বিশ্বজিত রায়
মতামত
আন্ডারগ্রাউন্ডে গডফাদার
পত্রিকার পাতা খুললেই মাদক সম্পর্কিত সংবাদ। বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ভীতসন্ত্রস্ত সংবাদকে ছাপিয়ে এখন বড় খবর হচ্ছে পেশাদার রাঘববোয়ালদের পালানো সংশ্লিষ্ট বিষয়। অর্থাৎ মাদকের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানের প্রতিক্রিয়ায় বাধ্য হয়েই গা ঢাকা দিচ্ছে মাদকের ডন, গডফাদার, সম্রাটবেশী হোতারা। বন্দুকযুদ্ধের প্রাণবিনাশী কর্মকা-ে নাজেহাল পরিস্থিতি তাদের বাধ্য করছে বাড়ি ছেড়ে পালাতে। মাদকের অবৈধ অর্থে গড়ে তোলা বিলাসবহুল বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে সময়ের দুর্দান্ত পেশাদার ডনরা। বিশ্লেষকদের মতে, মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারী রাঘববোয়াল শ্রেণিভুক্ত মানুষগুলো যদি পালিয়ে যায়, তাহলে এই অভিযান অনর্থক বলে বিবেচিত হবে। মাদকের চুনোপুঁটি পরিচয়ধারী মানুষগুলোকে যেভাবে হত্যা করা হচ্ছে, তাতে বোঝা যায়, শুধু এদেরই ধ্বংস করলে দেশে মাদকের ভয়াবহতা কমে আসবে। কিন্তু তা আসলে না। যাদের হাত ধরে মাদক দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে, তাদের পালানোর পথ বন্ধ করে সম্রাটবেশী ওই হাতে হাতকড়া লাগিয়ে আইন-আদালতের মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারলেই তা সম্ভব হবে।
বন্দুকযুদ্ধের প্রাণবিপন্ন বিউগল শুনিয়ে দুর্ধর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের দেশ ছেড়ে পালানোর আগাম ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে কি না, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। মাদকযুদ্ধে নিহত সংবাদ যতটা না আলোচনার জন্ম দিয়েছে, তার চেয়ে বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে মাদক নিয়ন্ত্রণকারীদের দেশ ছেড়ে অন্যত্র গা ঢাকা দেওয়ার বিষয়টি। মাদকডনরা বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতেই হয়তো নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে। মাদকের বিরুদ্ধে চলমান শক্ত অভিযান ভাটা পড়লেই আবার স্বমহিমায় জেগে উঠবে এই পলাতক গডফাদাররা। তারা ফের পুরোদমে সক্রিয় হবে এই অবৈধ পেশায়। বন্দুকযুদ্ধে নিহত মাঠ চষে বেড়ানো ছোটখাটো মাদক বিক্রয় প্রতিনিধির শূন্য জায়গায় তারা অন্য কাউকে ধরে পুরোনো পেশা নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ চেষ্টায় ব্রতি হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
অনৈতিক অর্থবিত্তে প্রতিষ্ঠিত সুরম্য অট্টালিকার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসে বসে চালিয়ে যাবে অতীতের অশনি কার্যক্রম। অল্পতেই অধিক অর্থ, এমন লোভ দেখিয়ে দলে ভিড়াবে শত শত বেকার যুবক। তাদের হাতে মাদক তুলে দিয়ে আস্তে আস্তে সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে মাদক অপরাধী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে দেশবিধ্বংসী ওই নীতিভ্রষ্ঠরা। যারা দেশের আনাচে-কানাচে মাদক ছড়িয়ে দেওয়ার প্রধান কাজ সম্পাদন করে আসছে, তারা কেন ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে এভাবে পর্দার অন্তরালে চলে যাবে। তাহলে কি ধরে নেওয়া যায়, মাদক বিক্রয় ও বহনকারীর জন্য এক আইন আর মাদক নিয়ন্ত্রণকারী আসল ব্যক্তিটির জন্য আরেক আইন বলবৎ রাখা হয়েছে। এই দ্বৈতনীতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার আগে সরকারি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সঠিক পন্থা অবলম্বন করা উচিত ছিল। যদি বলেন কি সেই পন্থাটি তাহলে বলব, চুনোপুঁটিদের ক্রসফায়ারিংয়ের পরিবর্তে আগে মাদকের মূল হোতাদের পাকড়াও করে পরে এদের নিয়ন্ত্রণাধীন চুনোপুঁটি গোষ্ঠীকে ধরে ধরে আইনের সঠিক প্রক্রিয়ায় শাস্তিযোগ্য সমাধানে এলে ভালো হতো। তাহলে বিতর্কের ডালপালা এভাবে পত্রপল্লবে সুশোভিত হতো না।
আজ মাদক নির্মূলে যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হচ্ছে, সফলতা তেমন ধরা দেবে বলে মনে হয় না। হয়তো মাদকের হাট সাময়িক স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে। তবে দীর্ঘস্থায়ী কোনো ফল আসবে না। বন্দুকযুদ্ধের ভয়াবহ রেশ কাটাতে মাদকের বড় মাথাওয়ালারা যেভাবে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে, তাতে আতঙ্কের ক্ষেত্রটা আরো পাকাপোক্ত হচ্ছে। কারণ মাদকের গডফাদাররাই যদি এ অভিযানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পর্দার ভাঁজে লুকিয়ে পড়ে, তাহলে এই মাদকবিরোধী যুদ্ধ সম্পূর্ণভাবে নিরর্থক বলেই প্রমাণিত হবে। তাই অনতিবিলম্বে রাঘববোয়ালদের পাকড়াওয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এরাই আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজকে মাদকের উর্বর ভূমিতে পরিণত করছে। তাদের নীতিবিবর্জিত কর্মেই সর্বত্র মিলছে ইয়াবা-মদসহ বিভিন্ন জাতের মাদকদ্রব্য।
মাদকের বিরুদ্ধে যেহেতু যুদ্ধই ঘোষণা করা হয়েছে, সেহেতু চুনোপুঁটি নয় মাদকে অভিযুক্ত সব পাপিষ্ঠের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে হবে। মাদকের মূল হোতাদের পালানোর সুযোগ না দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব অপরাধীর হাতে হাতকড়া পরাতে হবে। তাদের আইনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে কঠিন শাস্তির আওতায়
আনতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে মাদক সমূলে ধ্বংস করতে হলে আসল আস্তানায় হাত দিতে হবে। মাদকের মূল উৎপাটনে প্রয়োজন শক্ত দাওয়াই। মাদকের বিরুদ্ধে আজ যে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, এই যুদ্ধ আরো আগেই প্রয়োজন ছিল। যাই হোক, পানি ঘোলা করে হলেও অবশেষে যে এ অভিযান চালানো হয়েছে, তা ইতিবাচক। তবে স্বস্তির বদলে মানুষের মনে অস্বস্তিই কাজ করছে বেশি।
সারা দেশে ৪ মে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকে এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত র্যাব-পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে কমপক্ষে ১০০ জন নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে সবাই কি মাদক ব্যবসায়ী? তার বড় প্রমাণ টেকনাফের একরামুল হক হত্যাকা-। খবরে বলা হয়, ‘র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে পৌর কাউন্সিলর একরামুল হক নিহতের ঘটনায় বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে টেকনাফে। এলাকাবাসীর দাবি, একরামুল হক ইয়াবা ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। এ ঘটনায় র্যাবের পাঠানো প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেও তথ্যগত ভুল রয়েছে। ভুল তথ্যের ভিত্তিতে র্যাবের অভিযানে একরাম নিহত হয়েছেন কি নাÑতা তদন্তের দাবি উঠেছে।’
মাদক অপরাধীরা নিঃসন্দেহে বড় অপরাধী। এতে কোনো সংশয় নেই। এরা হাজারো মানুষকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিচ্ছে। একজন খুনি একজন, দুজন, তিনজনকে হত্যা করতে পারে। কিন্তু একজন মাদক ব্যবসায়ী পুরো সমাজকেই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। এই ধ্বংসলীলা চলতে পারে না। যুবসমাজ ধ্বংসকারী মাদকওয়ালাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই এই অভিযানের প্রয়োজন আছে। তবে তা গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া অনুসরণ করার মাধ্যমে। যেখানে সমালোচনা থাকবে না। এ ক্ষেত্রে একেবারে সর্বনি¤œ পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত জবাবদিহি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। ছোট-বড় যেকোনো মাদক ব্যবসায়ীই যেন কোনো ধরনের অনুকম্পা না পায়। যে যত বড় ক্ষমতাশালীই হোক না কেন, তাকে তার অপরাধ অনুযায়ী বিচার করতে হবে। তবেই হয়তো মাদক নির্মূলে সফলতা আসবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
"