অলোক আচার্য

  ২৩ অক্টোবর, ২০১৮

পথশিশু

রাষ্ট্র ও সমাজের দায়বদ্ধতা

বাংলাদেশসহ সারা বিশে^ই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের দেখা মেলে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল, স্বল্পন্নোত বা অনুন্নত দেশগুলোতে এদের দেখা বেশি মেলে। আমাদের দেশেও চারদিকে তাকালেই এধরনের শিশুর দেখা মেলে। রাস্তা বা ফুটপাত যাদের ঠিকানা। বড়লোকের আহ্লাদে বড় হয়ে ওঠা শিশুদের পাশাপাশি এরাও বড় হয়। অভাব যাদের জীবনে নিত্যসঙ্গী। খোলা আকাশ যাদের মাথার ওপর ছাদ হয়ে থাকে। জন্মের পরপরই তারা পৃথিবীর এক অন্যরকম চিত্র দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠে। ধনী-গরিবের ব্যবধান তারা জন্মের পরেই দেখতে পায়। এসব ভাগ্যহীন, পরিচয়হীন শিশুদের আমরা কখনো টোকাই, কখনো পথকুলি, ছিন্নমূল বা পথশিশু বলে ডাকি। পথই যাদের আপন, পথই যাদের চূড়ান্ত ঠিকানা। যাদের জন্ম হয় পথে অথবা জন্মের পর ঠাঁই হয় পথে আর জীবন পার হয় পথে এবং শেষও হয় সেই পথেই। এরা পথশিশু। যাদের জন্য সমাজের, রাষ্ট্রের, সুশীল সমাজের সবারই দায় রয়েছে। এসব পথশিশুরা বঞ্চিত হয় রাষ্ট্র প্রদত্ত মৌলিক অধিকার থেকে। এরা অনেকেই শিক্ষা লাভ করার সুযোগ পায় না, পুষ্টিকর খাদ্য পায় না, পোশাক বা মাথার নিচে ছাউনি পায় না। যদিও রাষ্ট্র থেকে এদের জন্য বিভিন্ন সময় নানারকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তবে তা পর্যাপ্ত নয়। কারণ, প্রতিনিয়তই এই ধরনের পথশিশুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। জাতিসংঘ শিশু সনদে বর্ণিত ঘোষণা অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী সকলেই শিশু। সে অনুযায়ী আমাদের দেশের একটি বড় অংশই শিশু। দারিদ্রতামুক্ত দেশ সব দেশের জন্য কাম্য একটি অবস্থা। বাংলাদেশও ধীরে ধীরে দারিদ্রতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি এতটা সহজ নয় যে, হঠাৎ করে কোনো পরিবর্তন সম্ভব। আমাদের সামনে এখনো অনেক বাধা রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো শিক্ষা।

এসব অধিকার বঞ্চিত শিশুকে আত্মশক্তিতে বলিয়ান করে তুলতে চাই উপযুক্ত শিক্ষা ও পরিবেশ। সঠিক পরিবেশ আর অযতœ-অবহেলায় যেন তারা শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, সে বিষয়ে যুগোপযুগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে যেসব ভাসমান শিশুদের অবস্থান তাদের জন্য সমন্বিতভাবে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। রাজধানী ঢাকায় পথশিশুর সংখ্যা বেশি এবং এসব পথশিশুর জীবন ও জীবিকা নির্বাহ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এদের অসহায়ত্তের সুযোগ নিয়ে নানা অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করছে সুযোগসন্ধানী মানুষ। একটু ভালো থাকার আশায় না বুঝেই সেসব কাজে জড়িয়ে যাচ্ছে এসব পথশিশুর অনেকেই। তাদের সামনে তো ভালো থাকার বিকল্পও নেই। এভাবে ছোট ছোট অপরাধ থেকে বড় অপরাধে জড়িয়ে পরাটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে এসব পথশিশুকে বেছে নিচ্ছে মাদক কেনা-বেচায়। আমাদের বুঝতে হবে প্রতিটি শিশুই তার মেধাশক্তি নিয়ে জন্ম নেয়। শিশুদের মধ্যেই সুপ্ত থাকে প্রতিভা। তারাই হবে দেশ ও জাতির কান্ডারি। এসব অনেক শিশুর মধ্যেই লুকিয়ে আছে বৈমানিক, বিজ্ঞানী, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক বা চিকিৎসক। পরিবেশ পরিস্থিতিতে কারো মেধাশক্তি বিকশিত হয় আর কারো বিকশিত হয় না বা হওয়ার সুযোগ পায় না। এই মেধাশক্তি যদি নেতিবাচক কোনো কাজে ব্যবহার করে তাহলে সেটা সমাজের জন্য ভয়ংকর হয়ে ওঠে। এসব শিশুদের কাজে লাগাতে হলে তাদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। কেবল দারিদ্রতার কারণেই পথশিশু বাড়ছে না বরং এর পেছনে আরো অনেক কারণ রয়েছে। পরিচয়হীন, ঠিকানাবিহীন শিশুদেরও আশ্রয় হচ্ছে পথে। বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এসব শিশু পেটের ক্ষুধা মেটাতে নানা রকম কাজ বেছে নেয়। এসব কাজের মধ্যে রয়েছে হকার, শ্রমিক, রিক্সাচালক, ফুল বিক্রেতা, আবর্জনা সংগ্রাহক, হোটেল শ্রমিক, বুনন কর্মী, কুলি, বিড়ি শ্রমিক, ঝালাই কারখানার শ্রমিক ইত্যাদি বিভিন্ন রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ; যা আমরা আমাদের চারদিকে তাকালেই এর বাস্তবতা টের পাই। কেবল পেটের ক্ষুধা মেটানোই এদের কাছে মূখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এদের মধ্যে অনেকেই তাই একটু ভালোভাবে বাঁচার আশায় না বুঝেই অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পরে। আমরা যদি তাদের জন্য ভালোভাবে বাঁচার সুযোগ রাখি তারা নিশ্চয় অপরাধীদের কথায় প্রভাবিত হবে না। ফলে সমাজ থেকে অপরাধের মাত্রা অনেকটাই কমে আসবে।

