শরীফুর রহমান আদিল

  ২৩ অক্টোবর, ২০১৮

মতামত

খাশোগি হত্যা এবং...

আন্তর্জাতিক মিড়িয়ায় গত দুই সপ্তাহ ধরে শিরোনামে উত্তপ্ত হচ্ছে খাশোগি হত্যা নিয়ে। পাশাপাশি পুনরায় সরগরম হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি। ঘটনার শুরু ২ অক্টোবর সৌদি রাজতন্ত্রের ঘোর সমালোচক সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যার মধ্যদিয়ে। সাংবাদিক ও কলামিস্ট জামাল খাশোগিকে সৌদি যুবরাজ সহ্য করতে পারতেন না, তা পুরো বিশ্বই জানে। আর তার এ সহ্য করতে না পারার কারণে তিনি স্বেচ্ছা নির্বাসনে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতে শুরু করেন। কিন্তু ২ অক্টোবর বর্তমান স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাজ সারতে তুরস্কের সৌদি কনস্যুলটে প্রবেশ করলে সেখানে আগ থেকে ওঁৎ পেতে থাকা সৌদি বাদশার আস্থাভাজন ফরেনসিক বিভাগের প্রধান তাকে মাত্র সাত মিনিটের মধ্যে হত্যা করে শরীর টুকরো টুকরো করে সরিয়ে ফেলে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ জঘন্য কাজটি করতে তারা হেডফোন দিয়ে গান শুনছিল আর উপস্থিত অন্যদেরও গান শুনতে নির্দেশ দিচ্ছিল। তুরস্কের হাতে আসা ১১ মিনিটের অডিও বার্তায় এসব তথ্য জানতে পারে পুরো বিশ^। কী নিষ্ঠুর! কী জঘন্য কাজই না সংঘটন করলেন সালমান! আর এ ঘটনার ১৭ দিন পরে সৌদি কর্তৃপক্ষ ইনিয়ে-বিনিয়ে স্বীকার করে যে, খাশোগি সৌদি দূতাবাসেই নিহত হয়েছেন। কিন্তু সালমান নিজেকে বাঁচাতে এর দায় তুলে দিলেন তার ঘনিষ্ঠ ও সবচেয়ে বিশ্বস্থ জেনারেল আহমেদ আল আসরির ঘাড়ে! আর এ কারণে আমেরিকার এক সিনেটর সৌদি বাদশাহকে বিষাক্ত শাসক বলে মন্তব্য করেন।

খাশোগি হত্যাকা-টি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভালো চোখে দেখছেন না। বিষয়টি বুঝতে পেরে সৌদি বাদশা তার ক্ষমতা হারানোর ভয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করে বিষয়টি নিয়ে সামনে না এগোতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পের হাতে তুলে দেন ১০০ কোটি ডলার। আর বিভিন্ন মহল থেকে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সৌদি আরবকে শাস্তি দিতে পারে বলে যে আওয়াজ উঠেছে তা থেকে মুক্তি পেতে এবং মার্কিন প্রশাসনকে খুশি রাখতে সৌদি কর্তৃপক্ষ কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। গত জুলাই মাসে ইরান ও ভেনিজুয়েলার তেলের ঘাটতি পূরণে সৌদি আরবকে তেল উৎপাদন বৃদ্ধির যে আহ্বান জানিয়েছে, ট্রাম্প তাতে সাড়া দিয়েছে সৌদি আরব। রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনার যে চিন্তাভাবনা করছিল সৌদি সরকার, তা থেকে আপাতত পিছু হটেছে বলেই মনে হচ্ছে এবং ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি থেকে অস্ত্র কেনা কমিয়ে তা যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ধাবিত করাই হচ্ছে নতজানু হওয়ার অন্যতম লক্ষ্যণ। সুতরাং, ট্রাম্প ছাড়া সৌদি বাদশা যে অসহায় তা তিনি ভালো করেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। আর ট্রাম্প নিজেও বিষয়টি গত দুই সপ্তাহ আগে স্পষ্ট করেছেন। তার মতে, ‘মার্কিন সাহায্য ছাড়া দুই সপ্তাহও টিকবে না সৌদি!’ সবচেয়ে বড় কথা হলো, ট্রাম্পের এ বক্তব্যের বিরুদ্ধে সৌদি প্রশাসন কোনো প্রতিক্রিয়াই জানায়নি!

