জি. কে. সাদিক

  ১৫ জুলাই, ২০১৮

আফগান

স্বার্থসংঘাত ও শান্তির সম্ভাবনা

আমেরিকার যুদ্ধের ইতিহাসে আফগান যুদ্ধ সময় হিসেবে দ্বিতীয় দীর্ঘযুদ্ধ। ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বিশ বছর ধরে চলা ভিয়েতনাম যুদ্ধ হচ্ছে আমেরিকার যুদ্ধ ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ। দুটি যুদ্ধের ফল এক। ভিয়েতনামে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর আমেরিকার শোচনীয় পরাজয় হয়। আর এখন আফগান যুদ্ধেও মার্কিননীতি পরাজয়ের পথে। আফগান যুদ্ধে গত ১৬ বছরে চার হাজার মার্কিন সৈন্য প্রাণ হারিয়েছে। আফগানিস্তানের সরকারি বাহিনীর ১৫ হাজার সৈন্য নিহত হয়েছে। তালেবান ও ইঙ্গ-মার্কিন হামলায় কয়েক লাখ বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে। এ যুদ্ধে আমেরিকার খরচ হয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলার। এত হামলা, রক্তপাত ও অর্থব্যয় তার পরও সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আফগানিস্তানে আমেরিকার পরাজয় অত্যসন্ন। তাই এখন বেশ কিছু বিষয় সামনে আসছে। যেমন : আমেরিকা কি এ পরাজয় মেনে নেবে? যদি মেনে নেয় তাহলে মার্কিন অর্থনীতি ও ভূ-রাজনীতিতে এর প্রভাব কেমন হবে? আর যদি মেনে না নেয়, তাহলে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা কতটা আছে? এখানে একটা বিষয় স্পষ্ট, আমেরিকা ও তার মিত্ররা আফগানিস্তানে জয় পাবে না। কারণ আফগান যুদ্ধের খেলোয়াড় আমেরিকা একা নয়। রাশিয়া আবারও আফগানিস্তানে ফিরে এসেছে। চীন, ভারত, পাকিস্তান ও ইরান আফগানিস্তানে নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাই আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি ক্রমে জটিলতর হচ্ছে এবং স্বার্থসংঘাতের সম্ভাবনা বাড়ছে।

আফগানিস্তানে মার্কিন জোটের অবস্থান অনেকটা খতরনাক। ২০১৭ সালের নভেম্বরে বিবিসি কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, আফগানিস্তানের ৭০ শতাংশ তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে আছে। এর মধ্যে ৪ শতাংশ অঞ্চলে পুরোপুরি তালেবান শাসন প্রতিষ্ঠিত। আফগান সরকারের এখানে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আর বাকি ৬৬ শতাংশ অঞ্চলে তালেবানদের সরাসরি উপস্থিতি রয়েছে। এ অঞ্চলে তালেবান ছায়া-সরকার গঠন করেছে, যার মাধ্যমে প্রভাব ধরে রেখেছে। বলতে গেলে, আফগান সরকার এসব অঞ্চলে তালেবান ছায়া-সরকারের প্রভাব মেনে নিয়েই নামমাত্র সরকারি শাসন ধরে রেখেছে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে এক লাখ মার্কিন জোট সেনা ছিল। বর্তমানে এ সংখ্যা মাত্র ১৫ হাজার। আমেরিকা ১ লাখ সেনা নিয়ে যেখানে মাত্র কিছু অংশ মুক্ত করতে সমর্থ হয়েছিল, সেখানে সাতভাগের একভাগ সেনা মোতায়ন রেখে ক্রমবর্ধমান তালেবান সম্রাজ্যকে রুখতে পারবে কি? ২০১৪ সালে আশরাফ ঘানি প্রতিদ্বন্দ্বী আবদুল্লাহ আবদুল্লার সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতার মাধ্যমে আমেরিকার ক্রীড়ানক হিসেবে আফগানিস্তানের শাসন ক্ষমতায় আসে। তালেবানরা আফগানিস্তানের বর্তমান প্রশাসনকে মেনে নেয়নি। তারা এ সরকারকে আমেরিকার পুতুল বলে অবহিত করে আসছে। সে জন্যই ঘানির পক্ষ থেকে বারবার শান্তি আলোচনার প্রস্তাব এলেও তালেবান কর্তৃপক্ষ তা গ্রহণ করেনি। তালেবানরা সরাসরি আমেরিকার সঙ্গে আলোচনা করবে বলে জানিয়ে দিয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমেরিকা কি তালেবানদের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসবে? আর বসলে এটা কি পরোক্ষভাবে তালেবান প্রভাবকে মেনে নেওয়া হচ্ছে না? মার্কিন প্রশাসন এই দোলাচলে আছে। তবে শেষ হিসেবে মনে হচ্ছে, তালেবানদের প্রস্তাব মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। যদি তালেবানদের প্রস্তাব বা তালেবানরা যা চায় তা মেনে নেয়, তাহলে আফগানিস্তানে আমেরিকার দিন শেষ হয়ে যাবে। কারণ তালেবানদের লড়াইটা হচ্ছে আফগানিস্তানে যেকোনো বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে। যত দিন কোনো বিদেশি শক্তি আফগানিস্তানে থাকবে, তালেবানরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবেÑএটাই তাদের সাফ কথা। বিষয় হচ্ছে, আমেরিকার জন্য আফগানিস্তান ছেড়ে দেওয়া শতাব্দীর সেরা পরাজয় ও ভুল হবে। এতে আমেরিকার ভূ-রাজনীতি মার খাবে। অন্যদিকে মধ্য-এশিয়ার পাঁচটি দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ হস্তগত করার কাজে আমেরিকা ব্যর্থ হবে। তাই আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা চলে যাবে, এটা আপাতত মনে হচ্ছে না। যদিও জয়ের সম্ভাবনা নেই। প্রয়োজনে আরো রক্তপাতের মাধ্যমে লড়াইটা চালিয়ে যাবে। এতে শুধু আমেরিকার একক স্বার্থ রয়েছে বিষয়টা এমন নয়। আমেরিকার ইউরোপিয়ান মিত্রদেরও স্বার্থ আছে। তাই আমেরিকা যদি রক্তপাত আরো দীর্ঘ করে, তথাপি একা হয়ে যাবে না।

