অলোক আচার্য

  ০২ ডিসেম্বর, ২০১৮

নিবন্ধ

বিজয়ের মাসে জনগণের বিজয়

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন বাকি আছে। দেশের মানুষ এখন দিন গোনা শুরু করেছে। দল থেকে সংসদীয় আসনগুলোতে প্রার্থী তাদের যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে। মনোনীত প্রার্থীরা এখন নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার কৌশলে ব্যস্ত। এরই মধ্যে সারা দেশে মনোনয়ন জমা দেয়ার কাজ শেষ হয়েছে। ৩০০ আসনে মনোনয়ন জমা পড়েছে ৩ হাজারের বেশি। নির্বাচন মানেই ভোট উৎসব। এত বড় বিশাল কর্মজজ্ঞ যেখানে পাঁচ বছরের জন্য তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে। উৎসব মানে আনন্দের কোনো উৎস। নির্বাচন হলো সবার আনন্দ করার উপলক্ষ। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করার পর থেকেই এই আনন্দ শুরু হয়েছে। হাটে বাজারে, গ্রামে গঞ্জে চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সব জায়গায় এখন নির্বাচনের আলোচনা। কে জয়লাভ করবে আর কে পরাজিত হবে। সেই সঙ্গে তাদের মনে শঙ্কাও থাকে। সেই শঙ্কা হলো সহিংসতার, সেই শঙ্কা হানাহানির। ভোটারদের তাদের প্রতিনিধি মূল্যায়ন করার সময়। এই সময়টাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচন না করলে তার ফলও এই জনগণকেই ভোগ করতে হবে। অনেক স্থানে বড় দুই দলই বিকল্প প্রতিনিধি রেখেছে। শেষ পর্যন্ত একজন থাকবে। মনোনয়নপত্র জমা দেয়াকে কেন্দ্র করে দেশে উৎসব মুখর পরিবেশ আমরা দেখেছি। শেষ পর্যন্ত যেন এই উৎসব বজায় থাকে। জনগণের রায় যেদিকেই যাক উৎসব মুখর পরিবেশটা যেন ঠিক থাকে। নির্বাচন পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক থাকা আবশ্যক। অতীতে নির্বাচনের পর দেখা গেছে বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা ঘটে। হামলা, বাড়িঘর ভাঙচুর, লুটতরাজ এসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে। একটি নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেই এই মারাত্মক পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়। বিশেষ করে দেশের সংখালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন আতংকিত থাকে। এদেশে পূর্ণিমা রানীর মতো নির্মম ঘটনা দেশবাসীর মনে আজও দাগ কেটে আছে। তাই এর আগে ঘটা অভিজ্ঞতা তাদের শঙ্কায় ফেলে।