সৌদি যুবরাজের আগে ও নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে ইসরায়েলের সঙ্গে বিভিন্ন চুক্তি করে পারস্পারিক সর্ম্পক উন্নয়নের চেষ্টা করেন। অন্যদিকে, মুসলিম ভাই হওয়া সত্ত্বেও ফিলিস্তিনিদের দিকে সহানুভূতির হাত বাড়াননি এই যুবরাজ। বিশে^র অধিকাংশ দেশ ইসারায়েলের বর্বরতার ধিক্কার জানিয়ে বিভিন্ন বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা চালান। কিন্তু সৌদি আরব কেবল ক্ষমতার লোভে ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে মুসলিম বিশ^কে হতবাক করেন। সৌদি আরবের বাদশা যেই হন না কেন, তাকে মুসলিম বিশে^র প্রতীকী খলিফা হিসেবে মনে করা হয়। যদিও শক্তি সামর্থ্যরে দিক থেকে ইরান কিংবা তুরস্ক সৌদি থেকে আরো এগিয়ে। তবুও কেবল মক্কা-মদিনা সৌদি আরবে অবস্থিত হওয়ায় সেখানে হজ পালনে ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা থাকায় সমগ্র বিশে^র মুসলিমদের সৌদিতে আসতে হয়। এতে তার দেশের সঙ্গে সৌদির সর্ম্পক যেমনই হোক না কেন, কিন্তু মক্কা মদিনার খাদেম সৌদি বাদশার মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ভ্রাতৃপ্রতীম সর্ম্পকের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে বরং মুসলিম দেশগুলোকে একঘরা করার পায়তারা করছেন। দেশটি মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিহিত করাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। এ ছাড়া তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বিরুদ্ধে গত বছর সামরিক অভ্যুথানের প্রচেষ্টা হয়েছিল, সেখানেও সৌদি বাদশার ছিল বিশাল ভূমিকা। অন্যদিকে, গত বছর লেবাননের প্রধানমন্ত্রীকে জোর করে আটকে রেখে পদত্যাগে বাধ্য করায়। সৌদ আরবের কীর্তিকলাপ এখানেই শেষ নয়, কাতার অবরোধ করে নিজের ক্ষমতা জাহির করার পাশাপাশি ইয়েমেনে হুতি বিদ্রেহী দমনের নামে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে দেশটি; যা মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার করেছে।

পশ্চিমাদের একনিষ্ঠ বন্ধু সালমান। মূলত আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশে^র সমর্থনে নিজেকে একজন প্রতাপশালী শাসক হিসেবে পরিচিত করাতে সামর্থ্য হয়েছেন। তবে সৌদি বাদশা নিজেকে প্রতাপশালী হিসেবে উপস্থাপন করালেও কূটনৈতিক জ্ঞানে তিনি অনেকটাই পিছিয়ে আছেন। খাশোগি হত্যাকা-ের মধ্যদিয়েই এর প্রমাণ তিনি দিয়েছেন। কেননা, সৌদি যুবরাজ খাশোগিকে তার দেশে ফিরিয়ে নিতে অন্তত ৩০ বার টোপ পেতে ছিলেন। কিন্তু খাশোগি সেই টোপ বুঝতে পেরে তাতে সাড়া দেননি। সৌদি আরব চাইছিল তুরস্কে এ ধরনের হত্যাকা- সংঘটিত করে সৌদি রাজতন্ত্রের সমালোচকদের কঠিন বার্তা দিতে। একই সঙ্গে এটা জানিয়ে দিতে যে, সমালোচকদের আশ্রয়স্থল তুরস্ক হলেও তাদেরকেও নিরাপদে থাকতে দেবে না সৌদি কর্তৃপক্ষ। সর্বোপরি, তুরস্ককে কিছুটা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বেকায়দায় ফেলানো। কিন্তু তুরস্ককে বেকায়দায় ফেলতে গিয়ে অপরিণামদর্শিতার জন্য এখন সৌদি আরব নিজেই বেকায়দায় পড়েছে। তুরস্ক তার প্রজ্ঞা দিয়ে সৌদি আরবকে ভালোভাবেই চাপে ফেলতে পেরেছে। দেশটি তার কূটনৈতিক দক্ষতা কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সৌদি আরবকে অপরাধী ও তার দায় স্বীকার করতে বাধ্য করেছে। তবুও সৌদি বাদশা এ সংকট থেকে উত্তরণে এবং নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে আমেরিকার মডারেট ইসলাম নামে প্রতিষ্ঠিত থিংক ট্যাঙ্কের মাধ্যমে আরো কিছু সংস্কার করাতে পারে। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে পবিত্র নগরী মক্কা থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ফারাসান দ্বীপপুঞ্জে ঘোষিত রেড সি প্রজেক্টেও কাজ তরান্বিত করতে পারে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সৌদি আরবের বিরুদ্ধে আমেরিকা বড় কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেবে না। কেননা, তারা বুঝতে পেরেছে এ বাদশার ন্যায় এত আনুগত পরায়ন বাদশা আমেরিকা কখনোই পায়নি। একে দিয়েই সংস্কারসহ আরো কয়েকটি মুসলিম দেশকে নিশ্চিহ্ন করার কাজে ব্যবহার করা যাবে; যা হবে পশ্চিমা বিশ্বের জন্য হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো একটি সুবর্ণ সুযোগ।

লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close