আফগান ভূমি আমেরিকার কেন দরকার-এখন এ বিষয়ে কিছু বলা দরকার। প্রথমত, ভূ-রাজনীতির বিষয়টি সামনে আসে। দক্ষিণ এশিয়া ও ইরানের ওপর আমেরিকার প্রভাব বিস্তার করার জন্য আফগানিস্তানে সামরিক উপস্থিতি ধরে রাখতে হবে। নতুন যে বিষয়টি সামনে এসেছে, তা হচ্ছে চীনের প্রভাব। চীনের ‘ব্যাল্ট অ্যান্ড রোড’ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য আফগানিস্তানে চীনের প্রভাব দরকার। আর এটা হলে চীনের কাছে আমেরিকা কৌশলগতভাবে হেরে যাবে। আর সেটা হলে এশিয়াতে চীনের প্রভাব আরো শক্ত করবে, অন্যদিকে আমেরিকার এশিয়ান সাম্রাজ্যের কফিনে শেষ পেরেক ঢুকে যাবে, যা আমেরিকা কোনো দিন মেনে নেবে না। সম্প্রতি পুরোনো খেলোয়াড় রাশিয়ার উপস্থিতিও বড় মাথা ব্যথার কারণ। আমেরিকার সামরিক ও আর্থিক সাহায্য ছাড়া বর্তমান আফগান প্রশাসন এক মাসও টিকে থাকতে পারবে না। কারণ ইতোমধ্যে তালেবানদের অনেক সাহায্যকারী জুটে গেছে। আফগানিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন চিফ কমান্ড জেনারেল জন নিকলাস তালেবানদের নতুন অস্ত্রের জোগানদাতা হিসেবে রাশিয়াকে দায়ী করেছে। এ ছাড়া কাতারে তালেবান অফিসের সঙ্গে চীনের আঁতাত নিয়েও আলোচনা রয়েছে। তাই আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার চলে যাওয়ার মানে দাঁড়াচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া, ইরান ও মধ্য-এশিয়া থেকে আমেরিকার প্রভাব অনেকটা স্থায়ীভাবে শেষ হওয়া। কিন্তু এ অঞ্চলগুলোয় আমেরিকা তার প্রভাব খর্ব হতে দেবে না-সেটা যেকোনো মূল্যে।

আফগানিস্তানে আমেরিকার উপস্থিতির আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে আফগানিস্তানের ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর প্রকৃতি সম্পদ ও তেলসম্পদ। ২০০৭ সালে মার্কিন জিওলজিক্যাল সার্ভে ঘোষণা করে, আফগানিস্তানে অতুলনীয় খনিজ সম্পদ আছে। কিন্তু দুর্নীতিতে ডুবে থাকা দেশটির খনিশিল্পগুলো তালেবানদের অর্থ সংগ্রহের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস। আর খনিজ সম্পদসমৃদ্ধ এলাকাগুলো দখলের জন্যই সেখানে সহিংসতা বেশি হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে মূল্যবান খনিজদ্রব্য উত্তোলন করে নানাবিধ সাহায্যের জন্য আশা বিমান ও হেলিকপ্টারের মাধ্যমে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে গত শতকের নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে কাস্পিয়ান সাগর (হ্রদ) ও তার পাশের কাজাকিস্তান, তুর্কেমেনিস্তান ও উজবেকিস্তানে বিপুল পরিমাণে তেল ও গ্যাসের সন্ধ্যান পাওয়া গেছে। কাজাকিস্তানের সমুদ্রসৈকতে ও কাস্পিয়ান সাগরে ভূ-গর্ভস্থ তেলসম্পদের পরিমাণ ২০ বিলিয়ন ব্যারেল (কিছু বিশেষজ্ঞদের হিসাব মতে, ৫০ বিলিয়ন ব্যারেল)। এই তেলসম্পদের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর আগ্রহ বেশি। যথাযথভাবে উত্তোলন করা হলে, কাজাকিস্তানের তেলসম্পদ সৌদি আরবের চেয়ে বেশি হবে। তুর্কেমেনিস্তানে যে পরিমাণ তেল রয়েছে, তা পুরো বিশ্বে পঞ্চম। বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ৪টি তেল কোম্পানি এ অঞ্চলে ২০ কোটি ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে কাজ করছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এ তেল নিয়ে যাওয়ার জন্য এই অঞ্চলে কোনো সমুদ্রবন্দর নেই। সম্ভাব্য ৫টি উপায়ে পাইপলাইনের মাধ্যমে এ তেল অন্যত্র নিতে হবে। প্রথমটি হচ্ছে চীনের মধ্য দিয়ে পাইপলাইন স্থাপন করে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে রাশিয়ার মধ্য দিয়ে জর্জিয়ার বাকু হয়ে কৃষ্ণসাগরে বা বাকু হয়ে তুরস্কের মধ্য দিয়ে। তৃতীয়টি হচ্ছে ইরান হয়ে পারস্য উপসাগরে, বা ইরান হয়ে তুরস্কের মধ্য দিয়ে। চতুর্থটি হচ্ছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে পাইপলাইন করে করাচি বন্দর দিয়ে নিয়ে আসা। পঞ্চম রাস্তা হচ্ছে, রাশিয়া হয়ে চেচনিয়ার মধ্য দিয়ে। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও পঞ্চম রুটে তেল নিয়ে আসতে হলে চীন, রাশিয়া, ইরান ও তুরস্কের কাছে তেলবাণিজ্য জিম্মি হতে পারে। যার ওপর ভিত্তি করে বিশ্বরাজনীতিতে এই দেশগুলোর প্রভাব বেড়ে যাবে। তাই যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদেশগুলো এই রুট ব্যবহার করবে না। তাই চতুর্থ রুট তথা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে পাইপলাইন করে তেল নিয়ে আসা তুলনামূলক নিরাপদ। যদি আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা ঘাঁটি সরিয়ে ফেলে তাহলে এই পথটিও আর নিরাপদ থাকছে না। তাই তেলবাণিজ্যের স্বার্থে হলেও আমেরিকা আফগানিস্তানে প্রভাব ধরে রাখতে চেষ্টা করবে। আর এটা সম্ভব হবে তালেবান হটিয়ে বা তালেবানের সঙ্গে সমঝোতা করে বা আফগানিস্তানে বর্তমান সরকারের মতো পুতুল সরকার বসিয়ে রেখে। কিন্তু এ কাজটি আমেরিকার জন্য কঠিন হবে। ‘ব্যাল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পাকিস্তান-চীন অর্থনৈতিক করিডোরের নিরাপত্তার জন্য চীন বলয়ে আফগানিস্তানের অন্তর্ভুক্তি দরকার। এর জন্য চীন সম্ভাব্য যা করার তা করবে। সেটা তালেবানকে অস্ত্র, অর্থ ও টেকনিক্যাল সাপোর্টের মাধ্যমেও হতে পারে। সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধে যেমনটা আমেরিকা করেছিল। অন্যদিকে রাশিয়া মধ্য-এশিয়ার দেশগুলোর সম্পদ আমেরিকার হাতে চলে যেতে দেবে এমনটাও ভাবা যায় না। তাই এ অঞ্চল থেকে আমেরিকাকে হটাতে রাশিয়াও ক্রমেই সক্রিয় হচ্ছে। তাই আফগানিস্তান নিয়ে স্বার্থসংঘাত বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। যেটা শান্তিপ্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা বিলীন করে দিচ্ছে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist