে।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের একাডেমিক ক্যালেন্ডারে পরিবর্তন আনার সময় এসেছে। শিক্ষাবর্ষ ও বার্ষিক বিদ্যালয় কর্মদিবস প্রণয়নে কোনো নির্দিষ্ট দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু নিয়ে আলোচনা অন্যতম প্রধান বিষয়। প্রত্যেকটি দেশের আবহাওয়া বিবেচনায় নিয়ে বছরের একেক সময় থেকে একেক সময় পর্যন্ত শিক্ষাবর্ষ গণনা করা হয়। ষড়ঋতুর বাংলাদেশের আবহাওয়া বিবেচনায় নিলে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ধরে রাখার মতো তুলনামূলক বেশি উপযুক্ত সময়ে শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত থাকে বিভিন্ন রকম কো-কারিকুলার কার্যক্রমে, না হয় পরীক্ষা নিয়ে। আর যে সময় প্রকৃতিতে থাকে বিরতিহীন দাবদাহ, বৃষ্টি, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো বৈরী আবহাওয়া তখন ক্যালেন্ডারে থাকে বিরতিহীন শ্রেণি কার্যক্রম। তাই তো শিক্ষাবর্ষ পঞ্জির প্রত্যাশিত পরিবর্তন আনতে হবে।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির এই যুগে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সবগুলোকেই শতভাগ এই প্রযুক্তির আওতায় আনতে হবে। এমন ছোট-বড় অনেক চাওয়া রয়েছে, একাদশ জাতীয় সংসদে যারা আধিপত্য বিস্তার করবেন। আশা করছি, ওই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিলে শিক্ষা ক্ষেত্রে যেমন উন্নতি আসবে, তেমনি ওই সময়ে দায়িত্বে থাকা সরকারি দলেরও রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে।
শুধু শিক্ষা ক্ষেত্রেই নয়, বাংলাদেশ প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভালোর দিকে উন্নতি লাভ করুক। একাদশ জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুন্দর হোক।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
"