প্রতিবছর পথশিশুদের নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, টকশোতে সমবেদনা ঝরে, এদের নিয়ে নানা পরিকল্পানা পদক্ষেপের কথা শোনা যায়। কিন্তু এর বাস্তবায়নের হার খুবই অপ্রতুল। ফলস্বরূপ ছিন্নমূল শিশুরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে। অথচ, আর দশটা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা শিশুর মতোই এদের রয়েছে পুষ্টিকর খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার অধিকার। কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য শিশুর জন্য একটি নিরাপদ বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলার যে অঙ্গীকার করেছিলেন, তা আজও সম্ভব হয়নি। দেশের পথশিশুদের সুরক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি দিবসও পালিত হয় আমাদের দেশে। ক্ষুধার জ্বালায় নিজের অস্তিত্ত বাঁচানোর চেষ্টায় পথে নেমেই এদের পরিচিতি হয় পথশিশু নামে। আমাদের সমাজের অনেকেই তাদের এই অসহায়ত্তের সুযোগও নেই। তাদের নানা কাজে ব্যবহার করি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশুদের কল্যাণে ১৯৭৪ সালের ২২ জুন জাতীয় শিশু আইন (চিলড্রেন অ্যাক্ট) জারি করেছিলেন; যার মাধ্যমে শিশুদের নাম ও জাতীয়তার অধিকারের স্বীকৃতি, সব ধরনের অবহেলা, শোষণ, নিষ্ঠুরতা, নির্যাতন, খারাপ কাজে লাগানো ইত্যাদি থেকে নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে নির্মমভাবে ঘাতকদের হাতে

বঙ্গবন্ধু নিহত না হলে তিনি শিশুদের জন্য অনেক কিছুই করতে পারতেন যাতে প্রতিটি শিশু তার অধিকারসহ সামাজিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারত। পথশিশুদের জীবন অত্যন্ত

কষ্টের। এক নিষ্ঠুর সত্যের সঙ্গে এদের বসবাস। আরাম আয়েশের ঠিক উল্টো দিকে এদের জীবন বহমান। নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্য খাওয়া ও এরকম স্থানে ঘুমানোর কারণে তারা প্রায়ই নানা রোগে আক্রান্ত থাকে। অথচ, চিকিৎসার সুযোগ নেই বললেই চলে। মেয়ে শিশুরা দালালচক্রের খপ্পরে পরে যৌনকাজে বাধ্য হচ্ছে। ফলে তারা নানা রকম যৌন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। একসময় এরা ভাসমান যৌনকর্মী হিসেবে রোজগারের পথ করে নিচ্ছে। অথচ সমাজে এদেরও একটা সুন্দর জীবনের স্বপ্ন ছিল।

বাংলাদেশে পথশিশু সংখ্যা যাইহোক না কেন, তা দেশের প্রকৃত উন্নয়নের অন্তরায়। একটা বিরাট অংশ যদি অযতœ আর অবহেলায় বেড়ে ওঠে, তাহলে দেশের প্রকৃত অগ্রগতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পথশিশুদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পুষ্টিকর খাদ্য ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা দিতে হবে। আটকাতে হবে তাদের বিপথে যাওয়া থেকে। সন্ত্রাসী কার্যক্রমে যেন কেউ না জড়ায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পথশিশুর শিক্ষায় অনেক বেসরকারি সংস্থাও কাজ করছে।

তবে তা অপর্যাপ্ত। বিভিন্ন কারণে ঢাকা মহানগরী ছাড়াও অন্য বিভাগীয় শহরগুলোতে ভাসমান শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। তবে রাজধানীতে এই সংখ্যা বেশি কারণ বেঁচে থাকার সুযোগ এখানেই বেশি। এসব পথশিশুদের সমাজের সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রের পাশাপাশি নাগরিক হিসেবে আমদেরও দায়িত্ব রয়েছে। সবাইকে সেই দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close