দিলীপ কুমার আগরওয়ালা

  ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

পর্যালোচনা

বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুত্ব

বাংলাদেশ ও ভারত সহযোগিতার এক নতুন সোপানে পা দিয়েছে গত সোমবার দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। ভিডিও কনফারেন্সে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ও ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীও অংশ নেন। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভারত থেকে আরো ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়। একই সঙ্গে ভারতীয় ঋণসহায়তায় বাংলাদেশ রেলওয়ের কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশন পুনর্বাসন ও আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েল-গেজ রেলসংযোগ নির্মাণ খাতের বাংলাদেশ অংশের প্রকল্প উদ্বোধন হয়।

কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন। বলেন, ভারত থেকে আরো ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশকে আরো ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেওয়ার যে পরিকল্পনা করছে, তাতে নরেন্দ্র মোদির সরকার সম্মতি দেবে এমন আশাবাদও ব্যক্ত করেছেন তিনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ২০১৫ সালে তার বাংলাদেশ সফরের সময় ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেওয়ার বিষয়টি নির্ধারিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সংযোগ প্রকল্প সম্পন্ন হলে ১ দশমিক ১৬ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ ভারত থেকে বাংলাদেশে যাবে। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন ও দর্শনের প্রশংসা করেন মোদি।

আজকের যুগে উন্নয়ন ও ইন্ধনশক্তি সমার্থক হিসেবে বিবেচিত। ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে বিদ্যুৎ আমদানি এ সমস্যার সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশ প্রতিবেশী নেপাল ও ভুটান থেকেও বিদ্যুৎ আমদানির চেষ্টা করছে। এতে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার পরিবেশ যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি অর্থনৈতিকভাবে সব দেশই লাভবান হবে। বাংলাদেশ ও ভারত দক্ষিণ এশিয়ার দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র। দুটি দেশ একই সঙ্গে সার্ক, বিমসটেক, আইওয়া এবং কমনওয়েলথের সাধারণ সদস্য। বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে বাংলা ভাষা ব্যবহার হয়ে থাকে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় দুদেশের মধ্যে শক্তিশালী জোটের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশেষ করে যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের এক কোটি উদ্বাস্তুকে আশ্রয়দান ও স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ ২৫ বছরমেয়াদি বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি, ১৯৭৪ সালের ১৬ মে মুজিব-ইন্দিরা সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক উদারীকরণের সূত্রপাতের সঙ্গে তা বৃহত্তর প্রবৃদ্ধি ও বাণিজ্যের উদ্ভব ঘটায়। বাংলাদেশ ও ভারত দুদেশই সন্ত্রাসবাদবিরোধী কৌশলগত অংশীদার হিসেবে ভূমিকা রাখছে। তারা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় এলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে নব দিগন্তের সূচনা হয়। বন্ধুদেশ হিসেবে ব্যবসায়িক সুযোগ সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক যোগাযোগ বাড়াতে সক্ষম হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে দেশ দুটির মধ্যে ৩০ বছরমেয়াদি গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের বর্তমান সম্পর্ককে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার রোল মডেল হিসেবে আখ্যায়িত করা চলে। ২০১৫ সালের মাঝামাঝিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় প্রতিশ্রুত ১১টি উন্নয়ন সহযোগী উদ্যোগের অধিকাংশই এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরের মধ্য দিয়ে দুদেশের সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। এই তো সেদিন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে ঐতিহাসিক হিসেবে অভিহিত করে আমাদের রাষ্ট্রপতি বলেছেন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল ও ভারত (বিবিআইএন) উদ্যোগসহ দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক বহুমাত্রিক হচ্ছে।

বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিদ্যমান। মাঝেমধ্যে দুদেশের সম্পর্কে স্থবিরতা বিরাজ করলেও উভয় দেশের সহযোগিতায় তা আবার বেগবান হয়েছে। অস্বীকার করা যাবে না, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ঐতিহাসিক ভিত্তি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ, যা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রীয় চেতনাকে বেগবান করা। ফলে দুদেশের নীতিনির্ধারকদের কাছে সম্পর্কের আস্থা সুসংহত করে বিদ্যমান বিরোধগুলোকে সহনশীল মাত্রায় নামিয়ে আনা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বেশ কিছু অমীমাংসিত ইস্যুতে উভয় দেশ একমত হয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক স্মরণকালের মধ্যে এখন উষ্ণতম। দীর্ঘদিন অমীমাংসিত থাকা প্রধান প্রধান দ্বিপক্ষীয় সমস্যার সমাধান হয়েছে। দুদেশ সহযোগিতার নতুন এক কাল অতিক্রম করছে। সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ঢাকা-নয়াদিল্লি-ঢাকা মডেল স্থাপন করেছে। নতুন উচ্চতায় উন্নীত এ সম্পর্ক দুদেশের মানুষের জন্যই বড় আশাব্যঞ্জক। এরই মধ্যে জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশের পাশে থাকার ভারতের এই প্রতিশ্রুতি উভয় দেশকে আরো সমৃদ্ধির দিকেই ধাবিত করবে-এমন মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

লেখক : পরিচালক, এফবিসিসিআই

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close