এবারের নির্বাচনে ভুয়া সংবাদ বা গুজবের প্রচারণাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একজনকে গ্রেফতার করেছে যে একাই বহু অনলাইন পত্রিকা চালাত এবং অনেক ভুয়া ছড়িয়ে দিত। এরকম বহু ভুঁইফোঁড় অনলাইন দেশে চলছে যাদের কাজই হলো কোনো পক্ষ নিয়ে অপপ্রচার চালানো। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ রকম কয়েকটি ভুঁইফোঁড় অনলাইন বন্ধ করে দিয়েছে। আসলে অনলাইন পত্রিকা তৈরি করতে এবং তা চালাতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না জন্যই ভুয়া খবর প্রচার করতে এই মাধ্যম বেশি ব্যাবহার করছে। এসব ভুয়া খবর থেকে রাজনীতি, ধর্মীয়, সামাজিক বা অন্য যেকোনো ক্ষেত্রে গুজব ছড়ানো হয়। এর প্রকৃত উদ্দেশ্য থাকে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অপপ্রাচার কাজে লাগিয়ে হীন স্বার্থ উদ্ধার করা। গুজব ক্ষেত্রবিশেষে অনেক নিরীহ মানুষের প্রাণ সংশয় পর্যন্ত হতে পারে। গুজবে প্রভাবিত হয়ে অনেক সময় নিরীহ মানুষও প্রভাবিত হয় এবং নেতিবাচক কার্যে জড়িয়ে পরে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে নানা রকম অপপ্রচার আমরা দেখতে পাচ্ছি। অনেক নামি দামি পত্রিকার নামের সঙ্গে মিল রেখে প্রায় একই রকম ওয়েবসাইট খুলে বিভিন্ন অপপ্রচার করা হচ্ছে। এর উদ্দেশ্যই সাধারণ মানুষের ভেতর নেতিবাচক ধারণা ইচ্ছাকৃতভাবে জন্ম দেয়া এবং সেই সঙ্গে সেই মূল পত্রিকার সম্মানহানী করা। এর থেকে রক্ষা পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। অনেক বিশেষজ্ঞ মত দিয়েছেন যে, এ থেকে রক্ষা পেতে হলে নিজেদের সংবাদের নির্ভরযোগ্যতা এমন পর্যায়ে নিতে হবে যেন ভুয়া সংবাদ দেখেই বোঝা যায় যে এই সংবাদটি ঠিক নয়। এক্ষেত্রে তথ্য সূত্র, উক্তি, সময় এবং ঘটনার পারিপাশির্^কতা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে তারপর প্রচার করা। যারা গুজব ছড়াতে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করছে তারা কিন্তু প্রযুক্তিতে দক্ষ এবং চৌকস। কারণ প্রযুক্তিতে দক্ষ না হলে ডিজিটাল মাধ্যমকে উদ্দেশ্য হাসিলের রাস্তা হিসেবে বেছে নেয় না। মাস কয়েক আগে ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনা রোধের দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলনে এরকম গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। এটা নিতান্তই কোনো মহলের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যই ছড়ানো হয়েছিল। এর মাধ্যম ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। গুজবের প্রধান টার্গেট থাকে জনগণের সরলতাকে কাজে লাগানো। কোনো ষড়যন্ত্র যখন ব্যর্থ হয় তখন গুজব ছড়ানো হয়।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি এবং ২০ দলীয় জোট বিভিন্ন কারণে অংশগ্রহণ করেনি। তাই সেই নির্বাচন ছিল এক রকম। এই নির্বাচনেও অভিযোগের শেষ নেই। নির্বাচন কমিশনের ওপর, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২০ দলীয় জোট ঐক্যফ্রন্টে থেকে এবং অন্যদিকে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ মহাজোটের দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। ছোট ছোট অনিবন্ধিত দলগুলো বড় দলের সঙ্গে একত্রিত হয়ে আসনের দরকষাকষি করে নির্বচানে অংশ নিচ্ছে। ফলে সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে এটাই সবাই প্রত্যাশা করবে। এখন জনগণ কাকে ভোট দেবে এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এটি মূলত জনগণের ব্যাপার। গণতন্ত্রেও ধারণায় জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। মাঝে মধ্যে ক্ষমতায় আসার পর সেই চরম সত্যটি অনেক নেতাই ভুলে যান। যার ফলও পান ভোটের সময়। জনগণের তো ওই একটাই সুযোগ। জনগণ ভোটের হিসাব কষে তাদের জীবন যাত্রার মান হিসেব করে। যতই দলগুলো তাদের বক্তৃতায় দেশের মানুষ পাশে আছে বলুক না কেন প্রকৃতপক্ষে জনগণ তার পাশেই থাকবে যে জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করবে। জীবনযাত্রার মান, চাকরির নিশ্চয়তা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যেও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা, যোগাযোগ ক্ষেত্রে উন্নয়ন, শিক্ষা ও চিকিৎসা উন্নয়ন এসব দিক মাথায় রাখতে হবে। নির্বাচনের আগে সব দলই তাদের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে। সেই ইশতেহারে জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের কথা থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে।

নির্বাচনী পরিবেশ বলতে বোঝায় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেন দেশে কোনো বিশৃঙ্খলা না ঘটে। সবাই সমানভাবে সুযোগ পেয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে এবং ভোটাররা নির্বিঘেœ ভোট দিতে পারে এ রকম একটা পরিবেশ। এটা নির্বচানের আগে এবং পরে। সাধারণ মানুষ টেনশনে থাকে এই ভেবে যেকোনো হানাহানি বা লুটপাটের মতো কোনো ঘটনা ঘটবে কি না। এজন্য প্রথমে যেটা দরকার তা হলো ফল মেনে নেয়ার অভ্যাস। আমাদের দেশের রাজনীতিতে ফল মেনে নেয়ার সংস্কৃতি নেই বললেই চলে। বিভিন্ন অভিযোগের মধ্যে দিয়েই দেশ নির্বচানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। নির্বাচন মানে এক পক্ষ জয় পাবে এবং অন্যপক্ষ পরাজিত হবে। অনেক দেশে নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরে সেই ফল মেনে নিতে দেখি। কিন্তু আমাদের দেশে কারচুপির অভিযোগ আনা হয়। এদেশেও যদি প্রার্থীদের ফল মেনে নেয়ার মানসিকতা তৈরি হয় তাহলে শৃঙ্খলা অনেকটাই বজায় থাকবে। সেইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও সতর্ক অবস্থায় থাকতে হবে যেন কোনোভাবেই জননিরাপত্তা বিঘিœত না হয়। বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের ওপর সব হামলা এবং লুটতরাজের মতো ঘটনায় আরো বেশি সতর্ক থাকা দরকার। ডিসেম্বর মাস বাঙালির আবেগ এবং ভালোবাসার মাস। কারণ এ মাসেই আমাদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়েছিল। আমরা পেয়েছিলাম একটি পতাকা, একটি ভূখন্ড এবং বাঙালি হিসেবে আত্মপরিচয়। এই বিজয়ের মাসে আমাদের নির্বাচন। দেশবাসী তাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে উৎসবে মেতে ওঠার। বিজয়ের মাসে উৎসবে মেতে উঠবে বাংলাদেশের মানুষ। বিজয়টা যেন শেষ পর্যন্ত জনগণেরই হয়। যে উৎসাহ-উদ্দীপনা মানুষের মাঝে বিরাজ করছে বিজয়ের মাসেও তা যেন বজায় থাকে সাধারণ মানুষের এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close