সাধন সরকার

  ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

সড়ক দুর্ঘটনা ও ব্যবস্থাপনা

রাজধানীসহ সারাদেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে প্রায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটছে। সড়ক পথের নিরাপত্তা প্রসঙ্গটি আজকের দিনে সত্যিকারার্থে তাই পথচারী ও সব ধরনের পরিবহন যাত্রীকে ভাবিয়ে তুলেছে। মৃত্যুকে অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু গাড়ির চাকায় কিংবা ধাক্কায় মানুষের অকাল মৃত্যু প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। রাজধানীতে চলন্ত বাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতা বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন সম্ভাবনাময় ও স্বপ্নের অনেক জীবন সড়ক দুর্ঘটনার বলি হচ্ছে। তথ্যমতে, সড়কে দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটছে। ঢাকা মহানগরীতে চলাচলকারী বাসগুলোর মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বহুদিন ধরে চলে আসছে। রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করে চালকদের বেপরোয়া যানবাহন চালানো। এ ছাড়া রয়েছে চালকদের নিয়ম-কানুন মানাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনীহা, গাফিলতি ও অন্যায় করে চালকদের পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি। রাজধানীর গণপরিবহনে অপ্রাপ্তবয়স্ক ও ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন চালকের সংখ্যা অগণিত। এদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালানো দরকার। নির্দিষ্ট স্টপেজ ছাড়া বাস থামানো পুরোপুরি বন্ধ করা জরুরি। হাজার হাজার ফিটনেস সনদবিহীন যান ও লাখ লাখ লাইসেন্সবিহীন চালকের জন্য সড়ক নিরাপদ হচ্ছে না। স্টিয়ারিং হাতে চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের পেছনে সঠিক কারণটি দূর করতে হবে। বাংলাদেশে সড়ক উন্নয়নের ব্যয় চীন, ভারতসহ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশ থেকে বেশি হলেও সড়ক দুর্ঘটনার রোধ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। এ ক্ষেত্রে সড়কে গণহত্যা বন্ধে বিভিন্ন দেশের মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে।

