নিতাই চন্দ্র রায়

  ২৬ মে, ২০১৮

স্মরণ

স্বাধীনতা ও সাম্যের কবি নজরুল

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি শামসুর রাহমান তার বিখ্যাত ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় যথার্থই লিখেছেন ‘স্বাধীনতা তুমি/কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো/মহান পুরুষ, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা।’ বাঙালির শাশ্বত সংগ্রাম, দ্রোহের দীক্ষা, আন্দোলনের ইতিহাস-ঐতিহ্য, মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার দৃঢ় প্রত্যয়, স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, বৃষ্টি-বন্যার সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকার দুর্জয় সাহস, নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের আর্তনাদ, ইংরেজদের সীমাহীন অত্যাচার, জমিদারদের নিপীড়ন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষপীড়িত কঙ্কালসার মানুষের মিছিল, ধর্মের নামে সাম্প্র্রদায়িক দাঙ্গা, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য নজরুলকে তার কালজয়ী কবিতা, গান, গল্প ও উপন্যাস রচনায় দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। বাঙালির প্রাণের কথা, আত্মার অগ্নুৎপাতের কথা, নিভৃত হৃদয়ের কথা নজরুলের আগে আর কোনো বাঙালি কবি এত সহজ সাবলীল ভাষায় প্রকাশ করতে পারেননি। তাই নজরুল আমাদের প্রাণের কবি, ভালোবাসার কবি। সব বৈষম্য বিনাশের কবি। নজরুলের মধ্যেই খুঁজে পায় বাঙালি তার জীবন সংগ্রাম, প্রেম ও ভালোবাসার প্রতীতি। খুঁজে পায় তার স্বপ্নের সংগীত। বেঁচে থাকার আশা ও সংগ্রামের সঞ্জীবনী সুধা।

বাঙালির প্রতিটি সংগ্রামে নজরুলের কবিতা ও গান আমাদের অসীম অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘চল্ চল্ চল্। ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল,/নি¤েœ উতলা ধরণী-তল,/অরুণ প্রাতের তরুণ-দল/চলরে চলরে চল...’ গানটি প্রতিটি মুক্তি সেনাকে জুগিয়েছে সীমাহীন সাহস ও যুদ্ধ জয়ের প্রেরণা। ‘দেখিনু সেদিন রেলে/কুলি বলে এক বাবু সাব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে।/চোখ ফেটে এলো জল,/এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’ নজরুল ইসলাম ছাড়া কুলি-মজুদের প্রতি এত মমত্ববোধ, হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা আর কারো কবিতায় পাওয়া যায় না। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পতাকা উত্তোলনের এমন চিত্রকল্পই বা আঁকতে পেরেছেন কজন কবি? উঠরে চাষি জগৎ বাসী, ধর কষে লাঙ্গল। এমন সাহসী কথাই ক’জন কবি বাংলার বঞ্চিত কৃষকের অধিকার আদায়ের জন্য উচ্চারণ করেছেন? নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, শেরেবাংলা এ কে ফজলুর হক, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জাতীয় চার নেতার মধ্যে আমরা নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, আপসহীন মনোভাব, শোষণহীন সমাজ নির্মাণের অঙ্গীকার, স্বাধীনতার স্বপ্ন, নারী-পুরুষের সম-অধিকারের কথা শুনতে পাই। শুনতে পাই নিপীড়িত মানুষের মুক্তির গান। নজরুলের মতো বঙ্গবন্ধু দেশের কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, মজুরসহ গরিব ও দুঃখী মানুষকে খুব ভালোবাসতেন। তাই তিনি বড় বড় জনসভায় নজরুলের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করতেন। বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘আমার দেশের মানুষ দুঃখী, না খেয়ে কষ্ট পায়। গায়ে কাপড় নেই। শিক্ষার আলো তারা পায় না, রাতে একটা হারিকেনও জ্বালাতে পারে না। আমরা চাই শোষিতের গণতন্ত্র।’ আরো বলতেন, ‘আমার জীবনের একমাত্র কামনা, বাংলাদেশের মানুষ যেন তাদের খাদ্য পায়, আশ্রয় পায় এবং উন্নত জীবনের অধিকারী হয়।’ বিদ্রোহী কবি নজরুলের প্রতি বঙ্গবন্ধুর গভীর শ্রদ্ধা, মমত্ববোধ ও প্রচ- ভালোবাসা ছিল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২৪ মে কলকাতা থেকে বিদ্রোহী কবিকে সপরিবারে ঢাকায় এনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন এবং বাংলা একাডেমি মঞ্চে কবিকে নিয়ে মহাসমারোহে জন্মদিন পালনের ব্যবস্থা করেন। কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বাংলাদেশ সরকার কবিকে একুশে পদক প্রদান এবং নজরুলের নামে একটি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৭৬ সালে আগস্ট মাসে কবি ইন্তেকাল করলে কবিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে দাফন করা হয়। এক কথায় বাংলাদেশের মানুষ বিদ্রোহী কবিকে জাতীয় কবির মর্যাদায় চিরস্মরণীয় করে রেখেছেন ভালোবাসার সুদৃঢ় বন্ধনে।

বাংলা ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ, আসানসোলের চুরলিয়া গ্রামে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের মাত্র আট বছর বয়সে তার বাবার মৃত্যু হয়। এ জন্য তাকে চরম দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বড় হতে হয়। তিনি আসানসোলে এক রুটির দোকানে চাকরি করতেন। সেখানেই পরিচয় হয় কাজীর শিমলার দারোগা রফিজুল্লাহর সঙ্গে কিশোর নজরুলের। পরিচয়ের সূত্র ধরেই ময়মমনসিংহের ত্রিশালের পুণ্য ভূমিতে আগমন ঘটে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের।

