পঞ্চানন মল্লিক

  ১৭ অক্টোবর, ২০১৮

নিবন্ধ

গানে গানে বন্দনা

দেখতে দেখতে বছর ঘুরে আবার এলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। দীর্ঘ একটি বছর হিন্দু ধর্মের ভক্তবৃন্দ অধীর আগ্রহে দিন গুনতে থাকবে, কখন আসবে সেই মাতৃ আগমনের ক্ষণ। ভক্তের মঙ্গলকামনায় কাক্সিক্ষত সে শুভক্ষণে মা পতিগৃহ কৈলাশ ছেড়ে পিতৃগৃহ বসুন্ধরায় আসবেন। আনন্দে মুখর হবে চারিদিক। বাজবে মঙ্গল ঘণ্টা। মায়ের শ্রীচরণ স্পর্শ লাভে ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষমাণ ভক্ত হৃদয় যেন গেয়ে ওঠে, ‘এসো মা, এসো মা। এসো দুর্গতি নাশিনী দুর্গা মা। কর পল্লবখানি রেখে ওই রাঙা পায়, আমরা ভক্তবৃন্দ ডাকি গো মা তোমায়। জগতের মহা মঙ্গলও কামনায়, মর্তে নেমে এসো মা। এক হাতে শঙ্খ এক হাতে ঘণ্টা, ত্রিশুল লয়ে এসো মা উগ্রচ-া। অসুর বধিতে এসো অসুর বিনাশিনী, রুদ্র মুর্তি ধরে গিরিরাজ নন্দিনী। এসো মা এসো মা।’ ভক্তের এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে অবশেষে মা পা রাখেন এ মর্ত্য ধামে। সঙ্গে আসেন ছেলে-মেয়েÑ গনেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী ও সরস্বতী।

এই আগমন এবং পরবর্তীতে প্রস্থানে একেক বছর একেক বাহন হয় মায়ের। কখনো তিনি আসেন গজে, কখনো ঘটক, কখনো নৌকা আবার কখনো দোলায় চড়ে। আবার ফিরে যান ঠিক এই চার বাহনের যেকোনো একটিতে করে। এই বাহনেই নির্ধারণ হয় মর্ত্যবাসী জীবের এক বছরের শুভ-অশুভ, ভালো-মন্দ। মহালয়ার দিনই সূচনা হয় মায়ের আগমনী পর্বের। ওই দিন মন্দিরে মন্দিরে চ-ী পাঠের মাধ্যমে দেবী দুর্গাকে মর্ত্যলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এদিন থেকে দেবী পক্ষ এবং দুর্গা পূজার ক্ষণ গণনা শুরু। এদিন দেব-দেবীকুল পূজার জন্য নিজেদের জাগ্রত করেন। এর ঠিক সাত দিন পরে ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে দুর্গোৎসবের শুরু। মাকে পেয়ে ভক্তবৃন্দ আনন্দে গেয়ে ওঠেন, ‘মা এসেছে বাপের বাড়ি সঙ্গে ছেলে মেয়ে, আমরা আনন্দ করি মাকে কাছে পেয়ে। বোধনের বাজনা বাজে মন্দিরের মাঝে, নবরূপে এলেন আবার আমাদের মা যে। বরণ করে নিলাম তারে রক্ত জবা দিয়ে। মাকে পেয়ে আমরা যত পাপি-তাপির দল, চোখের জলে ভিজিয়ে দেব মায়ের চরণতল। হৃদয়ের লোভ-লালসা দিয়ে বিসর্জন, মায়ের পায়ে করব মোরা আত্মসমর্পণ। জড়ো হাতে মায়ের কাছে নেব কিছু চেয়ে।’ ঠিক এমনি করে যেন একদিন ব্যাকুল হয়েছিল রাজা সুরাথার মন। মারকেন্দীয় পুরান মতে, চেদী রাজ বংশের রাজা সুরাথা খ্রিস্টের জন্মের ৩০০ বছর আগে কলিঙ্গে (বর্তমানে ওড়িশায়) দুর্গা পূজার প্রচলন করেছিলেন। হারানো রাজ্য ফিরে পাবার অভিপ্রায়ে মূলত তিনি এ পূজা করেছিলেন। ত্রেতা যুগে লংকার রাজা বারণ সীতাকে হরণ করলে তাকে উদ্ধারের জন্য ব্রক্ষ্মার পরামর্শে রামচন্দ্র প্রথম শরৎকালে দেবীর পূজা করেন। এ পূজা ‘অকাল বোধন’ বা শারদীয় দুর্গা পূজা নামে পরিচিত। পূজা আসলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন ভরে ওঠে হাসি-আনন্দে। পূজা প্যান্ডেলগুলো ভরে ওঠে মানুষের মিলনমেলায়। ছোট বড়, ধনী-দরিদ্র, ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ সবাই ভিড় করে মন্দিরে। মেতে ওঠেন জগজ্জননীর বন্দনায়, ধর্মীয় আরাধনায়। সবাই এক সুরে গেয়ে ওঠেন, ‘দশভুজা মা, অসুর বধকারিণী। জগতের কল্যাণদাত্রী, পাপ-তাপ হারিণী। শান্তির সুধা নিয়ে এলে এই দুনিয়ায়, ভবো সংসার চলে মাগো তব করুনায়। পাপ-তাপ ঘোচে মাগো তব কৃপায়, চিত্তের আনন্দ দামিনী। করে লয়ে কুসুম ডাকি মাগো তোমায়, শত কোটি প্রণাম ও দুটি রাঙা পায়। পাপি-তাপি অনাথের পরম আশ্রয়। কাঙালের বিপদ তারিণী। দশভুজা মা।’

প্রতিদিন পূজা শেষে হয় অঞ্জলি পর্ব। ভক্তবৃন্দ উপোস থেকে পূজা শেষে পুষ্পাঞ্জলি দেন। মায়ের কাছে কয়মনো বাক্যে সুখ-সমৃদ্ধি ও উন্নতি চেয়ে, নিজের ও সন্তানের রোগমুক্তি, পাপমুক্তি চেয়ে প্রার্থনা জানান। দুর্গতি নাশিনী মা তাদরে সব বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করবেন এই থাকে তাদের কামনা-বাসনা। পূজা উপলক্ষে ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিদিন সন্ধ্যায় মন্দিরে চলে সন্ধ্যারতি। ঢাকের বাদ্যের তালে নানা রকম অঙ্গ ভঙ্গিমায় মাকে বরণ করেন নৃত্য শিল্পীরা। পূজা ঊপলক্ষে বসে মেলা বা বাজার। বাজারে থাকে উপচেপড়া ভিড়। মিষ্টান্ন, খেলনা, কসমেটিক্স বিক্রি হয় দেদারছে। কোনো কোনো জায়গায় পূজা উপলক্ষে রাতে ধর্মীয় যাত্রাপালা, মনোজ্ঞ সাংস্কৃৃতিক অনুষ্ঠানও অনুষ্ঠিত হয়। এসব অনুষ্ঠানে সমবেত হয়ে মানুষ ক্ষণিকের জন্য হলেও হাসি আনন্দে মেতে ওঠেন। সার্বজনীন দুর্গোৎসব পরিণত হয় মানুষের মিলন তীর্থে। চারিদিকে বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। জাতি ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এ পূজায় আজকাল সবাই-ই সমবেত হন। ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশে এ পূজা হৃদয়ে হৃদয়ে সৌহার্দের মেলবন্ধন সৃষ্টি করুকÑ এমনটি আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close