দুঃখের বিষয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এ খাতটিকে যতটা জনগুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে দেখা হয়, আমাদের দেশে সেভাবে দেখা হয় না! বিশেষ করে ড্রাইভিং লাইসেন্স ও চালকের আইন মানার বিষয়টি এখনো অবহেলায় রয়ে গেছে। ‘বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির’ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের ‘সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের’ (এআরআই) তথ্য মতে, গত সাড়ে তিন বছরে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে প্রায় ২৫ হাজার ১২০ জন। এই সময়ে আহত হয়েছে প্রায় ৬৩ হাজার জন। ২০১৬ সালে প্রায় ৩ হাজার সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৫০০ জনের বেশি মানুষ মারা যায়। এর মধ্যে রয়েছে ৪৭০ জন নারী ও ৪৫৩ জন শিশু। মৃত্যুর এ মিছিল যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। ২০১৭ সালে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৭ হাজার ৩৯৭ জন। অতি সম্প্রতি ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত ২ হাজার ৮৬০টি দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৬২ জন নিহত হয়েছে। বুয়েটের এক জরিপ বলছে, সড়ক দুর্ঘটনার ৯০ শতাংশেরই কারণ চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও গতি। সড়ক দুর্ঘটনায় বছরের পর বছর ধরে মৃত্যুর এ মিছিল চলতেই আছে। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন মৃত্যুর কারণে অনেক পরিবারের অপূরণীয় ক্ষতির পাশাপাশি সার্বিক অর্থনীতিরও ক্ষতি হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে সড়ক দুর্ঘটনায় যারা মারা যায়, তাদের ৬০ শতাংশই কর্মক্ষম। তাদের মৃত্যুর কারণে পরিবারে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে নতুন আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চাকার সঙ্গে নারীদের ওড়না পেঁচিয়ে যাওয়া। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। আগে নদী ও রেলপথে যাত্রী ও পণ্য বেশি আনা-নেওয়া করা হতো। এখন পুরোপুরি সড়কপথে বেশি নির্ভরতায় সড়কে চাপ বাড়ছে। তাই দুর্ঘটনা কমাতে রেল ও নদীপথকে কাজে লাগাতে হবে। এক তথ্য মতে, সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষতির পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২ শতাংশের সমান। জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুসারে, ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি অর্ধেকে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ কারও একক কোনো কাজ নয়, সবার সমন্বিত চেষ্টায় এটি রুখতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কারণ হলো- লাইসেন্সবিহীন ও প্রশিক্ষণ নেই এমন চালক দিয়ে যানবাহন চালানো, ট্রাফিক আইন না মানা, ফিটনেসবিহীন যান, গাড়ির অতিরিক্ত গতি ও ওভারটেকিং, পণ্যবাহী ট্রাকে যাত্রী পরিবহন, জনসাধারণের সচেতনতার অভাব ও এবরো-থেবরো রাস্তা ইত্যাদি। কোনো প্রাণ কেন বাড়িতে পৌঁছানোর বদলে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে সড়কে পড়ে থাকবে ? কেন সড়ক অব্যবস্থাপনার শিকার হবে তিলে তিলে গড়া কারও স্বপ্ন ? কেন চালকের অসতর্ক ও গাফিলতির বলি হবে কোনো শিক্ষার্থী ? তাই সড়কে আইনশৃঙ্খলাসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। চালকদেরকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। সংশ্লিষ্ট পরিবহন মালিকরাও সড়ক দুর্ঘটনার দায় এড়াতে পারে না। মালিক ও চালকদেরকে অতি লোভ পরিহার করতে হবে। মালিকপক্ষকে চালকদের স্বাভাবিক বিশ্রাম দিতে হবে। সরকারের কঠোর পদক্ষেপ, আইনের প্রয়োগ, মালিকপক্ষের দায় ও জবাবদিহিসহ চালকদের মধ্যে আরও বেশি সতর্কতা ও ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করা গেলে সারা বছরই সড়ক নিরাপদ থাকবে ।

সরকার অনেক ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। পরিবহন খাতেও সঠিক তদারকি, মনোযোগ ও আন্তরিকতা দেখালে এ খাতটি সঠিক পথে ফিরে আসবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছেন। পরিবহন কর্তাব্যক্তিসহ সংশ্লিষ্ট চালকরা এই নির্দেশনা মেনে চললে সড়কে বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে। দুর্ঘটনা বন্ধে প্রতিটি স্কুল-কলেজের সামনে গতিরোধক থাকা দরকার। শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে স্কুল-কলেজভিত্তিক বাস সার্ভিস চালু করতে হবে। পুরো সড়ক ব্যবস্থাপনায় সৎ, যোগ্য ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বসাতে হবে। রাজধানীসহ সারা দেশে আরও বেশি সরকারি আধুনিক গণপরিবহন চালু করা হলে বেসরকারি খাতের দৌরাতœ্য কমে আসবে। রাজধানী ঢাকায় বাস চালাতে চালকদের সর্ব্বোচ সতর্কতা ও ধৈর্য কাম্য। কেননা রাজধানীর বেশিরভাগ রাস্তা বেশ ছোট এবং যানজটে দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকতে হয়। হঠাৎ বেপরোয়া মনোভাব দেখানো মানে জীবন নিয়ে খেলা করার সামিল! এ ছাড়া চুক্তিতে গাড়ি চালানো বন্ধ করতে হবে। কেননা চুক্তি থাকলে বেশি লাভের আশায় চালকরা অতিরিক্ত টিপ দিতে তাড়াহুড়ো করে বাস চালাতে থাকেন। মাসিক নিদিষ্ট বেতন থাকলে চালকদের বেপরেয়া মনোভাব কমে আসবে। এ ব্যাপারে মালিকদের সহযোগিতা কাম্য। সড়কে হত্যা বন্ধে দক্ষ চালকের বিকল্প নেই। সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি যেহেতু জাতীয় সেহেতু পরিবহন মালিক ও চালকদেরকে ট্রাফিক নিয়ম-কানুন এবং সরকারের নির্দেশনা মানতে হবে। এ ছাড়া সরকারিভাবেও চালকদের দু-এক দিনের ছোট প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে। সরকারের পক্ষে সম্ভব না হলে সংশ্লিষ্ট পরিবহন কোম্পানির মাধ্যমেও এটা করা যেতে পারে। দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে পথচারীদেরও দায় আছে বলে মনে করি! শহরে ফ্লাইওভার, জেব্রা ক্রসিং থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ পথচারী তা ব্যবহার করতে চান না! মহাসড়কে আবার নিষিদ্ধ তিন চাকার গাড়ি বা থ্রি হুইলার যানবাহন (নসিমন, করিমন, ভটভটি, লেগুনা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ইত্যাদি) হরহামেশাই চলছে। এগুলোর চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধে শুধু আইন করলেই হবে না, আইনের পরিপূর্ণ বাস্তবায়নই সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামাতে পারে।

বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করেছে। ২০২১ সালের মধ্যে ‘ডিজিটাল মধ্যম আয়ের দেশ’ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ‘উন্নত দেশ’ গঠনে সড়ক দুর্ঘটনার লাগাম টেনে ধরতেই হবে। কেননা সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ হলে ব্যক্তিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা সার্বিক প্রবৃদ্ধি আরও বাড়বে। তাছাড়া জাতিসংঘ ঘোষিত ২০৩০ সালের মধ্যে ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ (এসডিজি) অর্জনেও দেশের স্বার্থে, সবার স্বার্থে সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ করা অত্যন্ত জরুরি। ঝুঁকিপূর্ণ ও একই সাথে গুরুত্বপূর্ণ এ খাতটির সংস্কার এখন সময়ের দাবি। সড়ক দুর্ঘটনার লাগাম টেনে ধরতে কিছু বিষয়ে নজর দিতে হবে- ১. চালকদের বেপরোয়া মনোভাব ও গতি রুখতে তাদের সচেতনতা ও প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিতে হবে। ২. চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের পরই কেবল ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান করতে হবে। ৩. সড়কে পুলিশ ও মোবাইল কোর্টকে আরো সক্রিয় করতে হবে। ৪. মহাসড়কে ছোট যান (নছিমন, করিমন, ভটভটিসহ নানা নামে চলা অনিবন্ধিত যানবাহন) চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। ৫. বিভিন্ন দুর্ঘটনাপ্রবণ মোড় ও ট্রাফিক পয়েন্ট সংস্কার করতে হবে। ৬. চালকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে। ৭. বিভিন্ন কোম্পানি না রেখে একটি রুট একটি কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেওয়ার পাশাপাশি তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। ৮. এ খাতে সব ধরনের চাঁদাবাণিজ্য বন্ধসহ চালকদের চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালানো বন্ধ করতে হবে। ৯. বেসরকারি খাতের দৌরাত্ম্য কমাতে রাজধানীসহ সারাদেশে আরো বেশি সরকারি আধুনিক গণপরিবহন চালু করতে হবে। ১০. দুর্ঘটনা কমাতে সড়কের ওপর চাপ কমিয়ে রেল ও নদীপথকে কাজে লাগাতে হবে এবং। ১১. সর্বোপরি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পথচারী, চালক-মালিকসহ সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে ইত্যাদি। মনে রাখা দরকার, একটি সড়ক দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না! এ খাতটিকে মানবিক উন্নয়নের ধারায় ফিরিয়ে আনতে সরকারের যেকোনো ইতিবাচক ব্যবস্থা গ্রহণে যানবাহনের মালিক, চালক ও জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও সচেতনতা সবচেয়ে বেশি দরকার।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close