১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত সময়ে পিএ নাজির ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক ছিলেন। তার সময়ই প্রথম ত্রিশালে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নজরুলজয়ন্তী পালিত হয়। ওই সময় দরিরামপুর গ্রামের আবদুল মোতালেব নামের একজন গানের শিক্ষক নজরুলকে নিয়ে একটি জারি গান রচনা ও সুরারোপ করেন। তার রচিত গানটি ছিল ‘এলরে ভাই নজরুলজয়ন্তী, বাহ্ রে মজা বাহ্। মলয়ে পরশে মোদের জুরালো যে গা...’ জারি গানটি নজরুলভক্তরা গভীর মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করতেন। ওই জারি গানের সূত্র ধরে বলা যায়, কিশোর নজরুল ১৯১৪ সালেই দরিরামপুর হাইস্কুলে ভর্তি হন। রফিজুল্লাহ দারোগার ভ্রাতুষ্পুত্র কাজী তালেবুর রহমান রচিত ‘আসানসোল, কাজীর শিমলা ও দরিরামপুরে নজরুল’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, লেখকের ছোট চাচা কাজী আবুল হোসেন আসানসোলে নজরুলের সহপাঠী ছিলেন। কাজী রফিজুল্লাহর ইচ্ছায় ১৯১৪ সালের এক দিন গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে কাজীর শিমলায় হাজির হন কিশোর নজরুল। কাজী আবুল হোসেনই নজরুলকে দরিরামপুর হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। কাজী শিমলা থেকে দরিরামপুরের দূরত্ব ছিল আট কিলোমিটার। এত দূর থেকে হেঁটে প্রতিদিন স্কুলে আসা নজরুলের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই তাকে দরিরামপুর থেকে দুই কিলোমিটার দূরে ত্রিশালের নামাপাড়ার বেচুতিয়া বেপারি বাড়িতে জায়গিরের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। নামাপাড়া থেকে সামান্য দূরে শুকনি বিলের ধারে এক বটবৃক্ষের নিচে বসে কবি রাখাল বালকদের সঙ্গে বাঁশি বাজাতেন, সুর করে গান গাইতেন। কথিত আছে, ১৯১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে দরিরামপুর হাইস্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার ফল বড়দিনের ছুটির আগে প্রকাশিত হয়। নজরুল ইসলাম বেশ কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম স্থান অধিকার করে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। নজরুল ফার্সিতে ৯৮ নম্বর পান। অধিকাংশ ছাত্র অকৃতকার্য হওয়ায় পাঁচ নম্বর গ্রেস দেওয়ায় নজরুল তার দাবিদার হয়ে তা পেতে ব্যর্থ হওয়ার প্রতিবাদে ফলাফল প্রকাশের দুদিন পর লেখকের ছোট চাচা কাজী আবুল হোসেনের সঙ্গে ময়মনসিংহ গিয়ে আর বেচুতিয়া বেপারি বাড়িতে ফিরে আসেননি। সেই হিসেবে ত্রিশালে নজরুলের অবস্থান ছিল এক বছর আট মাস। ত্রিশালে অবস্থানকালে কিশোর নজরুল কর্তৃক রচিত কোনো কবিতা, গল্প বা সংগীতের কথা আমাদের জানা নেই। ১৯২৬ সালের ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ শহরে জেলা কৃষক ও শ্রমিক সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে অসুস্থতার কারণে যোগ দিতে না পেরে আয়োজকদের উদ্দেশে লিখেছিলেন, ‘ময়মনসিংহ আমার কাছে নতুন নহে। এই ময়মনসিংহ জেলার কাছে আমি অশেষ ঋণী। আমার বাল্যকাল-এর অনেকগুলি দিন ইহারই বুকে কাটিয়া গিয়াছে। এখানে থাকিয়া আমি কিছুদিন লেখাপড়া করিয়া গিয়াছি। আজ-ও আমার মনে সেই সব প্রিয় স্মৃতি উজ্জ্বল ভাস্বর হইয়া জ্বলিতেছে। বড় আশা করিয়া ছিলাম আমার সেই শৈশব-চেনা ভূমির পবিত্র মাটি মাথায় লইয়া ধন্য হইব, উদার হৃদয় ময়মনসিংহ জেলাবাসীর প্রাণের পরশমণির স্পর্শে আমার সেই প্রাণকে কাঞ্চনময় করিয়া তুলিব। কিন্তু তাহা হইল না, দুরদৃষ্ট আমার।’ ত্রিশালের মানুষ কবি নজরুল ইসলামকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। ত্রিশালে নজরুলের নামে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পাঠাগার আছে। ২০০৬ সালে ত্রিশালের বটতলায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ভবন, হল, ক্যান্টিন, মঞ্চ এমনকি পরিবহনের গাড়িগুলো নজরুলের সৃষ্টি কর্মের নামে নামাঙ্কিত। প্রতি বছর ত্রিশালে তিনব্যাপী জাতীয়ভাবে নজরুলজয়ন্তী পালিত হয়। নজরুলজয়ন্তীকে কেন্দ্র করে নজরুল একাডেমি মাঠে তিন দিনব্যাপী গ্রামীণ কুটিরশিল্পের মেলা বসে। বইমেলারও আয়োজন করা হয়। কখনো কখনো মহামান্য রাষ্ট্রপতি অথবা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও নজরুলজন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের প্রথিতযশা কণ্ঠশিল্পী, কবি-সাহিত্যিক, দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা নজরুল গবেষকসহ ওই অনুষ্ঠানে হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটে।

লেখক : কবি ও গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist